খেলাঘরখেলাঘর


“কত পাহাড় পেরিয়ে, নদী-নালা ডিঙিয়ে এগিয়ে চলে তারা। চলে, চলে, চলে, পথ আর ফুরোয় না। শেষ পর্যন্ত একদিন এক ঘন জঙ্গল ভেঙে বেরিয়ে এসে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
“এক ঝলমলে আলোর দেশ তাদের সামনে। আকাশ সুন্দর সাতটা রঙে উজ্জ্বল হয়ে আছে। দূরে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আনন্দে খেলা করে বেড়াচ্ছে। আর কী সব অপূর্ব পাতাবাহারী গাছে, রঙবাহারী ফুলে ভরে আছে চারদিক – কোথায় লাগে তার কাছে সোনা, হীরে, মানিকের ছটা! এক মিষ্টি গানের সুরে ভরে উঠছে বাতাস। দূরে দেখা যায় এক বিরাট পাহাড়, সবুজে সবুজে ছেয়ে আছে তার গা। আর সেখান থেকে ঝির ঝির ঝরে পড়ছে এক ঝর্ণা – জীয়ন ঝর্ণা!
“সবাই সেদিকে চেয়ে আছে, কারো মুখে কথা জোগায় না। শেষ অবধি সুজনই বলে, ‘তাহলে মৌমাছি বন্ধু, তুমি বাড়ি ফিরে যাও। বাঁদর আর বেড়াল বন্ধু, তোমরা এখানে একটু বসো। আমি যাচ্ছি ঝর্ণার দিকে। যদি আর না ফিরি, আমার জন্যে দুঃখ করো না। পারো তো গাঁয়ে গিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিও – সুজন শেষ অবধি জীয়ন ঝর্ণার জল আনতে পারেনি বটে, কিন্তু চেষ্টার কসুর করেনি।
“কী আর করে, চোখের জল ফেলে সবাই সুজনকে বিদায় জানায়। ‘বিপদ হলে মনে মনে আমায় ডেকো’, বলে বাড়ির দিকে উড়ে যায় মৌমাছি।

“বুকভরা সাহস নিয়ে এগিয়ে চলে সুজন। গাছের পাতারা বলে, আমাদের ধরো। ছোট শিশুরা বলে, আমাদের কোলে নাও। রঙীন আকাশ থেকে কে যেন বলে ওঠে – ওগো, দু’দণ্ড থেমে আমাদের গান শুনে যাও। কিন্তু কোনোদিকে না তাকিয়ে সুজন সটান এগিয়ে চলে জীয়ন ঝর্ণার দিকে।
“ও মা – কোথায় রঙ, কোথায় শিশু, কোথায় গান – সব মুহূর্তে ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেলো। তালগাছের মত বড় এক দৈত্য যেন আকাশ ফুঁড়ে এসে হাজির। সুজনকে দেখে তার ভাটার মত চোখ রাগে ঘুরতে থাকে।
“দুধের বাচ্চা, সাধ করে মরণের মুখে পা বাড়িয়েছিস। ভালোয় ভালোয় প্রাণটা নিয়ে এখনো ফিরে যা”, বাজের মত হেঁকে বলে দৈত্য।
“হয় জল নেবো, নয় প্রাণ দেবো।” তলোয়ার খুলে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সুজন। ঝড়ের বেগে এসে দৈত্য ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর।
“বীরের মত লড়ে সুজন – কিন্তু ঐ ধুমসো দৈত্যের সঙ্গে পারবে কেন! কিছুক্ষণের মধ্যেই দৈত্য তাকে কেটে টুকরো টুকরো করে রেখে হাসতে হাসতে চলে যায়।”
তুতুলের ঠোঁট কাঁপে, গলার শুকনো ডেলাটা আর ভেতরে থাকতে চায় না। কিন্তু অ্যাদ্দিনে কি আর ওর মা’কে চিনতে বাকি আছে! তাই চুপচাপ আবার শুনতে থাকে –

“সারারাত ধরে সেখানে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে দুই বন্ধু বাঁদর আর বেড়াল। তারপর একসময় ভোর হয়। লাল টুকটুকে সুয্যিমামা যাবার পথে এই দৃশ্য দেখে থমকে থেমে যান। তাঁর মন কেঁদে ওঠে। কী করেন, কী করেন – শেষে এক ফুঁয়ে জীয়ন ঝর্ণার খানিকটা জল আকাশে উড়িয়ে দিয়ে মেঘ করলেন। একটু পর ঝমঝম বৃষ্টি হয়ে সেই মেঘ জল ঢাললো সুজনের গায়ে।
“ঊঃ, বড্ড ঘুমিয়েছি!” আড়মোড়া ভেঙে উঠে বলে সুজন। জলের ছোঁয়ায় তার শরীর আগের চেয়ে বড় হয়েছে, শক্তিও হয়েছে আগের চেয়ে বেশি।
“হ্যাঁ, দিব্যি ঘুম মেরেছো, বন্ধু!” মুখ টিপে হাসে বাঁদর-বেড়াল, খুলে আর কিছু বলে না।
“খবর পেয়ে আবার ধেয়ে আসে দৈত্য। দাঁত কড়মড় করতে করতে বলে, “মানুষের বাচ্চা, এবার দেখি তুই কী করে বেঁচে উঠিস।” সে যা ভয়ানক লড়াই হয়! দৈত্যের একটা হাতও কাটা যায়। কিন্তু হলে হবে কী, দৈত্য আবার সুজনকে মেরে ফ্যালে। তারপর সে সুজনের শরীরটা ভালো করে মাটিতে পুঁতে রেখে জীয়ন ঝর্ণার দিকে এগোয়। সেখানে গিয়ে ঝর্ণার খানিকটা জল লাগিয়ে কাটা হাত আবার জুড়ে নেয়।”
“আচ্ছা মা, দৈত্য তো দুষ্টু। তবে জীয়ন ঝর্ণার জল লেগে ছাই হয়ে গেলো না কেন?” – তুতুলকে ফাঁকি দেওয়া কি অত সোজা!
এই রে! অলক্ষ্যে জিভ কাটেন মা। তারপর ভেবেচিন্তে বলেন, “দৈত্য কি মানুষ? দুষ্টু মানুষ তো ছাই হয়ে যাবে, তাই বললো না বুড়ো?”
“বুঝতে পেরেছি, এবার বলো তারপর কী হলো।” তুতুল আবার গুটিসুটি মেরে বসে।

“কী হবে, কী হবে – দুই বন্ধুর তো মাথায় হাত! কাল সকালে এসে সুয্যিমামা যে সুজনকে খুঁজে পাবেন না! কী করে তাকে বাঁচাবেন তবে?
“দাঁড়াও, আমি দেখি চেষ্টা করে।” বলে বেড়াল। তারপর সে নখ দিয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে মাটি খুঁড়তে থাকে। খুঁড়ছে তো খুঁড়ছেই, মাটি তুলছে তো তুলছেই, শরীর আর চলে না! ভোর প্রায় হয়ে আসে। এমন সময় শেষ অবধি তার নখে ঠেকে সুজনের শরীর। চটপট আঁচড়ে-পাঁচড়ে তার ওপরের মাটিটুকু সরিয়ে দেহটা খোলা জায়গায় টেনে আনে দুই বন্ধু।
“সকালবেলা সুয্যিমামা আবার বাঁচিয়ে দিলেন সুজনকে। আরো বড় হয়ে গেলো সুজন, গায়ে হলো আরো জোর। আবার ধেয়ে এলো দত্যি।
“আরো জোরদার লড়াই হলো এবার। দৈত্যের একটা পা গেলো উড়ে। কিন্তু এবারও শেষ অবধি তারই হলো জয়। সুজনকে মেরে ফেলে সে এবার দেহটা একটা কাপড়ের পুঁটলিতে পাকিয়ে রেখে দিয়ে এলো এক্কেবারে উঁচু সেই পাহাড়ের মাথায়, গাছপালার আড়ালে। “দেখি এবার শেয়ালে-কুকুরে কী করে তোর দেহ খুঁড়ে তোলে!” হা-হা করে হেসে বলে দৈত্য। তারপর ঝর্ণার জলে পা-টা জুড়ে আবার ঠিক আগের মতন।
“রাত্তির হতেই বাঁদর হুপহাপ গাছে গাছে লাফিয়ে চলে। পাহাড়ের মাথা – সে কি এখানে! তবু হাল ছাড়ে না বাঁদর। শেষ অবধি সুয্যিমামা যখন উঠি-উঠি করছেন, সে খুঁজে পেলো সুজনের শরীর। পুঁটলি খুলে দেহটা বের করে ফেলে রাখলো খোলামেলা জায়গায়।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।