খেলাঘরখেলাঘর


রাত তখন সারে দশটার কাছাকাছি।রিক্সা থেকে নামল দারোয়ান ও চক্র।চক্রকে কোলে করে নামাতে হলো।সদর দরজা আজ খোলাই ছিলো।রিক্সার সামান্য শব্দ শুনেই চক্রর মা,বাবা,এক সঙ্গে দরজার বাইরে বেরিয়ে এলেন।দারোয়ানের কোলে চক্রকে দেখে,চক্র,চক্র বলে ছুটে এলেন তাঁরা।
মা চক্রকে জড়িয়ে ধরলেন,বলে উঠলেন,কি হয়েছে বাবা!কি হয়েছে তোমার!কান্নায় ভেঙে পড়লেন মা।বাবা হতবাক হোয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।তাঁর চোখের কোন ভিজে যেতে লাগলো।
দারোয়ান করুণ সুরে বলে উঠলো,বাবু!,ভয়ে তার মুখ দিয়ে কথা সরছিল না।হঠাৎ সে চক্রর বাবার পা জড়িয়ে ধরলো,বাবু! আমায় মাপ করুন।আমি দোষ করেছি,বাবু!
ছেলে স্কুলে আটকে পড়েছিল জানতে পেরে সত্যি রাগে কান্ডজ্ঞানহীন হোয়ে পড়লেন তিনি।দারোয়ানকে ঠাস,ঠাস,চড় মারতে লাগলেন।
দারোয়ান কাঁদতে কাঁদতে বলে ওঠে,আরও মারুন,বাবু সাব,আরও মারুন।
--দাঁড়া,আমি তোকে পুলিশে দেবো,তোকে আমি ছাড়ব না,চক্রর বাবা ভীষণ উত্তেজিত হোয়ে গেলেন।
দারোয়ান হাত জোড় করে কাঁদো কাঁদো হোয়ে বলে ওঠে,বাবু সাব,আরও মারুন আমায়,হাত দিয়ে মারুন,লাঠি দিয়ে মারুন,চাবুক এনে মারুন,কিন্তু বাবু,হাতে  মরুন,আমায় ভাতে  মারবেন না।আমারও সংসার আছে,বৌ,ছেলে,মেয়ে,আছে। ওদের পেটে লাথি মারবেন না বাবু!
আস্তে আস্তে শান্ত হতে লাগলেন চক্রর বাবা।ভাবলেন,কি হবে গরীবের পেট মেরে। ঘটনা যা ঘটার তা তো ঘটেই গেছে।দারোয়ানকে ছেড়ে দিয়ে তিনি তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকলেন।ছেলে তার মার কোলে কেঁদে চলেছে তখনও,বাবাকে দেখে চক্র আরও ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠলো।বাবা কোলে তুলে  নিলেন ওকে।মুখ দিয়ে তাঁর সম্পূর্ণ কথা সরল না,কেবল,বাবা,বাবা,বলে ডেকে উঠলেন তিনি।
রাত এগারোটা কোথা দিয়ে বেজে গেলো কেউ টের পেল না।ঘটনার উত্তেজনা খুব ধীরে ধীরে হলেও শান্ত হোয়ে আসছিল।চক্র নিজেকে সামান্য সুস্থ অনুভব করছিল। এবার  তার পেট খিদেতে মুচড়ে উঠলো।ও ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠলো,মা,খুব খিদে পেয়েছে,মা!
মা তাড়াতাড়ি ছেলের খাবার থালে বেড়ে ওর মুখের সামনে তুলে ধরলেন।ছেলের অসুবিধা হবে ভেবে তিনি খায়িয়ে দিতে লাগলেন।খিদে আর সহ্য হচ্ছিল না,খুব তাড়াতাড়ি খেতে থাকলো চক্র।খিদের মুখে তার কাছে সব খাবার খুব ভালো লাগছিলো।মার দেবার আগেই ও খেয়ে নিচ্ছিল।পরের গ্রাসের জন্যে হাঁ করে বসে থাকছিল।গপাগপ সে থালের সমস্ত খাবারগুলি খেয়ে নিল।ঢকঢক করে পুরো এক গ্লাস জল খেয়ে নিল।এবার অনেকটা শান্ত হোয়ে চক্রর মনে পড়ে গেল একটা কথা।ও মাকে ডেকে বলল,মা,আমি আর লচ্ছুকে রাক্ষস বলব না,মা!
মা জিজ্ঞেস করলেন,কেনো,বাবা?
চক্র ধীরে ধীরে বলে উঠলো,আজ আমার এত খিদে পেয়েছিল,মা,দেখলে আমিও না রাক্ষসের মত সব গপাগপ খেয়ে নিলাম--ঠিক লচ্ছুর মত!
                                            

 

তাপসকিরণ রায়    
জবলপুর , মধ্য প্রদেশ

তাপস কিরণ রায় অর্থশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন। স্কুলে শিক্ষকতা করেন বেশ কিছু বছর। পরে আয়কর বিভাগে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি মধ্য প্রদেশের জবলপুর শহরে বাস করেন। তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করেন। ছোটদের এবং বড়দের জন্য লেখা তাঁর অনেকগুলি বই-ও প্রকাশিত হয়েছে।