খেলাঘরখেলাঘর

আমার বিড়ালছানা

তখন রানাঘাটে থাকতাম।ক্লাস ফোরে পড়ি।ছুটির দিনে সকালে বিছানায় শুয়েই শুনতে পেলাম,গেটের বাইরে একটা বেড়াল,‘মেউ,মেউ’,করে ডেকে চলেছে।বরাবরই আমার কুকুর,বিড়াল পালার ঝোঁক।বেড়ালের বাচ্চা হোক, কুকুরের বাচ্চা হোক,ওদের দেখলেই ভালো লাগে।
সকালে তখনও শোয়া ছেড়ে  উঠতে পারিনি।শুনতে পার ছিলাম,বাড়ির বাইরের দরজার কাছে,‘মেউ,মেউ’,আওয়াজ!
ঘুম থেকে উঠে বাড়ির গেট গিয়ে খুললাম।দেখলাম,ছোট্ট একটা বিড়াল ছানা--কত বড় হবে?এই এক,দু মাসের বাচ্চা হবে।দেখতে কিন্তু চমৎকার! ধপ ধপে সাদা,পেটের আর মাথার দিকে হালকা খয়েরি রঙের।ওটা আমায় দেখেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে,আবার‘মেউ,মাউ’,করে ডাকতে লাগলো।ধরতে গেলাম।ও কিন্তু পালাল না।বরং আমার দিকে এগিয়ে এলো।কোলে তুলে নিলাম ওটাকে--ঘরের ভিতরে নিয়ে এলাম।ছোট ভাই,বোন দেখে খুব আনন্দ পেল।ওরা বাচ্চাটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।আর বাচ্চাটাও সবার আদর খেতে খেতে,‘মেউ,মেউ’,করে গায়ের লোম ফুলিয়ে সবার গা ঘেঁষে ঘেঁষে ঘুরতে লাগলো।
মনে মনে ঠিক করলাম বাচ্চাটাকে পালি।পালা মানে দু দিন খেতে দিলেই ওটা আমাদের ঘরে থেকে যাবে।কেবল ছোট বলে দেখতে হবে বাড়ির বাইরে চলে টলে না যায়।
মা সকাল বেলা স্নান সেরে এসেই দেখলেন,আমাদের আদিখ্যেতা--মানে বেড়াল ঘাঁটাঘাঁটিতে তখন আমরা খুব ব্যস্ত!মা বলে উঠলেন,‘এটাকে কোথায় পেলি রে?’
আমি ওটা পাওয়ার ফিরিস্তি দিলাম।
মা এসব পালা-পোষার পক্ষপাতী নন।একে তো ঘরে একটা বাড়তি প্রাণী--ঘর নোংরা করা,যেখানে সেখানে পায়খানা,পেচ্ছাপ করে দেওয়া,বেশ কিছুটা ঝঞ্ঝাট তো পোহাতেই হয়!এ সব ভেবেই হয় তো মা বললেন,‘যা যা,ওটাকে বাইরে দিয়ে আয়!তোদের পালার ঝঞ্ঝাটের পর আবার এটাকে পালতে পারবো না।এটাকে এখনি বিদায় কর!’
বোন তখন খুব ছোট,সে আধ আধ বলে উঠলো,‘না,বিদায় না!’
ভাই ক্লাস টুতে পড়ে,সে বলল,‘দেখ না কত সুন্দর ওটা--আমাদের সঙ্গে খেলবে ও!’
মার হাত ধরে আমি আবদারের সঙ্গে বললাম,‘মা,দেখ না,কি সুন্দর দেখতে,আমাদের দিকে তাকিয়ে কেমন ডাকছে দেখো!’
--‘না,না,ও বিদায় করে দাও!’বলে মা আড় চোখে বেড়ালের বাচ্চার দিকে তাকালেন।সোজা সুজি তাকালে যদি মারও পছন্দ হোয়ে যায়,ওটার দিকে মায়া এসে যায়,শেষে সেই দিকধারী সব মাকেই তো পোহাতে হবে!ঠিক এমনি সময় বাচ্চাটা মার পায়ের কাছে এসে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে, ‘মেউ,মেউ’,করতে থাকলো।এবার মাকে বাধ্য হোয়ে বেড়ালের দিকে তাকাতেই হল।ওটার দিকে তাকালেন মা,মার চোখ মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে বাচ্চাটাকে মারও পছন্দ।মা বললেন,‘ওটার খিদে পেয়েছে কিছু খেতে দে!খাওয়া হলে বাইরে ছেড়ে দিয়ে আয়!’
--‘মা,মা,মা’,আমি সে সঙ্গে ভাই,বোন আবদারের সুরে ডাকতে লাগলাম মাকে।
মা তবু বললেন,‘না,না,ওর  গু,মুত কে পরিষ্কার করবে?’
--‘আমি দেখব ওটাকে,মা!আমি ওর গু,মুত পরিষ্কার করবো’,আমি বলে উঠলাম।
--‘তা হলেই হয়েছে’,বলে মা এবার চুপ করে রইলেন।মৌনতা নাকি সম্মতির লক্ষণ--বুঝে নিলাম চুপ থাকার অর্থ হল,ঠিক আছে।
আমাদের আনন্দ আর দেখে কে?বেড়ালের বাচ্চাকে খেতে দিলাম--দুধের সঙ্গে ভাত মেখে দিলাম।এক মুঠো ভাত খেয়ে নিলো,বাকি ভাত পড়ে রইল। বেলা দশটা,এগারটা বাজে তখন,বাবার বাজার যাবার সময় এটা।আমার হঠাৎ মনে পড়ল,আজ বাবার সাথে বাজার যাবার কথা!বাজার যাবার উত্সাহ ও আমার কম নেই--তখন আমার বাজারে যাবার বড় আকর্ষণ ছিল,কতবেল!বাজার গেলেই পাকা কতবেলের খোঁজ করতাম।পেলে আর কথা নেই--আবদার করে বাবাকে দিয়ে কিনিয়ে ছাড়তাম।
সে কতবেল আমি ভেঙে নুন,লঙ্কা,চিনি সহযোগে মাখতাম। ভাই,বোন,আর আমি বেশ মজায় চেটে চেটে খেতাম।মাও বেশ মজা করে খেতেন।কিন্তু বাবা খেতেন না।আমরা ছোটরা ভাবতাম একবার যদি কতবেল মাখা বাবা মুখে ছোঁয়াতেন  তবে তার স্বাদ কতটা তা নিশ্চয় বুঝতে পারতেন!কিন্তু তা হবার নয়,অনেক বলেও বাবার মুখে কতবেল মাখা ছোঁয়ানো গেলো না!
আজ বাবার সঙ্গে বাজার যাবার পালা।কতবেল আনার উত্সাহ একেবারে কম নয়!কিন্তু এই বিড়াল ছানার কি হবে?--নতুন আজই এসেছে আমাদের বাড়িতে--কখন কোন দিকে হাঁটা দেবে কে জানে!ছোট ভাই বোনেরাও এত নজর রাখতে পারবে না জানি--ওরা নিজেদের খেলায় মত্ত হয়ে গেলে আর ওদের কোন দিয়ে নজর থাকবে না।মাকে বলাও বৃথা,সকাল থেকে উঠে রান্না ঘরেই অনেক সময় কাটিইয়ে দেন।এ সব ভেবে আমি এক কাজ করলাম।চার পাঁচ হাত লম্বা একটা রশি নিয়ে বিড়াল ছানার গলায় বাঁধলাম।রশি ধরে টেনে এদিক ওদিক ওটাকে হাঁটিয়ে দেখলাম--গলায় রশি নিয়ে থাকতে ও মোটেই ভালো বাসে না।কিন্তু কি করবো--অন্তত আমার বাজার করে ফিরে আসা পর্যন্ত এক দেড় ঘণ্টা তো বাঁধা থাক!বাঁধা অবস্থায় বারবার,‘মেউ, মেউ’,করছিল,গলার  দড়ি খোলার জন্যে মাথা মোচড়া মুচড়ি করছিল।আমি ওকে তবু জানলার শিকে বেঁধে দিলাম।‘কুঁই কাই’,করছিল খুব--আবার একটু দুধে ভাতে মাখিয়ে এনে ওর মুখের সামনে রাখলাম।
মা রান্নাঘর থেকে অন্য ঘরে যাবার সময় বেড়াল  ছানাকে বাঁধা দেখে বলে উঠলেন,‘বেড়াল  কি গলায় দড়ি বেঁধে পোষা যায়!’
আমি বললাম,‘বাজার থেকে এসেই গলার দড়ি খুলে দেবো।’
বাবার সঙ্গে চলে গেলাম বাজারে।বাজার ঘুরে কতবেল নিয়ে এলাম।ঘরে তখন ঢুকতে পারিনি ছোট ভাই,বোন ঘরের বাইরে ছুটে এসে বলে উঠলো, ‘দাদা,দাদা,বেড়াল বাচ্চাকে না  কুকুরে কামড়েছে--ওটা খুব কাঁদছে!’
আমি তিড়িং করে লাফ দিয়ে ঘরের ভিতরে গিয়ে দেখলাম,সত্যি,বাচ্চাটার কমরের অনেকটা মাংস কুকুরে খুবলে নিয়েছে--ওর সারা গায়ে কাটাকুটি, আঁচরের চিহ্ন।ও উঠতে পারছিলো না--যন্ত্রণায় কেমন যেন গোঙড়াচ্ছিল।
মা,বাবা,ভাই,বোন সবাই এসে দেখল।মা বললেন,এটাকে তো খেয়ে নিচ্ছিল রে!আমি কুকুরের ঘেউ,ঘেউ আর এটার ফোঁসফোঁসানি শুনে বেরিয়ে এসে দেখি যে বড় একটা কুকুর বাচ্চাটাকে কামড়ে ধরেছে,আর এটা,‘ মাউ,মাউ’, করে গুঙড়ে চীত্কার করছে।দড়ি দিয়ে বাঁধা বলে পালাতে পারছে না।
আমি কাঁদো কাঁদো হোয়ে বললাম,‘এটা বাইরে এলো কি করে?’
মা বললেন,‘জানালার শিকে বেঁধে ছিলি--আর জানলা খুলে রেখে গিয়েছিলি,ছানাটা গলার দড়ি নিয়েই জানলাটা পার করে বাইরে চলে গিয়ে ছিল।
বেড়ালের  ছানার কান্না দেখে আমার কান্না পাচ্ছিল।পাশে দাঁড়ানো ভাই, বোনের অবস্থাও তেমনি--মুখে ওদের কান্না কান্না ভাব লেগে আছে।আমি ঘরে রাখা   বরিখ পাউডার এনে ওর গায়ের ক্ষতে  লাগিয়ে দিলাম। কোমরের অনেকটা জাগা নিয়ে মাংস নেই,কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে উঠলাম--‘বাবা,কেমন করে এমন হল!’
বাবা  সব কিছু দেখে গম্ভীর হোয়ে বলে উঠলেন,‘ওটা আর বাঁচবে না--এমন বোকামি করেছিস তুই?’
আমার  নিজের ওপরেই রাগ হচ্ছিল খুব!জালনা কেন আমি বন্ধ করে যাই নি!ওই কুকুরের ওপর ভীষণ,ভীষণ রাগ হচ্ছিল।মনে হচ্ছিল,ওটাকে যদি এখন হাতের কাছে পেতাম,পিটিয়ে মেরে ফেলতাম।
সারাটা দিন কিছুই খেলো না বেড়াল  ছানা।আমার,ভাই-বোনের,মার মুখের দিকে তাকিয়ে করুণ ভাবে কি যেন  বলতে চাইছিল,ও কি কুকুরের বিরুদ্ধে নালিশ  জানাচ্ছিল? নাকি আমার বিরুদ্ধে বলতে চাইছিল,‘কেন তুমি আমায় বাঁধলে?কেন বেঁধে একা আমায় ছেড়ে গেলে?কেনই বা জানলাটা খুলে গেলে?’
রাতে দুধের বাটিতে মুখ দিয়ে চুক চুক দুবার কেবল ওর মুখ ছোঁয়াল।পর দিন সকাল থেকেই চুপচাপ শুয়ে তাকিয়ে থাকলো।ওঠার শক্তি তো আগে থেকেই ছিল না--আজ যেন ও নিস্তেজ  পড়ে আছে!ব্যথার গোঙ্গানিও নেই ওর!শরীরের লোমগুলি মাঝে মাঝে ফুলে ফুলে উঠছিল।
সন্ধ্যে হলে দেখলাম--বিড়াল ছানার শরীরে যেন শ্বাস নেই!আমি ডাকলাম,‘ মিনি!মিনি!’ও তাকাল না--ওর দেহ যেন কেমন টান টান হোয়ে পড়েছিল। ওর গায়ে হাত রাখলাম,ছট ছট করে ওর শরীর দু বার ঝাঁকিয়ে উঠলো--তারপর সব কিছু স্থির হোয়ে গেলো।বিড়াল ছানা মারা গেলো।বুক ঠেলে কান্না উঠতে লাগলো আমার।মা এলেন।তাঁকেও আঁচলে চোখ মুছতে দেখলাম।ভাই বোন দুটো কাঁদছিল।এক সময় আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না।বুকের কান্না যেন প্রচণ্ড হাওয়ার মত বেগে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো,এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম আমি।
এর পর প্রতিজ্ঞা করেছিলাম,আর কোন দিন বিড়াল পুষবো না--সে প্রতিজ্ঞা আজ বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বজায় রেখেছি।
                          

তাপসকিরণ রায়
জবলপুর, মধ্যপ্রদেশ

তাপস কিরণ রায় অর্থশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন। স্কুলে শিক্ষকতা করেন বেশ কিছু বছর। পরে আয়কর বিভাগে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি মধ্য প্রদেশের জবলপুর শহরে বাস করেন। তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করেন। ছোটদের এবং বড়দের জন্য লেখা তাঁর অনেকগুলি বই-ও প্রকাশিত হয়েছে।