খেলাঘরখেলাঘর

আশ্রয়ের খোঁজে

মুখ গোমড়া থমথমে মেঘলা আকাশ থেকে সাত সকালে ঝির ঝিরে বৃষ্টির দুষ্টুমি শুরু হল। মনটা আনন্দে নেচে ওঠে। আর তক্ষুনি মনের আনন্দে মা ভৈরবী তানে গলা সাধত শুরু করে। আমিও মায়ের সুরে সুর মেলানোর চেষ্টা করি, যদিও সেটা বেসুরো হচ্ছে তবুও মা মুচকি হাসি হেসে আমাকে উৎসাহিত করছে। এদিকে বাবাও কখন ঘুম জড়ানো চোখে হেঁড়ে গলায়আমাদের তালে তাল মেলাতে থাকে। মা তান বন্ধ করে হেসে কুটো পাটি! বাবা অপ্রতিভ হয়ে লজ্জা পেয়ে যায়। অভিমানে বলে - "জানি আমার হেঁড়ে গলায় ভালো লাগছে না। তবুও এই সকালের বৃষ্টি ভেজা পরিবেশটা মনটাকে এতো ভালো করে দিল, কখন যেন অজান্তে গেয়ে ফেলেছি বেসুরো গলায়।"
মা হেসে সান্ত্বনা দিয়ে বলে-"কে বলল তুমি হেঁড়ে গলায় গাও! তোমার গলাটা বি-শার্পে যায়। খাদে তোমার গলাটা ভালোই লাগে। ধরো ধরো ---"
অমনি আমরা সবাই এক সঙ্গে গাইতে শুরু করি - "গ্যাঙ্গর-গ্যাঙ্গর-গ্যাঙ ----"
গানের তালে তালে ঝোপের মাথা থাকে বৃষ্টি বিন্দুগুলি ঝরে পড়ছে কচুপাতার উপর। তৈরী হচ্ছে এক অদ্ভুৎ ছন্দ। তারপর ধীর লয়ে বিন্দুগুলি কালচে সবুজ ঘাসের মাথা ছুঁয়ে চুঁইয়ে গড়িয়ে পড়ছে ডোবার জলে। বৃষ্টি ফোঁটাগুলোর ছোট ছোট চক্রাকার জলের বৃত্তগুলো অতিক্রম করে মাকড়সার দৌড় ঝাঁপ এলোমেলো। হঠাৎ করে কালো জলে রুপোলি পুঁটির বিদুৎ ঝলক! সে এক আনন্দ, পুলকের অনুভূতি।

ক্রমশ বৃষ্টির ধারা দ্রুত লয়ে চলতে থাকে। মায়ের তান সমানে দ্রুততর হতে থাকে। তক্ষুনি আমাদের পেছনে বিকট শব্দ! তারপর মুহুর্তের নিস্তব্ধতা। সবাই প্রমাদ গুনছি। আমরা আমাদের জায়গায় নিস্তব্ধ নিথর হয়ে বসে রইলাম।আবারো বিকট শব্দ! চোখের সামনে সব যেন
অন্ধকার দেখি! সম্বিত ফিরে দেখি বিশাল বিশাল আকৃতি মাটির চাঁই উপর থেকে গড়িয়ে গুঁড়িয়ে ঝোপ-জঙ্গল, গাছ-গাছালি, ঘাস-পাতা
সব সবকিছু নস্যাৎ করে পড়ছে ডোবার জলে। ঝপাং করে একটা শব্দ, তারপর ডোবার জল ছলকে ছিটকে পড়ে পাড়ে।

ভ্যাবাচাকা খেয়ে বসে রয়েছি। তক্ষুনি বাবা চিৎকার করে আমাদের সাবধান করে দেয়-"এক মুহুর্ত দেরি নয়। চলো সবাই, উপরে চলো।"

প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে আমরা লাফিয়ে লাফিয়ে দ্রুত থেকে দ্রুততর পাড়ে উঠে আসছি। ফিরে ফিরে দেখতে পাচ্ছি আমাদের পূর্ব পুরুষের ভিটে-মাটি, বসত-বাড়ি সব  একে একে ধুলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে। চাপা পড়ে যাচ্ছে আমাদের এতোদিনের নিশ্চিন্ত ঠিকানা-আমাদের স্মৃতি! মা ঝর ঝর করে কাঁদতে থাকে। বাবা মাকে বোঝানোর চেষ্টা করে -"এখন কাঁদবার সময় নয়, চলো, দ্রুত চলো এখান থেকে।" মা হাঁউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে - "আমরা উদ্বাস্তু হয়ে গেলাম।" বাবা কঠোর দার্শনিকের ভঙ্গিতে বলে-"উদ্বাস্তু! পৃথিবীতে আমরা সবাই উদ্বাস্তু - এবার নতুন কি!"

পাড়ে উঠে এসে দেখি একটা মাটি বোঝাই লরি ডোবার সামনে দাঁড়িয়ে। তার পাশে একটা ঢাউস হোর্ডিং, লেখা আছে - "গ্রীন শেল্টার হাউসিং প্রজেক্ট।" তাকে ছড়িয়ে একটু দূরে রাস্তার ওপারে একটা নালা বৃষ্টির জলে খরস্রোতা। তারপরে যতদুর চোখ যায়শুধু কুয়াচ্ছন্ন আবছা গগণচুম্বি বাক্সঘরের কাঠামো। তার মধ্যে থেকে ঘ্যরর-ঘ্যরর, ঠক-ঠক, ঝনাৎ -ঝনাৎ  যান্ত্রিক শব্দ ভেসে আসছে। এদিকে মাটি বোঝাই লরি থেকে কয়েকটা মানুষ মাথায় ঝুড়ি করে মাটি টেনে ফেলছে ডোবার মধ্যে। মানুষগুলো খুব খুব শয়তান। ওরা ওদের ঘর বানাতে গিয়ে আমাদের ঘর-বাড়ি ধ্বংস করছে আবলিলায়। আমরা যে বড্ড অসহায়। ওরা বড় নিষ্ঠুর। প্রকৃতি এর প্রতিশোধ নেবে একদিন -সবুর করো।

হঠাৎ সেই বৃষ্টি কুয়াশার মধ্যে লরিটা মাটি খালি করে ঘ্যরর - ঘ্যরর শব্দ করে, কালো ধোঁয়া উড়িয়ে, বিটকেল ডিজেলের গন্ধ ছড়িয়ে
দানবের মতো দৌড়ে আসছে আমাদের দিকে! তক্ষুনি বাবা চেঁচিয়ে সাবধান করে আমাকে বলে - "সোনা লাফিয়ে পালাও এক্ষুনি, নালার
পাশের ঝোপে লাফিয়ে পড়। আমরা আসছি তোমার পরেই।"

আমি আমার গায়ের সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে খু-ব জোরে লাফাতে শুরু করি। তিন লাফে অবশেষে ঝোপের মধ্যে পড়লাম। পড়েই প্রমাদ গুনছি।
এমন সময় ঝুপ্ ঝাপ্ শব্দ করে মা-বাবা দুজনে লাফিয়ে এসে পড়ল আমার পাশে। তখন দানবটা বিকট চিৎকার করে দ্রুত বেরিয়ে গেল।

উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা নিয়ে অসহায়ভাবে বসে রয়েছি। কোথায় যাবো, থাকবো কোথায়! মা তখন কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে - "আর এক মুহুর্ত
নয়। চলো পালাই এখান থেকে। ওরা আমাদের মেরে ফেলবে। আর নয়-----"

হঠাৎ দেখতে পাই মাথার ঝোপের মধ্যে একটা হলদেটে লোটকলমির পাতা মাকড়সার জালে দুলছে। আর তক্ষুনি একটা মৃদু দখিনা হাওয়া সঙ্গে
ঝির ঝিরে বৃষ্টির ফোঁটা পাতাটাকে ধাক্কা দিয়ে উড়িয়ে ফেলল নালার জলে। তারপর নালার স্রোতে ঘুরপাক খেয়ে স্রোতের টানে ভেসে চলল। আমারা মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি। নিমেষে নির্বাক হয়ে লাফিয়ে তিনজন চেপে বসলাম পাতাটার উপর।

তারপর কত যে নালা-খন্দ, খাল-বিল, নদী পেরিয়ে কতো অজানা দেশ দেখে অবশেষে আদিগন্ত সবুজ প্রান্তরে এসে পৌঁছলাম। যেদিকে চোখ যায়
শুধু সবুজ আর সবুজ। মাথার উপর নীল আকাশ। পায়ের তলায় ভেজা সবুজ ঘাস। বুক ভরে নিশ্বাস নেই। একটু এগোতেই দেখি কানায় কানায় ভরা একটা ডোবা। পাড়ে গাছ গাছালিতে ভর্তি ঝোপ। ওটাই বুঝি আমাদের নিরাপদ নিশ্চিন্ত আশ্রয়! আমরা এগোচ্ছি, এমন সময় একটা উড়ন্ত দুষ্টু মেঘ আকাশঢেকে কালো ছায়া ফেলে উড়ে গেল উত্তরে। সঙ্গে বৃষ্টি ফোঁটাগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে, আমাদের ভিজিয়ে দিল নিমেষে। স্বস্তির নিঃশ্বাস চলে আসে অজান্তে। মা তখন মেঘমল্লারে তান্ ধরেছে আপন মনে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমি লাফাতে থাকি।  
    

নিধু সর্দার
ভুবনগ্রাম

কাগজে-কলমে গ্রাফিক ডিজাইনার। কিন্তু সে কাজ ছাড়াও ইনি নানা কাজ করেন - মাঝেমধ্যে ইচ্ছামতীর জন্য ছবি আঁকেন, মাঝেমধ্যে ভাল ভাল গল্প লেখেন, আর প্রয়োজন হলেই চাঁদের বুড়িকে নানারকমের সাদাকালো-একঘেয়ে-বিরক্তিকর কাজকর্ম (যেগুলি একটা ব-অ-ড় ওয়েবসাইট চালাতে গেলে করতেই হয়)-সেইসব করতে সাহায্য করেন।