খেলাঘরখেলাঘর

সকালে ঘুম থেকে উঠে মৌটুসি দেখলো আকাশের মুখ ভার। শরতের সেই ঝলমলে সকাল আজ যেন ভ্যানিশ। কালো মেঘে ঢেকে আছে চারপাশ। ছোট্ট মিনিটাও গুটিসুঁটি মেরে পাপোশের ওপর ঘুমোচ্ছে। না হলে এতক্ষণে ম্যাও ম্যাও করে বাড়ি মাথায় তুলতো। স্কুলের টিফিন থেকেও ভাগ দিতে হবে ওকে। সব ঠাম্মার আশকারা। ছোট থেকে এতো মাথায় তুলতে আছে? মাকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না কিন্তু রান্নাঘর থেকে ডিম ভাজার গন্ধ ভেসে আসছে মৌটুসির নাকে। মিনিটাও একবার মাথা তুলে, নাক কুচকে শোঁক শোঁক করে শুঁকে নিল ডিম ভাজার গন্ধ।তারপর গা ঝাড়া দিয়ে চললো সেই দিকে। কিন্তু এতো সবকিছুর মধ্যেও কেন জানি না হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করলো মৌটুসির।

আজ স্কুল ছুটি। কথা ছিলো ফুল ফুল লাল ফ্রকটার সাথে ম্যাচ করা লাল নেলপলিশ কিনতে যাবে। ঠাম্মার দেওয়া ফ্রকটা তার খুব পছন্দের। সবে তো একটা জামা হয়েছে । আর ওবাড়ির টুবলু, মামন, বুবাইয়ের ছয়-সাতটা করে হয়ে গেলো। যদিও এখনো বড়মামা, ফুলপিসি, রাঙাকাকু...গুনতে বসে মৌটুসি। পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী...।

মা তাড়া দেয়। এখনো উঠলো না মেয়েটা।

 মা স্নান করে অফিসে চলে যান। মৌটুসি ব্রাশ করে, পাউরুটি আর ডিম ভাজা খায়। টিভি খুলে দেয়। 'গলি গলি সিম সিম' দেখে। তারমধ্যে জোরে বৃষ্টি নামে। বাজ পড়ার শব্দে ভয় পায় মৌটুসি। মিনিটাও খাটের তলায় ঢোকে। বাড়িতে এখন কেউ নেই। সে আর মিনি ছাড়া। ঠাম্মা গেছে জেঠূর বাড়ি। আর বাবা? সেতো অনেক দেরি আছে আসার। গতবারের পুজোয় বাবা এসেছিলো সপ্তমীর দিন সকালে, ঠিক যখন কলা বউকে স্নান করাতে নিয়ে যাচ্ছিল হরিশকাকা। অনেক দূরের চাকরী বাবার, পাহাড়ের ওপরে। যেখানে বরফ জমে থাকে সারা মাস।বাবা নাকি  অনেক যুদ্ধ করেছে। মা গল্প করে সেসব। যুদ্ধের গল্প শুনতে ভালো লাগে না মৌটুসির। তার থেকে 'টম এন্ড জেরি' দেখে।

আর তো কয়েক দিন পরেই স্কুল ছুটি। তারপরেই হুড়মুড় করে এসে পড়বে পুজো। কি আনন্দ যে হবে। জানলা খুলে দেয় মৌটুসি । বৃষ্টি  ধরে এসেছে। পাশের বাড়ির হাবুদের শিউলি গাছটা জলে ভিজে আরো যেন চনমনে হয়ে উঠেছে। প্রাণ ভরে শিউলি ফুলের গন্ধ নেয় মৌটুসি। হঠাত্‌ দেখে রাস্তার পাশে নর্দমার ধারে তারই মতো একটা ছোট্ট মেয়ে নোংরা ছেঁড়া ভিজে একটা জামা পরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। শুনশান রাস্তায় কাউকে দেখাও যাচ্ছে না। মৌটুসি মেয়েটাকে ডাকে। কিন্তু মেয়েটা শুনতে পায় না। মৌটুসি দরজা খুলে বেরোয়। পেছন পেছন পা টিপে টিপে মিনিও আসে। খুব বকে দেয় মিনিকে। একে রাস্তায় জল, তার ওপর খালি পা...সর্দি হলে? বকা খেয়ে মিনি ঘরে চলে যায়। মৌটুসি এবার মেয়েটার কাছে যায়। একি কাঁদছিস কেন তুই ? কি হয়েছে তোর? মেয়েটা কোনো জবাব দেয় না। শুধু কাঁদে। অনেক পরে মৌটুসি বুঝতে পারে, মেয়েটা কথা বলতে পারে না, শুনতেও পায় না। মেয়েটাকে বাড়ি নিয়ে আসে। ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বার করে খেতে দেয়। মিনি শুধু বিরক্ত হয় ম্যাও ম্যাও করে। লোকজন তার পছন্দ হয় না। কিন্তু মৌটুসি তার নতুন বন্ধুকে খুব যত্ন করে খাওয়ায়। তারপর ভাবতে বসে কি করবে সে। মাকে ফোন করে, পায় না। মোবাইল সুইচড অফ। জেঠূর বাড়ি ফোন বেজে যায়। এবার তাহলে? হঠাত্‌ তার মনে পড়ে কয়েকদিন আগে স্কুলে এসে পুলিশকাকুরা একটা নাম্বার দিয়ে গেছে সবাইকে। বার বার বলেছে মনে রাখতে। কোনো বিপদে পড়লেই সেখানে ফোন করতে।
স্কুলের ব্যাগ খুলে ডায়রী বের করে মৌটুসি। পেয়ে যায় নাম্বারটা। চাইল্ড হেল্প লাইন থেকে কেউ একজন ফোন ধরে। সব কথা গুছিয়ে বলে মৌটুসি । একটা হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে সে তার বাড়িতে এনেছে।

বেলা বাড়তে থাকে। খেলায় মেতে ওঠে দুজন।স্নান করে।কিন্তু এবার কি পড়বে বন্ধু? মৌটুসি দেখে লাল ফুল ফুল ফ্রকটার দিকে মেয়েটা তাকিয়ে আছে। একবার ভাবলো সরিয়ে রাখবে ফ্রকটা। পুরোনো একটা জামা পরতে দেবে। কিন্তু ছি ছি তা কি করে হয়? সামনে তো পুজো। মেয়েটার কি নতুন জামা হয়েছে? আর কোনো কথা ভাবে না মৌটুসি। ঠাম্মার দেওয়া নতুন ফ্রকটা দিয়ে দেয় তার নতুন বন্ধুকে। নতুন ফ্রক পরে মেয়েটা সারা ঘর নেচে নেচে বেড়ায়। ভারী আনন্দ হয় মৌটুসির।

সন্ধ্যের পর বাড়ি ফিরে মা দেখেন পুলিশে পুলিশ। টেলিভিশন চ্যানেলের ক্যামেরাম্যানরা ছোটাছুটি করছে। আর মৌটুসি বসে আছে মিনিকে কোলে নিয়ে নতুন বন্ধু্র সঙ্গে। কিছুক্ষণ আগে সে একটা কান্ড করে ফেলেছে। যে অবন্তীকে তার বাবা-মা সাতদিন ধরে খুঁজে পাচ্ছিলো না... মৌটুসি তাকে খুঁজে ফেলেছে।

অনেক রাতে সবাই বাড়ি ফিরে যাবার পর মৌটুসির মনকেমন করতে লাগলো নতুন বন্ধু আর সেই ফুল ফুল লাল ফ্রকটার জন্য। হঠাত্‌ ফোন বেজে উঠলো ক্রিং ক্রিং ক্রিং। মৌটুসি অন্য দিনের মতো ছুটে ফোন ধরতে গেল না। মিনিকে সে ঘুম পাড়িয়ে দিল। অনেকক্ষণ ফোনে কথা বলার পর মা এলো। মৌটুসিকে দু-গালে চুমু খেয়ে অনেক আদর করলো। তারপর বললো, বাবা এবার মহালয়াতেই বাড়ি চলে আসবে। পাহাড়ে আর যুদ্ধ করতে যাবে না। এখন থেকে সবাই মিলে একসাথে থাকবে। মন খারাপটা হুস করে কোথায় যে উড়ে গেল বুঝতেও পারলো না মৌটুসি। শুধু ওপারে টেমিদের পুকুর থেকে  কোলা ব্যাঙটা ডেকে উঠলো ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ। আর মিনি কোলের মধ্যে শুয়ে চোখ বুঁজে আনন্দে গড় গড় করতে করতে ল্যাজ নাড়তে থাকলো।

 

 

কল্লোল লাহিড়ী

চলচ্চিত্রবিদ্যা বিষয়ে অধ্যাপনা, তথ্যচিত্র নির্মাণ, ফিল্ম ও টেলিভিশন ধারাবাহিকের চিত্রনাট্যরচনা, এবং ফাঁকে ফাঁকে পেলে নিজের ব্লগে নানা স্বাদের লেখালিখি - বিবিধ ধারার ব্যস্ততার মধ্যে চাঁদের বুড়ির সাথে ইচ্ছামতীর প্রথম পায়ে হাঁটার দিনগুলিতে হাত ধরেছিলেন কল্লোল । এখনো সময় পেলে মাঝেমধ্যেই ইচ্ছামতীর জন্য কলম ধরেন হুগলী, উত্তরপাড়া নিবাসী কল্লোল।