খেলাঘরখেলাঘর

রাজকন্যা
 
তিন

রাজকন্যা কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই উধাও হয়ে গেল পরী। চারিদিকে তাকিয়ে দেখল অদ্ভূত কোন এক দেশে এসে পড়েছে সে। কোথাও কিছু নেই। মধ্য গগনে সূর্য। রোদের কী ভয়ানক তেজ আর গরম আঁচ। মাঠ ফুটি ফাটা হয়ে আছে। ধু ধু করছে চারিদিক। মাঝে একটা দুটো লম্বা লম্বা গাছ। তার ছায়াগুলো নীচে মাটিতে পৌঁছনোর আগেই যেন মিলিয়ে গেছে। একটু ছায়ায় বসে যে দু’দন্ড জিরিয়ে নেবে তাও সম্ভব নয়।

এমনিতে খুব সাহসী হলেও সামান্য একটু গা ছম ছম করল রাজকন্যার। এমন একা একা আগে তো কোথাও যায়নি। হঠাৎ-ই একেবারে নতুন একটা দেশে। কেউ কোথাও নেই। তারপরেই তার চোখ পড়ল নিজের বেঁটে খাটো ছায়াটার দিকে। কেমন যেন ওর পায়ে পা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ বন্ধু বন্ধু হাবভাব। নিজেকে আর একা মনে হল না। এই তো ছায়াকন্যা সঙ্গে আছে তার। মনে জোর এলো। ভাবল দেখাই যাক না এই দেশটা কেমন। এই দেশেও নিশ্চয় একটা রাজা আছেন। তাঁকে গিয়ে যদি নিজের পরিচয় দেওয়া যায়, তাহলে তিনি নিশ্চয় রাজকন্যার বাড়ি ফিরে যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করবেন। এখন শুধু রাজপ্রাসাদটা খুঁজে বার করতে পারলেই হল।

হাঁটতে আরম্ভ করল রাজকন্যা। আস্তে আস্তে প্রকৃতি বদলাতে থাকে। গাছের সংখ্যা বাড়তে থাকে। রাজকন্যা হাঁটে আর পাশে পাশে ছায়াকন্যাও হাঁটে। দু বন্ধুতে হেঁটে চলে। ছায়াকন্যার সঙ্গে একা একাই অনেক গল্প করে রাজকন্যা। সূর্য পশ্চিম দিকে একটু একটু করে হেলে পড়ে। ছায়াকন্যাও লম্বায় একটু একটু করে বাড়তে থাকে।

হঠাৎ রাজকন্যা দেখে রাস্তার ধারে একটা ছোট কাঁটা গাছ লাল লাল ফলে ভরে আছে। ফল থেকে টুপটাপ রস গড়িয়ে পড়ছে। তার গায়ে বড় বড় হুলওয়ালা পোকাতে ছেয়ে গেছে। গাছটার ফল খেয়ে নষ্ট করে ফেলছে। গাছের গায়েও বড় বড় গর্ত করে ফেলেছে। গাছটা প্রায় মরে যায় যায় অবস্থা। ওর দেখে খুব মায়া হল। ও সব পোকা একটা একটা করে ধরে ধরে মেরে ফেলল। তারপর গাছটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল - আমি সব পোকা মেরে দিয়েছি। আর তোমার কষ্ট হবে না।
গাছটা বলল - তুমি আমার অনেক উপকার করেছ। তাই আমার উপহার হিসেবে এই গাছের একটা ফুল নিয়ে যাও সঙ্গে। এই ফুলের ঘায়ে যে কেউ মূর্ছা যেতে পারে। আবার মূর্ছা যাওয়া লোকের জ্ঞানও ফিরে আসতে পারে। কিন্তু শুধু তোমার হাতে থাকলেই এই মূর্ছাফুল কাজ করবে।
রাজকন্যা গাছ থেকে একটা ছোট্ট সাদা ফুল তুলে নিয়ে সযত্নে তার জামার পকেটে রেখে দিল। তারপর গাছকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল।

কিছুদূর গিয়ে শোনে পাখিরা খুব কিচির মিচির করছে। কি হল কি হল। দেখে একটা বিশাল সাপ এক পাখির বাসায় ডিম খেতে উঠেছে। রাজকন্যা সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে মূর্ছাফুল বার করে ঠেকিয়ে দিলো সাপের গায়ে। সাপটা চোখের নিমেষে অজ্ঞান হয়ে গাছ থেকে পড়ে গেল। তখন পাখিরা জ্ঞ্যানহীন সাপটাকে অনেক দূরের এক জঙ্গলে ফেলে এলো। ডিম বাঁচানোর জন্যে পাখিরা ওকে উপহার দিল একটা অপূর্ব সুন্দর পাখির পালক। একদিকে তার রামধনু রঙ আর অন্যদিকে আকাশের মতো নীল।  বলল - এই মুশকিল আসান পালক সব সময় তোমার কাছে রেখ। তুমি যেমন আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করলে তেমন এই পালকও তোমায় সব বিপদ থেকে রক্ষা করবে।

রাজকন্যা পালক নিয়ে, পাখিদের ধন্যবাদ দিয়ে আবার চলতে শুরু করে। বিকেল প্রায় শেষ হতে চলেছে। ছায়াকন্যা লম্বা হতে হতে এতটা লম্বা হয়ে গেছে যে তার মাথাটাই ভালো করে দেখা যাচ্ছে না এখন। অনেক দূরে দূরে কিছু ছোট বড় পাহাড় দেখা যাচ্ছে। পায়ের নীচে সবুজ ঘাসে ভরা মাঠ। আবহাওয়া এখন অনেকটা মনোরম। কিন্তু রাজপ্রাসাদ তো দূরের কথা। কোন বাড়ি বা মানুষের কোন চিহ্নও নজরে পড়ছে না। রাজকন্যা আর বিশাল লম্বা ছায়াকন্যা হেঁটে চলেছে তো চলেছেই। তারপর একসময় টুপ করে সূর্য ডুবে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেল ছায়াকন্যা। রাজকন্যার তখন খুব একা লাগল। হাঁটতে একটুও ইচ্ছে করল না। ক্লান্ত অবসন্ন দেহে শুয়ে পড়ল মাটিতে ঘাসের ওপর।

চার

না জানি কতক্ষন ঘুমিয়ে রইল সে। যখন ঘুম ভাঙ্গলো দেখলো ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। তারা ভরা আকাশ। আকাশে থালার মতো একটা বিশাল গোল চাঁদ। জ্যোৎস্নার মধ্যে মাঠের নরম ঘাসে শুয়ে থাকতে কী ভালোই না লাগছিল। রাজকন্যা অবাক হয়ে ভাবল যে সে রাজকন্যা হয়ে সোনার পালঙ্ক আর মখমলের বিছানা ছেড়ে এই মাটিতে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়ল? শরীরে তাহলে সত্যিই সব সয়ে যায়। একদম ঠিক কথা বলে লোকে। শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়। শুধু যদি খিদে আর তেষ্টাটা না থাকত তাহলে আরো খানিকক্ষন আরামে ঘুমাতে পারত সে। একটু জল না খেলে শরীর আর বইছে না। কিন্তু এত রাত্রে কোথায় জল খুঁজবে। তেষ্টাতে গলাটা এত শুকিয়ে গেছে যে মনে হচ্ছে এইবার বোধহয় মরেই যাবে।
ঠিক তখনই ওর পকেট থেকে সেই মুশকিল আসান পালকটা বেরিয়ে রামধনু রঙের আলোর অক্ষরে হাওয়াতে লিখে দিল – ‘যে সয় সে রয়।’
বেশ কয়েকবার নিজের মনে কথাগুলো বলতেই কথাটার মানে বুঝতে পারল রাজকন্যা। পালক বলতে চাইছে এখন সে কষ্ট সহ্য করতে পারলে তবেই প্রানে বেঁচে থাকবে। তাছাড়া অন্য কোন উপায়ও নেই। শরীরকে বলল – ‘শরীর মহাশয়, একটু কষ্ট সহ্য করো। চল, জলের সন্ধানে আবার হাঁটতে শুরু করি।’

শুরু করল হাঁটা। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দেখে ছোট্ট একটা বোতল তার পাশে পাশে লাফিয়ে লাফিয়ে চলেছে। রাজকন্যা খুব অবাক হয়ে গেল। নিচু হয়ে বসে বোতলটা হাতে নিয়ে দেখল ভেতরে একটা ছায়া ছায়া মত কিছু। তার চোখ দুটো জোনাকীর মতো জ্বলছে আর নিভছে। চিঁ চিঁ করে কি সব কথাও বলছে সে। ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না। কানের কাছে বোতলটা নিয়ে আসতেই শুনতে পেল তার কথা - দয়া করে, আমায় বোতল থেকে মুক্ত করে দাও। তুমি যা বলবে আমি তাই শুনবো।
- কিন্তু তুমি কে? বোতলের ভেতর তোমায় কে ঢোকালো?
- আমি সব বলব। তুমি আগে আমায় বার করো।
রাজকন্যা তাড়াতাড়ি বোতলের ছিপিটা খুলে দিলো। ছায়ামূর্তি বোতল থেকে বেরিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর আড়মোড়া ভেঙ্গে বলল
- তিন দিন ধরে আমি বোতল বন্দী হয়ে আছি। বোতলের মধ্যে দুমড়ে মুচড়ে বসে থাকতে থাকতে আমার গায়েহাতে ব্যাথা হয়ে গেছে। ভাগ্যিস তোমার দেখা পেলাম। তুমি যে আমার কতো উপকার করলে তা বলার নয়। এখন থেকে তুমি যা বলবে আমি তাই শুনবো।
- তুমি কে? তোমার নাম কি?
- আমার নাম ফিসফিস। আমি একটা মেছোভূত। আগে ছিলাম মাছধরা জেলে। মছলী দ্বীপে থাকতাম। এক দুষ্টু ডাইনী আমাদের দ্বীপটা দখল করে নিয়ে আমাদের সবাইকে মন্ত্রবলে মেছোভূত বানিয়ে দিয়েছে।
- এখন তাহলে থাকো কোথায়?
- সেই ডাইনী আমাদের একটা রাজপ্রাসাদে থাকতে দিয়েছে।
- কিন্তু তোমায় বোতলে ঢোকালো কে?
- আমাদের সর্দার নিশপিশ। আমি কাজে ফাঁকি দিয়ে একটু জ্যোৎস্নাতে ভিজছিলাম। তাতে রেগে আগুন তেলে বেগুন হয়ে আমাকে বোতল-বন্দী করে ছুঁড়ে একেবারে রাজ্যের বাইরে বার করে দিলো।
বলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল ফিসফিস।
রাজকন্যা আবার এই কান্না ব্যাপারটা একেবারে সহ্য করতে পারে না। বলল
- কেঁদো না। তুমি আমার সব কথা শুনে চললে আমি নিশপিশকে সরিয়ে তোমায় দলের সর্দার করে দেব। কিন্তু আগে আমায় তোমাদের রাজপ্রাসাদে নিয়ে চল। তেষ্টায় প্রান গেল আমার।

ফিসফিস ওকে কাঁধে চাপিয়ে চোখের নিমেষে চলে এল রাজপ্রাসাদে। শ্বেত পাথরের বিশাল প্রাসাদ। চাঁদের আলোয় চকচক করছে। চারিদিকে উঁচু প্রাচীর। সামনে বিশাল গেট। কোথাও কোন আলো জ্বলছে না। শুকনো পাতা পড়ে বিশ্রী নোংরা হয়ে আছে। সামনে একটা জলে ভরা বিশাল সরোবর। সেখানে পেট ভরে জল খেয়ে রাজকন্যা শরীরে প্রান ফিরে এল। তারপর ফিসফিসকে বলল
- চলো রাজপ্রাসাদের ভেতরে যাই। খিদেতে পেট চুঁইচুঁই করছে। জলদি আমায় কিছু খেতে দাও।
শুনেই খুব ভয় পেয়ে গেল ফিসফিস - আমি যাব না ভেতরে। আমায় দেখতে পেলে সর্দার খুব রেগে যাবে। বরং তুমি একটা মাছ খাও।
চোখের নিমেষে সরোবর থেকে একটা মাছ ধরে এনে দিল। কিন্তু রাজকন্যা কাঁচামাছ দেখেই আঁতকে উঠলো – ইস, এমন কাঁচা মাছ কী করে খাব?
- আমরা তো রোজ এই খাই।
- আমি কী তোমার মত মেছোভূত নাকি?
তখন ফিসফিস রাজপ্রাসাদের কলাবাগান থেকেই অনেকগুলো কলা পেড়ে এনে দিল। রাজকন্যার কলা খেতে একেবারেই ভাল লাগে না। কলা আবার খাবার মত একটা ফল হল। কিন্তু এত খিদে পেয়েছিল কী আর করে। শরীরকে বলল – ‘ওহে শরীর মহাশয়, সওয়াতে যখন হবেই তখন একটু সয়ে নিন। আর কোন খাবার জুটছে না এখন। কলা-ই খান পেটভরে।’ বলেই সব কটা কলা গপাগপ খেয়ে নিল। খেতে খেতে ভাবল কলাটা আসলে অতটা খারাপ খাবার নয় যতটা সে আগে ভাবত।