বাড়ির সামনের স্টেশনটায় সারাদিনে খুব বেশি ট্রেন যায় না। যখন ট্রেন আসে, আমি গুমগুম শব্দ শুনি, আমি ছুট্টে চলে যাই স্টেশনটায়। প্লাটর্ফম দিয়ে হাঁটি। জটলা হয়ে থাকে জানলা গুলোর সামনেটায়। সবাই যাচ্ছে এখানে-ওখানে আমার বয়েসি কত ছেলে মেয়েও তো আছে ওদের দলে। তাদের ছাড়তে এসেছে বাড়ির লোক। সবাই চিতকার করছে নিজের নিজের বাড়ির মানুষের জন্য। সাবধানে যাস সোনাই...পৌঁছে ফোন করিস...অচেনা লোকের কাছ থেকে কিছু খাস না...হটপটটার মধ্যে মাংস আছে...আর ফয়েলে হাতে গড়া রুটি...গরম গরম খেয়ে নিস...বেশি রাত করিস না...তিন্নি দার্জিলিংয়ে এখন খুব শীত, সন্ধ্যের পর আর বাইরে বেরোবার দরকার নেই ঠান্ডা লেগে যাবে...তোমার টনসিলের দোষ আছে রাজ, পাহাড়ে গিয়ে আইসক্রিম একদম খাবে না বলে দিলাম...আর হ্যাঁ,ক্যামেরাটা সাবধানে রেখো, দামি জিনিস ভেঙে ফেলো না যেন...বনি জলদাপাড়ায় হাতির পিঠে চেপে যখন যাবে জঙ্গলে ঘুরতে,তখন গন্ডার দেখতে পাবেই, ফোটো তুলে রাখতে ভুলো না...চাপড়ামারির বাংলোটা খুব ভাল, এখন খুব ভাল ওয়েদার পাবে, ওখানকার কুকটার হাতের যা রান্না না দুর্দান্ত...বুঝলি তিতির পূর্ণিমার রাতে ওয়াচটাওয়ারে বসে রুপোলি রঙের মূর্তি নদী আর তার পাশের ছমছমে কালচে সবুজ গরুমারা জঙ্গল দেখবি যখন তখন বুঝবি কাকে বলে সৌন্দর্য...।
বাবা এখানকার স্টেশনবাবু। ছোট্ট স্টেশনের অফিস ঘরে বসে। ঘরটা আমাদের জন্মের আগে একবার চুনকাম করা হয়েছিল, তারপর আর বোধহয় রং হয়নি। দিনের বেলাতেই ঘরটা কেমন অন্ধকার ম্যাটম্যাটে। বাবার মাথার পেছনে বিরাট সাইজের একটা ঘড়ি। ওপরে ঘটাং ঘটাং করে একটা ফ্যান চলে সারাদিন। মাকড়সার জালে আর ঝুলে ফ্যানটা কালচে হয়ে গেছে। কেউ পরিষ্কার করার নেই। কখনও কখনও আমায় স্টেশনে ঘুরে বেড়াতে দেখে অবাক হয়ে বাবা বলে, ঝালং তুই ফাঁক পেলেই স্টেশনে চলে আসিস কেন রে? তোর পড়াশুনো নেই! খবরের কাগজে যে দেয় দেখিস না-দিনকাল খুব খারাপ কিন্তু এখন। কোন দিন তোকে ছেলে ধরা তুলে নিয়ে চলে যাবে-তারপর পাচার করে দেবে অন্য রাজ্যে, তখন মজাটা টের পাবি। ভিক্ষে করে খেতে হবে তারপর। ভাল-মা বিরক্ত হয়ে বলে এমন উড়ন চন্ডী মেয়ে জন্মে দেখিনি বাবা! লেখা নেই পড়া নেই সারাদিন শুধু টোটো কোম্পানি!আমি লজ্জা পাই। চুপ করে থাকি।
আমি যে কেনো স্টেশনে আসি, ঘুরে ঘুরে বেড়াই ট্রেনের পাশ দিয়ে-সেটা অবশ্য কাউকে বলা যাবে না। এমনকি বাবাকেও না। ট্রেনে করে যারা ঘুরতে যায় সেই ছেলে মেয়েগুলোর সঙ্গে সঙ্গে আমিও যে একছুট্টে চলে যাই দার্জিলিংয়ের ম্যালে পেস্তা দেওয়া আইসক্রীম খেতে খেতে তাকিয়ে থাকি পশ্চিম দিকের পাহাড়ের আড়লে কমলা রঙের বিরাট উলের বলটার দিকে। তিতির, তিন্নি, সোনাই, রাজ, বনিদের সঙ্গে সঙ্গে আমিও বেড়াতে চলে যাই কালিম্পং, লাভা, লোলেগাঁওয়ের পাহাড়ে। কখনও হারিয়ে যাই জলদাপাড়ার সবুজ শাল, সেগুন, মাদার,ডুমুর, অর্জুন,লালি আর দুধে-লালির ভিড়ে। হাতির দল নুন খতে আসে যে রাস্তা দিয়ে সেই চাপড়ামারির গা ছমছম পথে ঘুরে বেড়াই ক্যামেরা হাতে। তারপর গরুমারার গহীন বনের মধ্যে শিরশিরিয়ে বয়ে যাওয়া মূর্তি নদীর ঠান্ডা হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে থাকি আমি, রাজ, বনি, তিন্নি, সোনাই আর তিতির।
মাঝে মাঝে কোথায় যাই জানো, ঝালংয়ে। কি সবুজ যে সেই জায়গাটা না দেখলে বুঝতে পারবে না। নদীর ধারে একটা জায়গা আছে খুব সুন্দর। কতরকম পাখি যে ডাকে, আর কি অদ্ভুত তাদের ডাক যে আমরা কান পেতে শুনি,তাদের কিচিরমিচির। রোদের তেজ থাকে না বেশি, তবুও ছোট্ট একটা ছবির মতো পাহাড় দাঁড়িয়ে থেকে ছায়া দেয় আমাদের। বন্ধুরা যখন খেলতে থাকে, তখন আমায় দেখে মেঘের কাপড় সরিয়ে আকাশ থেকে নেমে আসে মা। আরে না ভাল-মা নয়, আমার নিজের মা। একমাত্র এই ঝালংয়ে এলেই দেখা হয় মায়ের সঙ্গে। ফিনফিনে জরির মতো পাহাড়ি নদীটার পাশে আমরা বসে থাকি চুপচাপ। মা একটা জাফরানি রঙের সিল্কের শাড়ি পরে থাকে বেশিরভাগ দিন। মায়ের চোখে ছায়া পড়ে ঝালং পাহাড়ের। মায়ের গায়ের করবীফুলের গন্ধটা স্পষ্ট নাকে আসে আমার। কেউ কোন কথা বলি না আমরা মা-মেয়েতে। দু'জনে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকি দু'জনের দিকে। তাছাড়া কথা বলার দরকার কী, চোখ যখন কথা বলে তখন কি আর শব্দের দরকার হয়, বলো!
জলপাইগুড়ির বাসিন্দা মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের স্কুলে পড়ার সময় থেকেই লেখালিখিতে হাতেখড়ি। পেশায় সরকারি চাকুরে মৃগাঙ্ক নিয়মিত বিভিন্ন প্রতিষ্টিত এবং স্বল্প পরিচিত কাগুজে পত্রিকায় এবং ওয়েব ম্যাগাজিনে বড়দের এবং ছোটদের জন্য গল্প এবং ভ্রমণকাহিনী লেখেন। লেখালিখির পাশাপাশি সুযোগ পেলেই ক্রিকেট ব্যাট হাতে মাঠে নেমে পড়েন মৃগাঙ্ক।