খেলাঘরখেলাঘর

লালকন্ঠের স্বপ্নপূরণ

লালকন্ঠ সারসের মন মেজাজ বেজায় খারাপ। সেই শীতের শুরুতে যখন উত্তুরে হাওয়া বইতে শুরু করেছে একটু একটু করে, আর তার দুধ সাদা পালকের ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝেই কনকনিয়ে দিচ্ছে শরীর, তখন সাত-তাড়াতাড়ি করে উড়ে চলে এল দক্ষিনে। দক্ষিনের দিকে শীত কম, রোদ্দুর বেশি। লালকন্ঠ প্রত্যেকবারই শীতে উড়ে আসে দক্ষিন দিকে। এটাই তো নিয়ম। কোন কোন বার কোন দলের সঙ্গে, কখনো আবার একা। আবার শীত শেষ হলে উড়ে যায় উত্তরে। তখন আবার দক্ষিনে বড় বেশী গরম।

প্রত্যেকবারের মত, এবারো লালকন্ঠ এসে নেমেছে পূবদিকের এক মস্ত বড় শহরের চিড়িয়াখানায়। তার যে সব বন্ধুরা সাথে উড়ছিল, তারা অবশ্য আরো খানিকটা এগিয়ে নামবে অন্য একটা বড় ঝিলে। কিন্তু লালকন্ঠের এই চিড়িয়াখানাটাই পছন্দ। মাঝখানে একটা ছোটখাটো ঝিল আছে। সেখানে অন্যান্য দেশ থেকে উড়ে আসা আরো পাখিদের সাথে দেখা হয়। উপরি পাওনা অন্যান্য জন্তুরা। গতবছর হাতি পার্বতীর একটা ছোট বাচ্চা হতে দেখে গেছিল। একবছরে নিশ্চয় অনেকটা বড় হয়ে গেছে। চিড়িয়াখানার হরিণদের সাথে লালকন্ঠের ভালো আলাপ আছে। নানারকম হরিণের মধ্যে বুড়ো সম্বর হরিণ বিষ্ণুর সাথে লালকন্ঠের ভালো বন্ধুত্ব। দুজনে বসে নানারকম সুখ-দুঃখের গল্প হয়। বিষ্ণুর জন্ম হয়েছিল এই চিড়িয়াখানাতেই। সত্যিকারের জঙ্গল, খোলা মাঠ বা বিশাল নদী, কিছুই দেখেনি সে। তাই লালকন্ঠের কাছ থেকে দেশ - বিদেশের গল্প শুনতে ভালবাসে সে। দুজনে সারা দুপুর রোদের ওমে ঘুরে -ফিরে বকর বকর করে, মাঝে মাঝে বিষ্ণুর বরাদ্দ ছোলাও খায় লালকন্ঠ।

এইসব ভেবেই এবারো অন্য সঙ্গীদের ছেড়ে এখানে নেমে পড়া। কিন্তু নেমে ইস্তক মন খারাপ হয়ে আছে। চিড়িয়াখানার দিকে আর তাকানো যায়না। চারদিক ধুলোয় ধুলোময়, অপরিচ্ছন্ন। মাঝে অত সুন্দর ঝিল, যার পাড়ে খাবার খুঁজতে খুঁজতে বিদেশী পাখিদের সাথে কাটিয়ে দেওয়া যেত সারা দুপুর, মাঝে মাঝে স্নান ও করা যেত, সেটা ঢেকে আছে শ্যাওলা আর দামে। সব থেকে নোংরা হয়ে আছে খাঁচাগুলির মাঝে মাঝে ছড়িয়ে থাকা খোলা লন এবং মাঠ। কাগজের টুকরো, পলিথিনের প্যাকেট, খালি জলের বোতল, সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারিদিকে। এত নোংরা কারোর ভালো লাগে !! মানুষগুলো যেন কিরকম। এদিকে তো নিজেরা দিব্বি ঝকঝকে পোষাক পড়ে ঘুরছে, খাচ্ছে, খেলছে...এই চিড়িয়াখানা তো ওদেরি জন্য। অথচ, দেখো, একবার - নিজেদের জিনিষ কে সুন্দর রাখার কোন চেষ্টাই নেই। একেই তো শহরের হাওয়ায় এত ধুলো-ময়লা যে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। একটু উড়লেই দম নিতে কষ্ট হয়। তার ওপর যদি থাকার জায়গাটা এত খারাপ হয়, তাহলে কারো মন -মেজাজ ঠিক থাকে?

লালকন্ঠের সঙ্গীরা এই অবস্থার খবর আগেই পেয়ে গেছিল। তাই ওরা আর এখানে নামেনি। ওদের মধ্যে কেউ কেউ তো আরো দক্ষিনে সেই সুন্দরবনে চলে যাবে। ওরা তো তাকে বারন ও করেছিল। কিন্তু সে-ই কোন কথা না শুনে নেমে পড়ল।

এবার অন্য দেশ থেকেও এখানে অনেক কম পাখী এসেছে। কয়েকবছর আগে অবধি জলের ধারের ঘাসজমিতে পা ফেলার জায়গা পাওয়া যেত না। খাবার নিয়ে মাঝে মাঝে ঝগড়া লেগে যেত। এবার তো কেউ আসেই নি। লালকন্ঠ গুনে দেখেছে জনা পনেরো মত বিদেশী অতিথি আছে।

ভোরবেলা ঘুম ভেঙ্গে বিষ্ণুর সঙ্গে এইসব নিয়েই কথা হচ্ছিল লালকন্ঠের। সকালের নরম রোদে বেশ আরাম আরাম লাগছে...কিন্তু গা ঝাড়া দিয়ে উঠল লালকন্ঠ। এখনো চিড়িয়াখানার দরজা খোলা হয়নি। এই সময়টা এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানো যায়। যখন চিড়িয়াখানায় ভিড় হয়ে যায়, তখন সে ঝিলের ঘেরা নীচু পাঁচিলের ভেতরেই ঘোরাফেরা করে। পার্বতীর মেয়ে রাধা কে একবার দেখে এলে হয়। খুব মজাদার হয়েছে বাচ্চাটা। ওদের থাকার খোলা জায়গাটায় মায়ের সাথে সাথে ঘুরে বেড়ায়। ছোট্ট শূঁড় দিয়ে একটা পুরোনো গাছের গুঁড়িকে ঠেলার চেষ্টা করে। বড় বড় পা ফেলে, খানিক উড়ে, খানিক হেঁটে, হাতিদের ঘেরা মাঠের দিকে পা বাড়াল লালকন্ঠ। যাওয়ার পথে পড়ল জিরাফের থাকার জায়গা। ঘেরা জায়গার মধ্যে বড় গাছটার পাতা ভেঙ্গে , বউ-বাচ্চা নিয়ে জিরাফ জ্যাক সকালবেলার জলখাবার খাচ্ছে। দাঁড়িয়ে একটু কুশল বিনিময় হল দুজনের। জ্যাক একটু চুপচাপ থাকে। তবে মন ভালো থাকলে ওর কাছ থেকে ভালো ভালো গল্প শুনতে পাওয়া যায়। সেই কোন দূর মহাদেশ আফ্রিকা থেকে কাঠের বাক্সে বন্দী করে ওকে নিয়ে এসেছিল এখানে। ওর পরে এসেছে ওর সঙ্গিনী জিল। ওদের একটা তুরতুরে বাচ্চা হয়েছে। সেই ছোট্ট জনি এখনো বাবার মত লম্বা হয়নি, তাই তার মা উঁচু ডাল থেকে পাতা ভেঙ্গে ভেঙ্গে তাকে খেতে দিচ্ছে।

সাদা বাঘ শক্তির খাঁচার সামনে গিয়ে দাঁড়াল লালকন্ঠ। এক বছর আগেও শক্তিকে ছোট ছেলেই বলা যেত। কিন্তু এখন শক্তির চেহারা বিশাল - একদম বড়সড় হয়ে গেছে সে। খুব রাগিও হয়েছে। খাঁচায় বন্দি থাকতে একদম ভালো লাগে না তার। পাশের খাঁচার বুড়ো বাঘ পরম-এর কাছ থেকে সুন্দরবনের গল্প শুনেছে সে। তাই সে সুন্দরবনে যেতে চায়, যেখানে বাঘেরা স্বাধীন। রাজার চালে খাঁচার পরিসরের ভিতর পায়চারি করছে শক্তি। লালকন্ঠকে দেখে বড় বড় চোখে তাকালো একবার। তারপর ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে আবার উল্টোদিকে চলে গেল। লালকন্ঠ আর দাঁড়াল ণা। কে জানে বাবা, কোনদিন বাগে পেলে হয়ত তার ঘাড়েই না হালুম করে এসে পড়ে!

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।