খেলাঘরখেলাঘর

তিতলি আর মিনি
 

তিতলির খুব মনখারাপ। আজ নিয়ে তিনদিন হল, মিনির সঙ্গে দেখা হয় নি।

মাম অফিস যাবার আগে রোজ ডাইনিং টেবিলের ওপর দুধ-ভাত রেখে যায়, যেমনকার তেমন পড়ে থাকে .. মিনি আসে না। হয়ত মিনির আর দুধভাত খেতে ইচ্ছে করে না। তাই রোজ এসে না খেয়ে ফিরে যায়। স্কুলে গিয়েও মন বসে না তিতলির। স্কুলবাসে যাবার সময় জানলা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে খোঁজে রোজ, কোথথাও নেই মিনি।
কোথায় বিপদে পড়ল মিনি!
রাতে ঘুমোতে যাবার আগে বাবা রোজ গল্প বলে। বাবা যে কি ভালো ভালো গল্প বলতে পারে! জন্তু-জানোয়ার, ভুতপ্রেত, সুন্দরী রাজকন্যা, সোনার কাঠি রূপোর কাঠি, দত্যিদানো, অসমসাহসিক সব অভিযান, ক্যাসাবিয়াঙ্কা, সিন্ডারেলা .. বাবা গল্প শুরু করলে তিতলির আর কোনোদিকে মন থাকে না। কাল বারবার গল্প থামিয়ে মিনির কথা জিজ্ঞেস করেছে তিতলি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই এক্কেবারে প্রথম যার কথা মনে হয়েছে, সে মিনি।
কি যে হল মিনির! কোথায় গেল!
রাস্তায় বেরোলেই তো কত গাড়ি। তাছাড়া বুবলিদের ব্লকটা পেরোলেই সারি সারি গ্যারেজ .. সেখানে ক’দিন ধরে তিন-চারটে রাস্তার কুকুর এসে আছে। মাম বলে,‘খবরদার ওদিকে যাবি না তিতলি। কুকুর কামড়ালেই ইঞ্জেকশন নিতে হবে কিন্তু।‘
মিনির তো মা নেই। কে বলে দেবে ওকে? তা হলে কি রাস্তার কুকুরগুলোই মিনিকে!
না না, ছোট্ট মাথাটা ঝাঁকিয়ে নিল তিতলি। মিনির খুব বুদ্ধি। ওকে কুকুরগুলো ধরতেই পারবে না।
তা হলে কি মিনির শরীর খারাপ হল! আজ কাল রোজ এবাড়ি সেবাড়ি খেয়ে বেড়াচ্ছে মিনি । সেভেন-বির আন্টি বলছিলেন মাকে, ‘কি যে বাজে স্বভাব হয়েছে মিনির, একটা জিনিস রাখার উপায় নেই।‘
ইলেভেন-সির আন্টিও বলছিলেন, মিনি নাকি ওঁদের সব মাছগুলো খেয়ে নিয়েছে।
ঋষির মা গরম দুধ নামিয়ে ঋষিকে স্কুলবাসে তুলতে গেছেন, এসে দেখেন মিনি সেই গরম দুধে মুখ দিয়েছে। খেতেও পারে নি, ছ্যাঁকা লেগে পালিয়েছে, দুধ ছত্রাকার। এক ডেকচি দুধ ফেলে দিতে হল।
মাম বলছিল বাবাকে,‘মিনিটা তো এমন ছিল না। খাবার সময় যা দেওয়া হত, তাই খেত সোনামুখ করে। তারপর একটা নিরিবিলি গরম জায়গা দেখে শুয়ে থাকত। এদিকে বাড়িতে রোজ দুধ-ভাত পড়ে থাকছে, আর লোকের বাড়ি বাড়ি চুরি করে খাচ্ছে। এমন তো ছিল না মিনি।‘
বাবা বলল, ‘স্বভাব যাবে কোথায়!’
বাবা যা-ই বলুক, তিতলিও দেখেছে মিনি কক্ষনো চুরি করে খেত না । এমনকি নেংটি ইঁদুর ধরেও খায় নি কোনোদিন । সামনে পেলেও ইঁদুরদের তাড়া করত না । তিতলি নিজে দেখেছে ।
সেই সেবারের ঝড়ে সামনের বড়ো গাছ থেকে পাখির বাসা পড়ে গেছিল নিচে, তবু মিনি পাখির বাচ্চাগুলোকে ধরে নি। বরং নিজেই সারারাত একটা সরু ডালে বসে ভয়ে খিদেয় মিউমিউ করে ডেকেছিল । সকাল বেলায় দুধ দিতে এসে রামরতনচাচা দেখতে পেয়ে নামিয়ে আনল, তবে দুধ খেল মিনি ।
এমন লক্ষী মিনি বাড়ি বাড়ি ঢুকে সব খেয়ে নিচ্ছে!

যেমন সুন্দর দেখতে, তেমন মিষ্টি স্বভাব মিনির । সাদা খয়েরি ডোরা-কাটা গা, লাল লাল পুঁতির মতো চোখ, এই মোটা ল্যাজ । সারাদিন নিজের গা চেটে চেটে পরিষ্কার করে । খিদে পেলে মিউমিউ করে মায়ের পায়ে পায়ে ঘোরে । রোজ সকালে মামের সঙ্গে চা বিস্কুট খায় । চায়ে ভিজিয়ে নরম বিস্কুট খাইয়েছে তিতলিও।
মাম সেন্টার টেবিলে চায়ের কাপ রাখলেই মিনি এসে পড়বে । অমনি বাবা বলবে,‘ওই এলেন তিনি ! চায়ের নেশা হয়েছে দ্যাখো!’
ঠাম্মা বলত,‘দুধ মাছ রুটি সব খাচ্ছে, আবার চা ! মুখের কাছে খাবার পেলে কে আর কষ্ট করে ইঁদুর ধরবে বল্‌ ?’
ঠাম্মা এসেছিল যখন, মিনি একদিনও সোফায় উঠে ঘুমোতে যায় নি । কি বুদ্ধি ! জানে, ঠাম্মা রাগ করবে । কিন্তু মিনি তো চুরি করে খায় নি কোনোদিন । সবাই এত চুরির বদনাম দিচ্ছে বলেই কি দুঃখ পেয়ে চলে গেল মিনি !
মিনির সঙ্গে দেখা হলে তবে না জিজ্ঞেস করবে তিতলি !
বুবলি মোহর পিকলু ঋষি এই নিয়ে খুব হাসাহাসিও করছে । ‘কি রে তিতলি ? তোর মিনি তোকে ছেড়ে পালিয়ে গেছে ?’
সে তো করবেই । মিনিকে নিয়ে কম হিংসে ছিল ওদের !

কোথা থেকে এসেছিল মিনি কে জানে, ওর বাবা মা কেউ ছিল না, একদিন রাতের বেলায় এসে তিতলিদের সিঁড়ির কাছে শুয়েছিল । মর্নিং ওয়াকে যাবার সময় বাবা দেখতে পেয়েছিল প্রথম । তিতলিকে ডেকে দেখিয়েছিল । তখন তিতলি ওকে নিয়ে এল বাড়িতে । মাম দুধ খেতে দিল । সেই থেকে মিনি তিতলির বন্ধু ।
পিকলুরা কত চেষ্টা করেছে ওকে নিয়ে যেতে । সুমি নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়ে দোলনায় বসিয়ে কত দোল দিয়েছে, যাতে মিনি ওদের বাড়িতে থাকে । ঋষি সাইকেলে করে ঘুরিয়েছে মিনিকে । মোহর মিনিকে থাম্‌স্‌ আপ খাইয়েছে । তবু মিনি রোজ তিতলির বাড়িতেই চলে আসত ।
চোখে জল এসে গেল তিতলির ।
বাবা বলে, ‘অত মনখারাপ করে না । আমি আর একটা মিনি এনে দেব ।‘
মা বলে, ‘মিনি বোধহয় ওর মায়ের কাছে চলে গেছে রে । তুই এত মনখারাপ করিস না ।‘
ঘর মুছতে মুছতে রূপামাসি বলে, ‘না গো তিতলি । মিনি এখানেই আছে । লোকের বাড়ি বাড়ি চুরি করে খাচ্ছে তো, তাই লজ্জায় তোমার কাছে আসতে পারছে না ।‘
সেই তো । চুরি করা মহাপাপ । মিনিকে কে শেখাবে কথাটা ! মিনি তো আর বই পড়তে পারে না । তবু তিতলি ভেবে রেখেছে, মিনি এলেই এই কথাটা শিখিয়ে দেবে ওকে । মিনি যে তিতলির সব কথা শোনে ।
সেই সেবার মোহরদের পাঁচিল থেকে লাফ দিয়েছিল মিনি, মাম বলেছিল ওদের লাগে না, মিনির পায়ের পাতায় নাকি নরম নরম প্যাড আছে । তবু তিতলি খুব ভয় পেয়েছিল । পইপই করে শিখিয়েছে মিনিকে, যেন অত উঁচু থেকে লাফ না দেয় । মিনি সব কথা শুনেছে । আজকাল তো মিনি সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে হেঁটে উঠে আসত ।
সে দেখে শর্মা-আঙ্কলের কি হাসি ! মামকে ডেকে বলছিলেন, ‘ভাবিজি, আপকে বিল্লি তো বিলকুল ইন্সান বন গয়া ।‘
‘বিল্লি’ শুনলেই দুঃখ পায় মিনি । তিতলি জানে । ‘বেড়াল’ বললেই মিনি অবাক হয়, সেখানে ‘বিল্লি’! মিনি বোধহয় মনের দুঃখেই কোথাও চলে গেছে ।

কাল ইউনিট টেস্ট আছে । মৃদুলাম্যাম বলেই দিয়েছেন, ইলেভেন থেকে ফিফটিন পুরো টেব্‌ল্‌স লিখতে হবে । যে ভুল করবে, তাকে তিনবার করে লিখতে হবে । কিন্তু তিতলির তো মনই বসছে না । মিনির জন্যে চিন্তায় চিন্তায় তিতলির যে কি অবস্থা, মামও জানে না । এই তো একটু আগে জোর করে একগ্লাস কমপ্ল্যান খাইয়ে গেল, ‘তাড়াতাড়ি খেয়ে নে তিতলি । আমি তরকারিটা নামিয়ে এসেই টেব্‌ল্‌স ধরব কিন্তু ।‘
কমপ্ল্যান খেতে গিয়ে তিতলির যে কত মনখারাপ করল, মাম কি বুঝলো ? রোজ তিতলি চুপিচুপি হাফগ্লাস কমপ্ল্যান মিনিকে খাইয়ে দেয়, মাম তো জানেই না । কোথায় আছে মিনি, কি খাচ্ছে কে জানে । কে ওকে কমপ্ল্যান দেবে !