খেলাঘরখেলাঘর

বড়দেবীর পুজো

বাগডোগ্‌রা এয়ারপোর্টে পিনাকীরঞ্জনের বিমান যখন ল্যান্ড করল, তখন তাঁর ঘড়িতে সকাল দশটা। ধবধবে সাদা পাজামা আর ফিকে বেগুনী রঙের ফিনফিনে একটা খাদির পাঞ্জাবি পরেছেন পিনাকী। বহুদিন পর কোচবিহারে ফিরছেন, মনটা স্বভাবতই একটু হালকা পলকা তাঁর।
বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আকাশের দিকে একবার তাকালেন পিনাকী। ঝকমক করছে রোদ। শ্রাবণ মাসের আকাশ যে এত নীল হতে পারে সেটা ভাবাই যায় না। দিনকাল বদলে যাচ্ছে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং প্রকৃতির ঋতুচক্রটাকেই পালটে দিচ্ছে রাতারাতি। সেই ছোটবেলার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল পিনাকীর। শ্রাবণের বর্ষা একবার শুরু হলে আর থাম্বার নামই করত না। পুরনো দিনের কথা ভেবে মনটা একটু বুঝি ভার হল তাঁর।
তিনি যে কোচবিহারে যাবেন তা গতকাল দুপুর পর্যন্ত পিনাকী নিজেই জানতেন না। ডালাস থেকে দেশে এসেছিলেন কোম্পানির কিছু কাজ নিয়ে। বেঙ্গালুরু আর মুম্বইতে তাঁর কোম্পানির ব্যবসা সংক্রান্ত খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম ছিল গত সপ্তাহে। সেসব সেরে কলকাতায় এসেছিলেন পরশু দুপুরে। এতকিছুর পর আজ কলকাতাতেও একটা জরুরি বোর্ড মিটিং ছিল তাঁর। সেটা বানচাল হয়ে গেল একজন বোর্ড মেম্বার আচমকা মারা যাওয়ায়। গতকাল বিকেলে খবরটা শুনেছিলেন তিনি। ওদিকে আমেরিকা ফিরে যাবার টিকিট কাটা আরও তিন দিন পর। এই তিন্টে দিনের ছুটি চট করে যখন হাতে এসেই পড়ল, তখনই কোচবিহারে আসাটা ঠিক করে ফেলেছিলেন পিনাকী।
যেহেতু হঠাত করে আসাম বিমানবন্দরের বাইরে কেই পিনাকীর জন্য অপেক্ষা করে নেই। একটা হুটার দেওয়া অ্যাম্বাসাডার ছিল এক মন্ত্রীর জন্য। পথচারীদের চমকে দিয়ে সেটা বেরিয়ে গেল প্রথমে। লালবাতি লাগানো সরকারি গাড়ি ছিল কিছু, সেগুলোও বেপাত্তা হয়ে গেল নিজের নিজের দপ্তরের অফিসারদের নিয়ে। যাঁদের নিজস্ব গাড়ি ছিল, তাঁরাও এক এক করে নিজেদের গাড়িতে চেপে বেরিয়ে গেলেন।এখন বাইরে লাইনে ভাড়ার ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা। দু'-একজন যাত্রী দরদাম করছেন সেইসব ড্রাইভারদের সঙ্গে। পিনাকীর তেমন তাড়াহুড়ো নেই। লক্ষ করলে তাঁর পেছনের সিটে সফর করা সাদা রঙের শার্ট পড়া চাপদাড়ি ভদ্রলোক কোচবিহার যাবার ভাড়া নিয়ে দড় কষাকষি করছেন। ট্যাক্সিচালক চাইছে দু'হাজার টাকা। সেই ভদ্রলোক দেড়া হাজারের বেশি দিতে রাজি নন।
পিনাকী নিজেও কোচবিহার যাবেন। তিনি দু'-পা এগিয়ে গেলেন। সাদা শার্ট পরা ভদ্রলোককে প্রস্তাব দিয়েছেন শেয়ারে যাবার জন্য। এবার পিনাকী ভাল করে তাকালেন মানুষটার দিকে। পঁয়তাল্লিশ্ এর আশপাশ দিয়ে হবে বয়স। টকটকে ফর্সা রঙ, চোখে একটা বাইফোকাল চশমা। দাড়িতে আর পাট করে আঁচরানো চুলে পাক ধরেছে সামান্য। বেশ সম্ভ্রান্ত চেহারা ভদ্রলোকের।
পিনাকীর কথায় ভদ্রলোক বিলক্ষণ রাজি। দু'হাজারের জায়গায় এক হাজারেই ব্যবস্থা হয়ে গেলে আর মন্দ কি !দু'জনেরই লাগেজ বলতে একটা করে ছোট ট্রলিব্যাগ । ড্রাইভার ডিকির মধ্যে ঢুকিয়ে দিল তাঁদের দুজনের ব্যাগ। এবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসেছে। হিন্দি ফিল্‌মের গান লাগিয়ে দিয়েছে সাউন্ড সিস্টেমে। গাড়ি চলতে শুরু করেছে মন্থর গতিতে। পিনাকী পাশের ভদ্রলোকের দিকে আড়চোখে তাকালেন একবার। একসঙ্গে ঘন্টা চারেকের পথ যেতে হবে, চুপচাপ তো আর যাওয়া যায় না! হাল্‌কা গলায় জিজ্ঞেস করলেন- কি করেন আপনি, চাক্‌রি না ব্যবসা?
চাপদাড়ি ভদ্রলোক পিনাকীর কথায় উত্তর না দিয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে- কি হিন্দী গান চালাচ্ছ রে ভাই তখন থেকে! কানের তো পোকা নড়িয়ে দিলে তুমি! তোমার স্টকে রবীন্দ্রনাথের গান নেই?
ড্রাইভারের মুখ কাঁচুমাচু, রবীন্দ্রসঙ্গীত তো নেই স্যার। একটা সিডিই ছিল, স্ক্র্যাচ পড়ে খারাপ হয়ে গেছে।
পিনাকীর নিজেরও অসহ্য লাগছিল এই চিতকার করে গাওয়া গানগুলো. এবার পিনাকী ধমক দিলেন ড্রাইভারকে, নেই যখন তখন বন্ধ কর তোমার এই অসহ্য হিন্দি গান। এরপর থেকে দু'চারটে রবীন্দ্রনাথের গানের সিডি কিনে রাখবে। সেগুলো রাখবে গাড়িতে।
ঘাড় নেড়ে ড্রাইভার রিমোট দিয়ে তড়িঘড়ি বন্ধ করে দিয়েছে গান। মারকাটারি জগঝম্প বন্ধ হওয়াতে বেশ শান্তির পরিবেশ ফিরেছে। এবার অনেকটা আরাম বোধ করলেন দুজন। চাপদাড়ি পিনাকীর দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, আমি আসলে সাংবাদিকতার চাকরি করি।কোচবিহারে আমার বাড়ি। বছরে এক-আধবার করে বাড়ি এসে ঘুরে যাই কিছুদিন। এটা তেমনই আসা। ভদ্রলোক হাতজোড় করে বললেন, আমার নাম প্রনব দেববক্সী।
তেষ্টা পেয়েছিল জোর,একটা খনিজ জলের বোতল কিনেছিলেন দোকান থেকে। সেটাই পিনাকী গলায় ঢেলে নিলেন একটু। তারপর বোতলটা পাশে সরিয়ে রেখে প্রতিনমস্কার করলেন। তিনি যে ডালাসে আপাতত বসবাস করছেন, এটা তাঁর পুরো পেশাগত কারণে দেশে আসা, এবং সে কারণেই যে তাঁর স্ত্রী পুত্রদের ছেড়ে আসতে হয়েছে সে সব জানিয়ে দিলেন পিনাকী। তারপর বুকপকেট হাত্‌রে একমুঠো ক্যান্ডি ধরিয়ে দিলেন প্রনবের হাতে। সিগারেট ছাড়ার পর গাদাগুচ্ছের ক্যান্ডি পকেটে রাখাটাই তাঁর অভ্যেস। প্রণব মানুষটিকে বেশ লাগছে তাঁর। দীর্ঘকাল বিদেশে থাকার ফলে স্বজাতীয়দের প্রতি একটা দুর্বলতা তৈরি হয়ে গেছে, বাঙালি দেখলেই তিনি আত্মহারা হয়ে পড়েন। বাংলায় কথা বলার সুযোগ পেলে আর কিছু চাই না তাঁর। প্রণব একে বাঙালি, তায় মনে হচ্ছে বেশ মিশুকে মানুষ, পিনাকী তাই মহাখুশি।
তার মানে কোচবিহারে আপনি তিনদিনের ছুটি কাটাতে যাচ্ছেন, প্রণব নরম গলায় বললেন।
পিনাকী এবার আরো একটু ঝেড়ে কাশলেন, আসলে এবার শ্রাবণের শুক্লা অষ্টমী তিথি পড়েছে আগামীকাল। কোচবিহার রাজবাড়িতে আবার ওইদিন ময়নাকাঠ পুজো করে বড়দেবীর পুজোর কাজ শুরু হয়ে যায়। বহু বছর আমি দেশছাড়া। মাঝে এসেছি এক-আধবার, কিন্তু এই বিশেষ সময়টায় আসা হয়নি কখনও। সেই ছোটবেলায় হাফপ্যান্ট পরা অবস্থায় যে বড়দেবীর পুজো দেখেছি, সেটা এখনও মনের ভেতর গেঁথে আছে। কাকতালীয়ভাবে সেই স্মৃতিটাকে টাটকা করবার একটা সুযোগ পেয়েই গেলাম যখন, তখন ভাবলাম, লেটস্‌ গ্র্যাব দ্য অপরচুনিটি। বড়দেবীর পুজোটা আর একবার দেখে আসি গিয়ে।
প্রণব বললেন, বাহ্‌, খুব ভালো করেছেন। আমার নিজেরও ওই পুজোটা দেখবার একটা বিশেষ কৌতূহল আছে। আমি নিজে এভতি অল্টারনেট ইয়ার এ সময়টাতে বাড়িতে চলে আসি। বড়দেবীর পুজোটা কভার করি আমার পত্রিকার জন্য। তাতে বাড়ি ঘুরে আসবার একটা সুযোগ জুটে যায়, আবার সেই যাতায়াতের খরচ-টরচ সব আমার কাগজ থেকেই পেয়ে যাই।
পিনাকী হেসে মাথা নাড়লেন, তার মানে রথ দেখা আর কলাবেচা- দুটো উদ্দেশ্যই আপনার সাধন হয় এখানে এলে?
প্রণব হো হো হাসছেন, যা বলেছেন।

 

জলপাইগুড়ির বাসিন্দা মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের স্কুলে পড়ার সময় থেকেই লেখালিখিতে হাতেখড়ি। পেশায় সরকারি চাকুরে মৃগাঙ্ক নিয়মিত বিভিন্ন প্রতিষ্টিত এবং স্বল্প পরিচিত কাগুজে পত্রিকায় এবং ওয়েব ম্যাগাজিনে বড়দের এবং ছোটদের জন্য গল্প এবং ভ্রমণকাহিনী লেখেন। লেখালিখির পাশাপাশি সুযোগ পেলেই ক্রিকেট ব্যাট হাতে মাঠে নেমে পড়েন মৃগাঙ্ক।