খেলাঘরখেলাঘর

বড়দেবীর পুজো

পিনাকী বললেন, আমার বেশ মনে আছে, গুঞ্জাবাড়ির কাছে ডাংরাই মন্দিরে বড়দেবীর পুজোটা হত। তা দেখতে কোচবিহারের বাইরে থেকেই লোক আসত।
প্রণব বললেন, ঠিকই বলেছেন, এখনও তাইই হয়, কাল শ্রাবণের শুক্লা অষ্টমী তিথি, কাল সন্ধেবেলা রাজ প্রতিনিধি হিসাবে একজন দুয়ারবক্সি ময়না কাঠ আবাহন করবেন। মন্দির থেকে ঢাক আর সানাই বাজিয়ে পালকিতে চাপিয়ে সেই কাঠকে মদনমোহন বাড়িতে নিয়ে আসবেন সেই দুয়ারবক্সি। মদনমোহন মন্দির চত্বরের একটি ঘরে টানা এক মাস ধরে ঐ কাঠের পুজো হবে।
পিনাকী মন দিয়ে শুনছিলেন। বললেন, হাইলি ইন্টারেস্টিং। তারপর?
প্রণব বললেন, এরপর ভাদ্রের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে মহাস্নান আর ধর্মপাঠ পুজোর পর সেই কাঠ দেবীবাড়িতে বড়দেবীর মন্দিরে প্রতিস্থাপন করা হবে। তার তিন দিন পর থেকে সেই কাঠে খড় দিয়ে ভোঁতা বেঁধে শুরু হবে বড়দেবীর মূর্তি গড়ার কাজ।
সত্যিই, রাজা নেই, রাজ্যপাট নেই, পিনাকী ঘাড় নাড়লেন, কিন্তু কয়েকশো বছর ধরে এই পুজোটা হয়ে আসছে পুরো নিয়ম নিষ্ঠা আর অনুশাসন মেনে, ভাবলে অবাক লাগে, তাই না!
কথা বলতে বলতে গাড়ি তিস্তা ব্রিজের ওপর দিয়ে চলছে। প্রণব হটাত করে ড্রাইভারকে বললেন, ভাই, আমি জানলার কাচটা খুলব। তোমার এ-সিটা একটু বন্ধ করে দাও।
ড্রাইভার এ-সি অফ করবার আগেই জানলার কাচ নামিয়ে প্রণব মুখ বের করে দিয়েছেন বাইরে। শ্বাস নিয়েছেন বুক ভরে। পিনাকী বড় বড় চোখ করে কান্ড দেখছিলেন প্রণবের। বললেন, কি ছেলেমানুষি করছেন? অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে যেতে পারে তো !
প্রণব তেরছা চোখে তাকালেন পিনাকীর দিকে, রাখুন আপনার অ্যাক্সিডেন্ট! কত যুগ পর তিস্তা নদীর ওপর দিয়ে যাচ্ছি, আর তিস্তার গায়ের গন্ধ এনবার প্রাণ ভরে নেব না মশাই ! জানেন তো, তিস্তা তোর্ষা জলঢাকা সঙ্কোশ রায়ডাক - প্রত্যেকটা নদীর ঘ্রাণ কিন্তু আলাদা। এটা যে জানে, শুধু সে-ই জানে।
ঠিক ঠিক, এটা তো আমার খেয়াল করা উচিত ছিল, এবার পিনাকী নিজেও তাঁর পাশের জানলার কাঁচটা ত্বরিতগতিতে নামিয়ে ফেলেছেন। তারপর মুখ বাড়িয়ে দিয়েছেন বাইরের দিকে। এক কিলোমিটার লম্বা ব্রিজটা শেষ হবার পর আবার দুজন মাথা ঢুকিয়েছেন গাড়ির ভেতর। দুজনেই হাসছেন শিশুদের মত। ড্রাইভার বড় বড় চোখ কঅরে বয়স্ক দুটি খোকার কান্ড দেখছিল লুকিং গ্লাস দিয়ে। পিনাকী বললেন, এসি-টেসি আর চালাবার দরকার নেই ভাই। গরম লাগে লাগুক। বাকি রাস্তা প্রাণ ভরে আমাদের ডুয়ার্সের ঘ্রাণ নিতে নিতে যাব।
পিনাকী ক্যান্ডির মোড়ক খুলে একটা ক্যান্ডি মুখের ভেতর পরেছেন। জিভ দিয়ে নাড়ছেন আলতো আলতো। তারপর প্রণবের উদ্দেশে চোখ বুঁজেই বললেন, ময়নাকাঠকে দেবী হিসেবে কল্পনা করে কবে থেকে পুজো শুরু হয়, জানা আছে কি আপনার?
প্রণব বললেন, সম্ভবত পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিকে বা ষোড়শো শতাব্দীর শুরুতে বড়দেবীর পুজো শুরু করেছিলেন কোচ রাজবংশের স্থপতি মহারাজা বিশ্বসিংহ। কিন্তু মূর্তি গড়ে পুজোর চল শুরু হয় ষোড়শো শতকের মাঝামাঝি, মহারাজা নরনারায়ণের আমলে।
ঠিক, পিনাকী সায় দিলেন। মুন্সি জয়নাথ ঘোষের রাজোপাখ্যান নামে একটা বই আমি পড়েছি। সেখান থেকে জেনেছি যে মহারাজা নরনারায়ণের ভাই তথা সেনাপতি শুক্লধ্বজ একদিন কোষমুক্ত তরবারি নিয়ে রাজসভায় ঢুকেছিলেন।
শুক্লধ্বজ? মানে চিলা রায় নামে যিনি খ্যাত, তিনিই তো?
ঘাড় নেড়েছেন পিনাকী, সপারিষদ নরনারায়ণ তখন সিংহাসনে বলে ছিলেন। তবে খোলা তলোয়ার হাতে  ভাইকে রাজসভায় ঢুকতে দেখে মহারাজ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে ছিলেন ভাইয়ের দিকে। নির্নিমেষ সেই দৃষ্টির সামনে পড়ে চিলা রায় জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েন ঐ সভাস্থলেই।
হুম, শুনেছি গল্পটা, প্রণব বললেন, পরে জ্ঞান ফিরলে চিলা রায় স্বীকার করেছিলেন যে তিনি মহারাজকে হত্যা করবার জন্যই রাজসভায় এসেছিলেন। কিন্তু রজসভায় ঢুকতেই তিনি নাকি দেখেন যে স্বয়ং দেবী ভগবতীর কোলে বসে রয়েছেন রাজা নরনারায়ণ। এই ঘটনার পর মহারাজা তিনদিন তিনরাত ধ্যানস্থ থেকে দেবী মহামায়ার দর্শন পান। তারপরেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে রাজ্যে পুজো হবে এবং দেবীর নাম হবে দশভুজা।
পিনাকী বললেন, দেবীর দেবীর ডান পা সিংহের পিঠে আর বাঁ পা মোষের পিঠে ঠাকবে। অসুরের ডান হাত সিংহের মুখে আর বাঁ হাত বাঘের মুখে ঢোকানো থাকবে। বাঘের সামনে থাকবে জয়া-বিজয়ার মূর্তি। তবে দেবীর দু'পাশে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ থাকবে না।
প্রণব হাসলেন, একদম ঠিক। ওই ময়না কাঠের ওপ্রেই প্রাচীন রীতি মেনে গড়া হবে দেবীমূর্তি। আগে রাজ আমলে জঙ্গল থেকে ময়না কাঠ সংগ্রহ করা হত। এখন গ্রামগঞ্জে ওই কাঠ পাওয়াই যায় না। তাই কোচবিহার দেবোত্তর ট্রাস্ট বোর্ডেড় পক্ষ থেকে আনন্দময়ী ধর্মশালা চত্বরে ওই গাছ লাগান হয়েছে শুনেছি।
সেখান থেকেই কাঠ নিয়ে কাল সকাল দশটায় ডাংরাই মন্দিতে পুজো হবে। পিনাকীর মুখ একটু উজ্জ্বল হল, প্রতিবছরের মত সেই পুজো করবেন রাজ পুরোহিত শ্রী পৃথ্বীরঞ্জন ভট্টাচার্য।
আপনি কিভাবে জানলেন? আপনি কি তাঁকে চেনেন? প্রণব বিস্মিত হয়ে বললেন।
পিনাকী হাসছেন, চিনি অল্প অল্প। সম্পর্কে তিনি আমার বাবা।
আপনি তো সাঙ্ঘাতিক লোক মশাই!প্রণব পিনাকীর ঘাড়ে চাপড় মেরেছেন উত্তেজনায়, এতক্ষণ ধরে পাশাপাশি সফর করছি, এই কথাটা আপনি এতক্ষণে বললেন? কোচবিহারে আপনার বাবাকে চেনে না এমন লোক একটিও নেই !
পিনাকী মৃদু মৃদু হাসছেন। প্রণব এবার চকচকে চোখে পিনাকীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, এবার তবে আমার অন্য পরিচয়টাও দিয়ে দিই আপনাকে।

পিনাকী ভুরু জড়ো করেছেন। প্রণবের দু'ঠোঁট কান ছুঁইয়ে ফেলল প্রায়, ময়নাকাঠ যিনি আবাহন করবেন, তাঁর নাম প্রবীর দেববক্সী। তিনি আমার আপন জ্যাঠামশাই। কেন এই পুজোর জন্য আমার এতটা টান, সেটা এবার বুঝেছেন নিশ্চয়। কাজেই বুঝতাই পারছেন, বড়দেবীর পুজোর সঙ্গে আমার কানেক্‌শনটাও নেহাত্‌ ফেলনা নয়!

সারা আকাশ জুড়ে ভাসছে সাদা সাদা মেঘ। মেঘের আড়ালে মাঝে মাঝে চলে যাচ্ছেন সূর্যদেব। আবার বেড়িয়ে আসছেন প্রখর তপনতাপ সঙ্গে করে। জানলা পুরো খোলা, পিনাকীদের গাড়ি ফালাকাটা ছাড়িয়ে শিলতোর্ষা ব্রিজের ওপর দিয়ে যাচ্ছে। এক কিলোমিটারের চাইতে কিছু কম দৈর্ঘ ব্রিজটির। আবারও জানলা দিয়ে মুখ বের করে দুজন বুখ ভরে শ্বাস নিলেন। দুজন বয়স্ক মানুষের ভেতর কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল, এবার সহসা জেগে উঠেছে দুটি শিশু। আলাদা আলাদা কারণ, তবু বড়দেবীর পুজোর আয়োজন দুজনকেই টানছে অমোঘ আকর্ষণে। পিনাকী-প্রণব দুজনের বুকের ভেতরাই মাদল বাজছে দ্রিদিম দ্রিদিম শব্দ করে। কোচবিহারের দিকে যত এগোচ্ছেন, ততই উতলা হয়ে পড়ছেন দুজন। দুজনেই তুমুল অধৈর্য এই সামান্য পথ বুঝি ফুরোয় না আর !

বড়দেবীর পুজো

জলপাইগুড়ির বাসিন্দা মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের স্কুলে পড়ার সময় থেকেই লেখালিখিতে হাতেখড়ি। পেশায় সরকারি চাকুরে মৃগাঙ্ক নিয়মিত বিভিন্ন প্রতিষ্টিত এবং স্বল্প পরিচিত কাগুজে পত্রিকায় এবং ওয়েব ম্যাগাজিনে বড়দের এবং ছোটদের জন্য গল্প এবং ভ্রমণকাহিনী লেখেন। লেখালিখির পাশাপাশি সুযোগ পেলেই ক্রিকেট ব্যাট হাতে মাঠে নেমে পড়েন মৃগাঙ্ক।