খেলাঘরখেলাঘর

পুজোর চিঠি


(৪)
ওরে আমার বাপনসোনা,                                                             
তোর চিঠিই এখন আমার মনের চোখ সেটা জানিস?না না ভ্রু কুঁচকাস না অমন করে।আসলে আমি এতোদিন দোতলার ঐ জানলার ধারের চেয়ারটাতেই সারাদিন বসতাম আর মাঝে মাঝে তোকে চিঠি লিখতাম।জানলার শিকের ফাঁক দিয়ে আমি পৃথিবী দেখতাম।দিনকয়েক ঐ জানলাটা আমার চোখের বাইরে।ডাক্তারের বারণ।বলেছে আমায় শুয়ে শুয়ে বিশ্রাম নিতে।আমি শুয়ে আছি খাটে… প্রায় সবসময়।আর গতকাল তোর ছোটমামা তিনপাহাড় থেকে ফিরেছে অনেক রাত্রে,ওখানকার সার্ভে শেষ।আজ সকালে তোর চিঠিটা আমায় দিলো আর তিনপাহাড়ের অনেক গল্প করলো।জানিস ওখানে একটা সাধু বছরের পর বছর মৌনিবাবা হয়ে লোকের পূজ্যস্থানীয় হয়ে উঠেছিলো নানা চমতকার দেখিয়ে।পরশু দুপুরে সে নাকি ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে।সে নাকি উত্তরপ্রদেশের এক মস্ত বড় ডাকাত দলের চাঁই!ওসব তৃতীয় নয়ন বলে কিছু নেই রে।আর কেউ বলে দিলো আর অমনি বিশ্বাস করে নিলি ,অমন মন কক্ষনো করবিনা।বেশীরভাগ লোক দুর্বল সেটা জানিস তো।কিছু করতে না পারলেই বুজরুকিতে আশ্রয় করে।সেটা না করে প্রশ্ন করবি,নিজের মনকে।কেন করবো আমি? কেন ?কেন? এই কেন প্রশ্নটাই দেখবি তোর এগোনোয় পথ দেখাবে।তোর চিঠি পড়ে আমি তোকে দেখলাম আমার মনের চোখ দিয়ে।আমার কল্পনার চোখ দিয়ে।আসল চোখ কিন্তু মনের।এই চোখ দিয়ে তুই খুব গরম কোনো দুপুরে কল্পনা করতেই পারিস বসে আছিস ফুরফুরে কোনো পুকুরপারে!ভিড় বাসে মুরগীবাচ্চার কঁককঁকানি আর মেছো আঁশটে গন্ধে মনটাকে বিরক্ত হতে না দিয়ে তুই দেখতেই পারিস তোর ঠাকুর্দার দেশ এরোয়ালী গ্রামের বড়কালী বিসর্জনের বাজীপোড়ানো রাত।যা চোখ দিয়ে দেখছিস সেটাই কিন্তু শুধু দেখা নয় রে, মনটা দিয়ে চোখের দেখাটাকে বদলে দিতে পারলেই দেখবি খুশীতে ভরে গেছে দুঃখের দুপুরগুলো।
বাপন আমি এরপর আর চিঠি লিখতে পারবোনা।ডাক্তার সেটাও বন্ধ করে দিয়েছে।বলে, আপনার শরীরের কষ্ট হচ্ছে।বিশ্রাম দরকার।কি বোকা এরা বুঝলি!এরা সারাদিন খুব ব্যস্ত আমায় নিয়ে।কিন্তু এরা বোঝেনা আমি না দেখতে পেলে আর লিখতে না পেলেই তাড়াতাড়ি চলে যাবো।ভাগ্যিস মনের চোখ দুটো ছিলো।এই চিঠিটাই তোকে লেখা আমার শেষ চিঠি রে।কেন? সেটা বুঝবি কিছুদিন পরেই।না এটা তোকে আমি বোঝাবোনা।এটা তোকে নিজেই বুঝতে হবে।তুই তো এখন সদ্য কৈশোরে হাঁটি হাঁটি পা...কিন্তু এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেখবি মোলায়েম মোচ পেরোনো বেয়ারা বয়েসেও তোকে সমান ভাবাচ্ছে।আমি জানি আমি অনেক শক্ত শক্ত কথা বলছি,কিন্তু এসে যাচ্ছে রে।আসলে মনে হচ্ছে ওরা জোর করে আমার একটা চোখ কেড়ে নেবে একটু পড়ে।আমি ... আর আমার বুকের রক্তগুলোদিয়ে শব্দ গড়তে পারবোনা এই জীবনে।খুব কষ্ট হচ্ছে রে।মনে পড়ছে সেই ছেলেবেলার কথা।জাপানী বোমার ভয়ে জমিদার বাড়ীর পাশের আগছা জঙ্গলে মাটি খুঁড়ে বাঙ্কারে লুকিয়ে থাকার দিনগুলো।সাইরেন বাজলেই দুরদার করে সব্বাই মাটির নীচে।তারপর একদিন আমাকে চলে যেতে হলো আমার মামা বাড়ীর দেশে।পদ্মাপাড়ের হরিতকীপুরে নদীর দুলকি চালে পৌঁছে গেলাম একদিন।সার সার টিনের চালে ছড়ানো বিশাল এলাকা জুড়ে আমার মামার বাড়ী।বড় মামা ষ্টীমার ঘাটের এজেন্ট।যখন তখন ঝপাং করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে স্নান... আর ভটভটিতে মাঝি মাল্লাদের রান্না করা হাঁসের কষা মাংসের স্বাদ।
সেই একমাস যেন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা।বাড়তি একটু খুশী।তারপরে হঠাত আবার এদেশ, সেই জমিদার বাড়ী,সেই পূজামন্ডপের চাতাল।সবকিছু সেই...সেই...সেই।আবার ওরা কেড়ে নিলো আমার আনন্দটা।এখনো আমার সেরকম মনে হচ্ছে জানিস।আগেকার দিনগুলো বড্ড মনে হচ্ছে।আর ভয়ও হচ্ছে মনের চোখটা চলে যাবে নাতো?বিষাক্ত ঘাগুলো হিস হিস করে নীলচে ফনা শাঁসাচ্ছে মনের ওপরেও।ছোবল বসাতে কতক্ষন? আমার প্রিয় বাপন।আমি জানিনা,তোর সাথে এজীবনে আর দেখা হবে কিনা।সত্যিই জানিনা।কিন্তু পূজো আসছে।টিভিতে ঢ্যাম কুড়াকুড় সারাক্ষন।শচীন কর্তা আর মানবেন্দ্রর বিখ্যাত গানগুলো আবার কে সব গেয়েছে দেখি।এবাড়ীতে টিভির লোকদেখানো আনন্দ আমাকে খুশী রেখে বাকীদের শাড়ীর আঁচলের আড়ালে চোখের জলের শব্দ ঢাকার জন্য।আমি সব জানি রে।বলি না এদের।কষ্ট হয় আমার।তোকেই বলি সব।বললাম এসব...শেষবারের মতো।ভালো থাকিস।মানুষের মতো মানুষ হোস।ডাকব্যাকের ব্যাগে মোড়া সিলেবাসের দিনগুলোর চেয়ে অন্য সিলেবাসের ভালো মানুষ হওয়া অনেক ইম্পর্ট্যান্ট রে।বুঝিস এটা সারা জীবন ধরে।এপর্যন্তই থাক... বাকি জীবনের মতো।খুব শিগগিরি চললাম।আবার কখনো পরে দেখা হলে চিনতে পারবিতো?আমি কিন্তু তোর জন্য অপেক্ষা করে থাকবো।

তোর দাদুভাই

 

পুজোর চিঠি

 

 

অতনু ব্যানার্জী
কলকাতা