খেলাঘরখেলাঘর

থটশপ

 

থটশপথটশপ

সে এক ছিল মজার দোকান । দোকানের নাম "থট-শপ" ।সেই দোকান সাধারণ মানুষ খুঁজে পেত না, যার যাবার ইচ্ছে হত সে ঠিক পৌঁছে যেত সেই দোকানে । মালিক এক থুড়থুড়ে, দাড়ি ওলা বুড়ো যার নাম চিন্তামণি, অনেক বয়স তাঁর ।  এক সময় ছিলেন রসায়নবিদ । ক্রিস্টালের ওপরে রিসার্চ করেছিলেন বহু বছর ।  সে দোকানে কত রকমের  সব জিনিষ বিক্রি হত । থরে থরে সব সাজানো থাকতো কাঁচের বয়ামের মধ্যে  । ঠিক যেন লজেন্স ! লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, কমলা.... কত রঙের বাহার।
কত ধরণের গড়ন সেই সব রঙীন লজেন্স-ক্রিস্টালের; কোনোটা ছুঁচের মত, কোনোটা রম্বসের মত, কোনোটা আবার চোঙাকৃতির, কোনটে বা আয়তঘনাকার ।প্রত্যেক বয়ামের গায়ে স্ফটিকের নাম, দাম আর গুণাবলী লেখা থাকত।  বুড়ো চিন্তামণি দোকানের মধ্যে  টেষ্টটিউব, বানসেন বার্নার, বিকার, ফিল্টারপেপার, ফানেল  আর আইসবক্স নিয়ে বসে থাকত ঘন্টার পর ঘন্টা নাওয়া-খাওয়া ভুলে । ছোট ছোট বাক্সের মধ্যে রাখা রঙবেরঙয়ের নুন-চিনির মত দানা  বের করে তাদের জলে দ্রবীভূত করে , ফুটিয়ে ধীরে ধীরে ঠান্ডা করে বরফে কিম্বা ঠান্ডা জলের মধ্যে রেখে রাতে বাড়ি চলে যেত; পরদিন এসে দেখত কেমন সব রঙ বেরঙয়ের স্ফটিকের উত্পত্তি ।বুড়োর ছিল এক গ্লাসরড যা প্রত্যেক ক্রিস্টালে ছোঁয়ালেই একটা করে চিন্তা বা "থট" ঢুকে যেত তার মধ্যে । আর যে সেই ক্রিস্টাল বুড়োর কাছ থেকে কিনে নিয়ে বাড়ি গিয়ে বয়ামে লেখা নিয়ম মাফিক গ্লাসে জল নিয়ে এক এক করে যেই ফেলত অমনি চিন্তার বুদবুদেরা গ্লাসের জলের মধ্যে থেকে সেই মানুষটির মাথায় যেত চলে । আর ঠিক তক্ষুণি সেই মানুষটি
পাড়ি দিত চিন্তার কল্পলোকে ।     

ছোট্ট অপু একদিন সেই দোকানের খোঁজ পেল । তার অনেক দিনের সাধ পাখি হয়ে উড়ে মেঘেদের কাছে যাবার; নীলচে সবুজ "স্ফটিক"নামের    লজেন্স-ক্রিস্টালের পাউচ কিনে নাচতে নাচতে বাড়ি এল । বুড়োর কথামত এক গ্লাস জল নিয়ে যেই একদানা ক্রিস্টাল জলে ফেলা অমনি অপু পাড়ি দিল পাখির বেশ ধরে  স্বপ্নের কল্পনায় । মাছরাঙার নীলটুকু ,কাঠঠোকরার হলদে টুকু, টিয়ার ঠোঁটের লালটুকু নিয়ে অপু হল ছোট্ট পাখি  টুনিয়া । শিস দিয়ে গান গাইতে গাইতে টুনিয়া উড়ে গেল মেঘের বাড়ি। অনেক দিন ধরেই অপুর মা বলছিল বৃষ্টিহীনতা আর খরার কথা । মেঘের কাছে গিয়ে টুনিয়া গান শুনিয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে মেঘকে নিয়ে এল নিজের বাড়ির ছাদের মাথায় আর শুরু হল ঝমাঝম বৃষ্টি ।

ছোট্ট মেয়ে তাথৈ সমুদ্রের নীচে  দ্বীপে পাড়ি দিতে চায় ।  তাথৈ সেই দোকানে গিয়ে  কমলা রঙয়ের "রম্বিক"নামের ক্রিস্টাল কিনে নিয়ে এল আর জলে ফেলতেই চিন্তার বুদবুদেরা তাথৈকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল সমুদ্রের নীচে । ছোট ছোট সি এনিমন, কোরাল, হাইড্রা আর এলগিদের সাথে তার বন্ধুত্ব হল। মায়ের কাছে গল্প শুনেছিল ঝিনুকের পেটে মুক্তোর কথা । কিন্তু কোনোদিন তা চোখে দেখেনি সে। খুব ইচ্ছে হত হাতে করে দেখার । নীচে গিয়ে দেখে কত কত ঝিনুক । ঢাকনা খুলে পেটে করে পেল্লায় মুক্তো নিয়ে
গ্যাঁট হয়ে বসে আছে । দুচোখ ভরে তা দেখতে দেখতে হঠাত্‌ তাথৈ ভাবল "আমি যদি এমন একটা মুক্তো হতে পারতাম"  । যেমনি ভাবা অমনি একটা বিরাট গোলাপী ঝিনুক তার দিকে ছুটে এসে বলল "আজ থেকে তুমি হলে এই জলমন্ডলের রাণী । তোমার নাম আমি দিলাম মুক্তা, এস আমার কোলে"  আহ্লাদে আটখানা হয়ে মুক্তারাণী ঝিনুকের কোলে বসে পড়ল । আর তখুনি আর সব জলদেশের বন্ধুরা তাকে ঘিরে হৈচৈ করতে লাগল, নাচতে লাগল, গাইতে লাগল । মুক্তা তাদের বলল যাবে তোমরা আমার বাড়ির বাগানে? একটা ছোট্ট লিলিপুলে থাকবে । আমার সাথে রোজ খেলবে এই ভাবে । রাণীর কথা কি আর অমান্য করা যায় সব ছোট বড় ঝিনুকেরা, মস-ফার্ণ, শাঁখেরা  অমনি রাজী হয়ে গেল । তাথৈ তাদের সঙ্গে নিয়ে বাড়ির বাগানের লিলিপুলে ছেড়ে দিল । অনেকদিনের শখ তার পূর্ণ হল ।

 

ইন্দিরা মুখার্জি নিয়মিত বিভিন্ন কাগুজে পত্রিকা এবং ওয়েবম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখালিখি করেন। কবিতা-গল্প-ভ্রমণকাহিনী লেখা ছাড়াও, রসায়নশাস্ত্রের এই ছাত্রীর পছন্দের তালিকায় রয়েছে ভাল বই পড়া, ভ্রমণ, সঙ্গীতচর্চা এবং রান্না-বান্না। 'প্যাপিরাস' ওয়েব ম্যাগাজিনের সম্পাদক ইন্দিরা মুখার্জির সম্প্রতি বেশ কয়েকটি বিভিন্ন স্বাদের বই-ও প্রকাশিত হয়েছে।