গোধূলির শেষে অন্ধকার হয়ে আসার মুখে তর্করত্ন মশাই রোওয়ানা দিলেন নিজের গ্রামের দিকে। পথে পেরুতে হয় মস্ত বড় ঠগীর মাঠ – প্রায় মাইল খানেকের উপর চওড়া – পাথরের নুড়ি ভরা রুক্ষ উঁচু নিচু জমি – মাঝে মাঝে বহু পুরাতন বট ও অস্বত্থ গাছ বিরাট বিরাট ঝুরি নামিয়ে অনেকটা জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে – এদিক ওদিক শ্যাওড়া গাছ আর কাঁটা গাছের ঝোপ ঝাড়। মাঠের একধারে বিরাট একটা মজে যাওয়া বিল – শ্যাওড়া ও বাবলা গাছের জন্য ওদিকে যাওয়া প্রায় অসম্ভব – পুরো বিলটাই পচা কাদায় ভরা অনেকটা চোরা বালির মত – কিছু পড়লে ভুস্ ভুস্ করে কোথায় যে তলিয়ে যায় কেউ জানে না। রাত্রে বেলা মাঝে মাঝেই হুঁস হুঁস করে এদিক ওদিক আগুন জ্বলে ওঠে – আশে পাশের গ্রামের লোকের মধ্যে চলতি কথা যে বিলের কাদায় যাদের ফেলে দেওয়া হয়েছিলো তেনারাই রাত্রে আগুন জ্বালিয়ে ঘুরে বেড়ান। ঠগীদের সময় কেউই প্রাণ নিয়ে এই মাঠ পেরুতে পারতো না – কত লোককে যে মেরে এই বিলে ফেলে দিয়েছিলো তার হিসেব নেই – বড় দল করে দিনের বেলাতেই শুধু লোকে মাঠটা পেরুতো। এখন তো ঠগীদের দিন নেই তবে নামটা রয়ে গিয়েছে আর বদনামটা নানা মুখের গল্পে রং চং মেখে গ্রামের লোকের মনে ভিত গেড়ে নিয়েছে তাই সন্ধ্যের পর কেউই মাঠ পেরুতে সাহস করে না। তর্করত্ন মশাই অবশ্য এসব গল্প একেবারেই বিশ্বাস করেন না তবে সাপ খোপের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হয় – বড় বড় কাল কেউটেরা এখানে স্বাধীন ভাবেই ঘোরা ফেরা করে। আজও নিজের মনে শ্রীবিষ্ণুর সন্ধ্যারতির স্লোকটা গাইতে গাইতে হন্হনিয়ে চলেছেন মাঠের ভেতর দিয়ে তবে দৃষ্টি সজাগ রয়েছে বাসুকী নন্দনদের জন্য। হঠাৎ মনে হলো অন্ধকারের মধ্যে ভুঁইফোড়ের মত ওর পাশে কে যেন হাঁটতে শুরু করেছে – কোথা থেকে এলো, কি ভাবে এলো ঠিক হিসেব পেলেন না – তর্করত্ন মশাই দাঁড়িয়ে পড়লেন।
‘পেন্নাম হই পণ্ডিত মশাই, জমিদার ব্যাটার স্বর্গে যাবার ব্যবস্থা তো করে এলেন – তা ওকে কি স্বর্গে ঢুকতে দেবে? চিত্রগুপ্তের খাতায় অনেক গুলো পাতা তো ওর কীর্তি কাহিনীতে ভরে আছে।’
দোর্দন্ড প্রতাপ জমিদার চণ্ডীকা চরণ চৌধুরী – যার ভয়ে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতো – তার নামে এই ভাবে অশ্রদ্ধার সাথে কথা বলা এই প্রথম শুনলেন – লোকটার বুকের পাটা আছে বলতে হবে – কে জানে কোথাকার লোক,
‘শাস্ত্রের যা বিধি সেই ভাবেই আমি করেছি – বাকিটা তো আমার হাতে নেই – ভগবানের যা বিধান সেটা তো হবেই। কেউই তা আটকাতে পারে না।’
‘তা অবশ্য ঠিক – আপনি শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত – আপনার কাজ আপনি করে দিয়েছেন। তা পণ্ডিত মশাই, আপনাকে যে একটু কষ্ট করে আমার সাথে যেতে হবে।’
‘এখন? কোথায়?? কেন???’
‘সেটা গেলেই বুঝতে পারবেন – ভয় নেই বেশী দেরি হবে না – আমি আপনাকে বাড়ি পৌছে দেবো।’
নর নারায়ণ এবার বিপাকে পড়লেন – একে তো অন্ধকার মাঠের মধ্যে লোকটা হঠাৎই কোথা থেকে এলো সেটাই চিন্তার বিষয় তার উপর কোথায় যেতে হবে, কেন যেতে হবে কিছুই বলছে না – লোকটার হাব ভাবও যেন কেমন ধরনের – অশরীরি আত্মা নয় তো?
‘দেখো ভাই, আমি সকাল থেকেই অভুক্ত – খুবই পরিশ্রান্ত – বাড়িতে গিয়ে স্বপাকে কিছু না খেলে যে আর চলতেও পারবো না। তাছাড়া বাড়িতে নারায়ণের সন্ধ্যারতিও তো করা হয় নি। তুমি না হয় কাল সকালে আমার বাড়ি এসো – তখন তোমার সাথে চলে আসবো।’
‘মাপ করবেন পণ্ডিত মশাই, সকালে যে আমি আসিতে পারবো না। এক কাজ করা যাক – এখন রাত তো বিশেষ হয় নি – আপনি বাড়ি গিয়ে পূজা আর্চা, খাওয়া দাওয়া করে নিন – তারপর আমি আপনাকে নিয়ে আসবো।’