নর নারায়ণ বুঝলেন এ ছাড়ার পাত্র নয় আর কি এমন দরকারি কাজ যে রাত্রে বেলাতেই যেতে হবে? ব্যাপারটা খুবই ঘোরালো মনে হচ্ছে – বেঘোরে প্রাণটা না গেলেই হয় তবে খুবই নম্র ভাবে কথা বলছে এই যা ভরসা।
‘ঠিক আছে, তোমার ইচ্ছে মতই হবে।’
নর নারায়ণ বাড়ির কাছে আসতেই লোকটা হঠাৎ কোথায় যেন উবে গেলো।
সারা দিন অনিচ্ছার সাথে শ্রাদ্ধের কাজ করার পর নিজেকে কেমন যেন ক্লেদাক্ত মনে হচ্ছিলো – সোজা পুকুরে ডুব দিয়ে ভালো করে স্নান করে নিলেন তারপর নারায়ণের সন্ধ্যারতি করে খাওয়া দাওয়া শেষ করতে বেশ সময় লাগলো – ভাবলেন দেরি দেখে হয়তো ব্যাটা চলে গিয়েছে। বাড়ির বাইরে আসতেই দেখেন লোকটা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে,
‘চলুন পণ্ডিত মশাই, মাঠের পাশেই আপনার জন্য পালকি রাখা আছে।’
মাঠের কাছে এসে দেখতে পেলেন বট গাছের নিচে একটা চার বেহারার পালকি দাঁড়িয়ে কিন্ত আশে পাশে কোন পালকি-বেয়ারা নেই। এবার নর নারায়ণের ভয় হলো – সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন যেন ভৌতিক। সাহস করে বললেন,
‘তোমার পরিচয় না দিলে বাপু তোমার সাথে যাওয়া তো সম্ভব নয়। তুমি কে? কোথা থেকে আসছো? কোথায় যেতে হবে? এর কিছুই তো বলো নি – তুমি যদি আমার প্রাণটা নিতে চাও আমার আপত্তি নেই – এই ত্রিসংসারে আমার কেউ নেই কিন্তু বিস্তারিত না জেনে আমি আর এগুচ্ছি না।’
‘ছিঃ ছিঃ পণ্ডিত মশাই, আপনি সবার পরম শ্রদ্ধার পাত্র – এসব কথা ভাবলেও পাপ। আপনি ভয় পাবেন বলেই এত সময় আমার পরিচয় দেই নি। আমার নাম ছিলো পরান – অনেকদিন আগে খাজনার টাকা সময় মত দিতে না পারায় জমিদারবাবুর লেঠেলরা পিটিয়ে আধমরা করে এই বিলের কাদায় ফেলে দিয়েছিলো আর আমিও ভুস্ করে নিচে তলিয়ে গেলাম। এখন বুঝতেই পারছেন আমি জীবিত মানুষ নই তবে ভয় পাবেন না – আপনাকে সুস্থ শরীরে বাড়ি পৌছে দেবার দায়িত্ব আমার। আপনার সাথে আমাদের একটু আলোচনা আছে – একটু তাড়াতাড়ি করুন – জানেনই তো দিনের আলোতে আমরা বেরুতে পারি না।’
নর নারায়ণ বুঝলেন ওঁর ধারনাই ঠিক – এ তো প্রেতাত্মা আর নিয়ে যাবে আরো অনেক প্রেতাত্মার সাথে আলোচনা করাতে। শরীরটা শিউরে উঠলেও ভাবলেন যা হবার তা তো হবেই – ভবিতব্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দেওয়াই ভালো – বাড়ি পৌছে দেবার কথা যখন দিয়েছে তখন দেখাই যাক। পালকিতে উঠে বসতেই দরজা বন্ধ হয়ে গেলো তারপর ওটা ভীষণ জোরে চলতে শুরু করলো যেন চারটে ঘোড়া পালকিটাকে নিয়ে দৌড়াচ্ছে। হয়তো পরানের মতই আরো কিছু ছায়া পালকিটাকে নিয়ে চলেছে তবে কোন দিকে যাচ্ছে সেটা বোঝা গেলো না। একটু পরে পালকিটা দাঁড়িয়ে পড়তে দরজা খুলে গেলো,
‘আসুন পণ্ডিত মশাই আমরা পৌছে গিয়েছি।’
পালকি থেকে বেরিয়ে নর নারায়ণ দেখলেন বিলের ধারে একটা খোলা জায়গাতে এসেছেন – চারদিকে পরানের মত অনেক ছায়ার ভিড় আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ছায়াকে দেখিয়ে পরান বললো,
‘পণ্ডিত মশাই, ইনি হলেন ভূতনাথ – অনেক বছর আগে এই গ্রামের মোড়ল ছিলেন। অহেতুক খাজনা বাড়ানোতে জমিদারের কাছে প্রতিবাদ করে নতুন খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেন। লাভের লাভ হলো এক রাত্রে ওর বাড়িতে লেঠেলরা আগুন ধরিয়ে দেয় আর সেই আগুনে পুড়ে ওর ছেলে মেয়ে ও স্ত্রী মারা যান আর ওর আধ পোড়া শরীরের জায়গা হয় এই বিলের কাদায়। এখানে যাদের দেখছেন সবাই আশে পাশের গ্রামের বাসিন্দা ছিলো কিন্ত লেঠেলদের দয়ায় এদের ঠাঁই মিলেছিলো এই বিলের চোরা কাদায়। অপঘাতে মৃত্যু ও ভয়ে শেষ কৃত্য কেউ করে নি বলে এই ভূত জন্ম থেকে আমাদের তো আর উদ্ধার নেই। কন্দর্প কান্তি তো বাপের উপর দিয়ে যায় আর ওর বৌ একেবারে যোগ্য সহধর্মিনী – বাড়িতে ঝি চাকরদের তো পান থেকে চুন খসার উপায় নেই – একটু এদিক ওদিক হলেই চাবকে পিঠের ঝাল চামড়া তুলে দেয় আর আধমরাদের লেঠেল দিয়ে এই বিলে পাঠিয়ে দেয়। এই অত্যাচারের একটা বিহিতের জন্য আজ আপনাকে এখানে কষ্ট দিয়ে নিয়ে এসেছি যাতে ভবিষ্যতে যেন আর কাউকে এই ভাবে বিনা কারনে লেঠেলদের হাতে মরতে না হয় আর আশে পাশের সব গ্রামের লোক যেন সুখে সাচ্ছ্যন্দে বেঁচে বর্তে থাকতে পারে। আমরা সব চাষা ভূষো ছিলাম – আমাদের বুদ্ধিতে এই সমস্যার কোন সমাধান পাচ্ছি না।’
মানুষ যে কতটা অত্যাচারি হতে পারে তার কোন ধারনা নর নারায়ণের ছিলো না – আজ এক সাথে এত ঘটনা শুনে আর সেই অত্যাচারের ভুক্তভোগী এত প্রেতাত্মাদের দেখে মনে হলো মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। নর নারায়ণ নিজেকে সামলালেন – মাথা গরম করে কিছু করা যাবে না। গ্রামের লোকজনকে দিয়েও হবে না কারণ অত্যাচারের ভয়ে কেউই এগিয়ে আসবে না আর সরকারের আইন আদালতের সাহায্য চেয়েও কোন লাভ নেই – সবই জমিদারের হাতের মুঠোয়। ছায়ারা অনেক আশা নিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে – ওদের কাছে নর নারায়ণ হচ্ছেন এক মাত্র সহায়। মাথা নিচু করে অনেক ক্ষণ ভেবে ধীরে ধীরে বললেন,
‘দেখো, আমি ব্রাহ্মণ – হিংসা বা খুন জখম আমার চিন্তায় আনাও পাপ। তবে চাণক্যও ব্রাহ্মণ ছিলেন কিন্তু বৃহত্তর জনতার স্বার্থে তিনিও কূট কৌশলের আশ্রয় নিয়েছিলেন। আমার মনে হয় এর ব্যবস্থা তোমাদেরই করতে হবে – আর কোন উপায় নেই। তোমাদের তো ভয়ের কোন কারণ নেই – নতুন করে আর কোন ক্ষতি তো কেউ করতে পারবে না। প্রথমে লেঠেলগুলোর ব্যবস্থা করো – ওরাই জমিদারের প্রধান শক্তি – ওদের এক এক করে তুলে এনে এখানে বেঁধে রাখো আর এমন ভয় দেখাও যে বাছাধনদের আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয় – লেঠেলদের সর্দারকে সব থেকে আগে তুলবে।’