খেলাঘরখেলাঘর

এর মধ্যে কোথা থেকে একটা ছায়া দৌড়ে এসে পরানকে বললো,
    ‘পরানদা, এক্ষুনি একজন রাঁধুনীকে লেঠেলরা ওপাশে বিলের কাদায় ফেলে দিয়েছে – বেচারির দোষ হলো পায়েসে মিষ্টি কেন কম হয়েছে।’
    ‘নাঃ, এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না – আজ থেকেই তোমরা কাজ শুরু করে দাও। সব কটা লেঠেল যেন আজ রাত্রেই এখানে চলে আসে – তারপর জলবিছুটির ডাল দিয়ে ওদের আচ্ছা করে চাবকাবে। আগামী কাল রাত্রে এরপর কি করা যায় সেই বিষয়ে আলোচনা করা যাবে।’
        পর দিন সকালে সব কটা গ্রামে হৈ চৈ শুরু হয়ে গিয়েছে – একজন লেঠেলকেও পাওয়া যাচ্ছে না – এমন কি লেঠেলদের সর্দারও নেই। কন্দর্প কান্তি পেয়াদাদের সাথে বন্দুক নিয়ে চার দিকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন – হুমকি দিয়েছেন আজকের মধ্যে লেঠেলদের বের করতে না পারলে গ্রাম কে গ্রাম পুড়িয়ে দেবেন। গ্রামের লোকেরা ভয়ে দরজা বন্ধ করে হরিনাম জপছে। নর নারায়ণ মনে মনে হাসলেন – ওষুধ ধরেছে – এবার দ্বিতীয় পর্বের শুরু। সেদিন সন্ধ্যের পর নর নারায়ণকে পালকিতে করে পরান বিলের ধারে নিয়ে এলে নর নারায়ণ আশে পাশে কোথাও লেঠেলদের দেখতে পেলেন না তবে দূর থেকে ভেসে আসা আর্তনাদ শুনতে পেয়ে পরানের দিকে তাকাতে পরান হাসলো,
    ‘পণ্ডিত মশাই, আপনার কথা আমাদের মনে সাহস জুগিয়েছে – মনে হচ্ছে অনেক দিন আগেই এটা করা উচিত ছিলো। লেঠেল ব্যাটাদের তুলে আনতে কোন অসুবিধা হয় নি – সব কটাকে উড়িয়ে নিয়ে বিলের মাঝে একটা ছোট্ট দ্বীপে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে – ওখান থেকে কোন জ্যান্ত মানুষ চার দিকের চোরা কাদা পেরিয়ে জীবনেও এ পাড়ে আসতে পারবে না। আমাদের কয়েকজন জলবিছুটির চাবুক মেরে ওদের নাচ খুব উপভোগ করছে।’    
    ‘ঠিক আছে, এবার দ্বিতীয় পর্ব। আজ রাতেই তোমরা ওই জমিদার বাড়িতে ঢিল পাটকেল মারতে শুরু করো তবে কাউকে প্রাণে মারবে না আর কোন বাচ্চা বা মেয়েদের যেন কিছু না হয়। বাড়ির ভেতরে ও বাইরে বিলের পচা কাদাতে বাড়ি যেন বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায় আর কন্দর্প কান্তিকে বিশেষ যত্নে ওর সাধের লেঠেলদের কাছে পৌছে দিও।’
       
মাঝ রাতে জমিদার বাড়িতে প্রচণ্ড গণ্ডগোল শুরু – চারদিক থেকে ইট পাটকেল পড়তে শুরু করেছে। দারোয়ানরা গেটের পাশে খাটিয়াতে ঘুমাচ্ছিলো – ওদের গোঁফ, টিকি আর চুলের মুঠো ধরে উঠিয়ে কারা যেন সমস্ত মুখে গায়ে পচা গোবর আর কাদা মাখিয়ে দিলো। দুর্গন্ধের চোটে ওরা দৌড়ালো পুকুরের ডুব দিতে – পুকুরে নামতেই শুরু হয়ে গেলো চোবানো – হাস্‌ফাস্‌ করে জল থেকে মাথা তুললেই আবার জলে ডুবিয়ে দিচ্ছে – প্রায় আধ মরা অবস্থায় ছাড়া পেয়ে পুকুরের জলে পেট ফুলিয়ে কোন রকমে পাড়ে উঠে ওখানেই ওরা পড়ে রইলো। চেঁচামেচি শুনে পেয়াদারা বন্দুক নিয়ে ঘরের বাইরে এসে কিছুই দেখতে না পেয়ে ভয়ে এলো পাথারি গুলি চালাতে শুরু করতে হঠাৎ বন্দুকগুলো ওদের হাত থেকে বেরিয়ে উড়ে পুকুরের জলে ডুবে গেলো আর কারা যেন ওদের ধুতি লুঙ্গি টান দিয়ে খুলে হাওয়াতে ভাসিয়ে দিলো। পেয়াদারা প্রাণের ভয়ে পাঁচিল টপকে বাইরে যেতেই কারা ওদের পেছনে জলবিছুটির চাবুক মারতে মারতে গ্রামের বাইরে বের করে দিলো। এর মধ্যে সবাই হতবাক হয়ে দেখলো কন্দর্প কান্তি হাওয়াতে ভেসে চলেছেন আর আগে আগে ওর সিল্কের লাল লুঙ্গি পতাকার মত চলেছে – রাতের অন্ধকারে কন্দর্প কান্তি কোথায় হারিয়ে গেলেন কেউ জানলো না। এদিকে বাড়ির সমস্ত দরজা জানালা ভেঙ্গে প্রত্যেকটা ঘরের জিনিষ পত্রের একেবারে লণ্ড ভণ্ড অবস্থা – পচা গোবর, কাদা আর আবর্জনাতে বাড়ি ভরে গিয়েছে – দুর্গন্ধে টেঁকা যাচ্ছে না। রান্না ঘরের সমস্ত বাসন কোসন পুকুরের জলে ডুবে গেলো – উনুন ও অন্যান্য জিনিষ ভেঙ্গে একাকার অবস্থা। জামা, কাপড়, বিছানা, ইত্যাদির ছেঁড়া টুকরো বাগানের গাছে ঝুলছে। বাচ্চারা ও মেয়েরা ভয়ে তারস্বরে চেঁচাতে শুরু করেছে তবে এর মধ্যে জমিদার গিন্নীর বিলাপই সব থেকে বেশী। আধ ঘন্টা খানেক তাণ্ডব চলার পর হঠাৎ সব কিছু ঠাণ্ডা হয়ে গেলো যেন কাল বৈশাখির ঝড় থেমে যাওয়ার ঠিক পরের অবস্থা। ঝি চাকররা সব ভয়ে পালিয়ে গিয়েছে – বাড়ির বাকি লোকজন রাতটা বাইরের মাঠে বসে কাটালো। গোলমাল শুনে গ্রামের লোকেরা সব বেরিয়ে এসেছিলো কিন্তু ভয়ে দূর থেকেই দেখেছে – কাছে আসার সাহস কারুরই হয় নি।