খেলাঘরখেলাঘর




রোজ সকালে ঘুম থেকে ওঠা নিয়ে মা বাবার সঙ্গে এক প্রস্থ চেঁচামিচি হয় সাগ্নিকের। সকালবেলা এত ঘুম পায়। তার ওপর মা একবার ডাকার পরেই ভয়ানক তাড়া লাগাতে থাকে। একটা হুংকার দিয়ে মাকে চুপ করায়  তো শুরু হয়ে যায় বাবার বাজখাঁই গলায় হাঁকডাক। আজও সকালে ঘুম থেকে ওঠা নিয়ে যুদ্ধ লেগে যাচ্ছিল প্রায়। কিন্তু হঠাৎ ভজহরিদার কথা মনে পড়ে গেল সাগ্নিকের। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে দিল ছুট। বাড়ির পেছনের ছোট পুকুরটার সান বাঁধানো ঘাটে বসে বসে বেশ কয়েকটা ঢিল ছোঁড়ে। জলের ঢেউগুলোর দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অনুভব করে ম্যাজিকের মতো কখন যেন সত্যিই ওর রাগটা গায়েব হয়ে গেছে আর এই সুন্দর সকালটার মতো ঝকঝকে আলোময় হয়ে উঠেছে মনটা। নতুন শেখা রাগ কমানোর ম্যাজিকটা ওকে টগবগে আর উত্তেজিত রাখে বেশ কয়েকদিন।

একদিন স্কুলে পৌঁছতে দেরি হওয়ায় হেডস্যার খুব বকলেন। মেজাজ গুম হয়ে রইল। তারপর টিফিন টাইমে খাবে বলে সবে টিফিন বাক্সটা খুলেছে এমন সময় পলাশ এমন ধাক্কা দিলো যে সব খাবার পড়ে গেল মাটিতে। ও পলাশের চুলের মুটি ধরে দিল এক চাপ্পড়। পলাশ গিয়ে স্যারকে বলে দিল। স্যার এসে ওকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে দিল বেঞ্চের ওপর। মাথা গোঁজ করে দাঁড়িয়ে রইল সারা টিফিন। রাগে দুঃখে চোখে জল এসে যাচ্ছিল।
স্কুল থেকে ফেরার পথে পড়ে রন্টুদার সাইকেল সারানোর দোকান। রন্টুদা ওকে দেখেই ডাক দেয়,
-    সাইকেল চড়বি নাকি?
সাইকেলের কথা শুনে গুটিগুটি পায়ে রন্টুদার দোকানে এসে ঢোকে। একটা সাইকেল এগিয়ে দিয়ে রন্টুদা বলে,
-    এই সাইকেলটা আজই সারিয়েছি। যা, একটা টেস্ট ড্রাইভ দিয়ে আয়।
সাইকেল উঠে জোরে পা চালায়। পৌঁছে যায় সেই আমলকী বাগানে। রাগ কমানোর জন্যে পুকুরপাড়ে বসে ঢিল ছুঁড়তে শুরু করে। কিন্তু কোন লাভ হয়না। বাড়ি ফিরে যাবে ভাবতে না ভাবতে ভজহরিদা হাজির।
-    আজ খোকাবাবুর মন ভালো নেই কেন?
-    এতগুলো ঢিল ছুঁড়লাম তাও আমার রাগ ভালো হল না।
-    রাগ হল কেন?
-    রাগ হবে না!! পলাশ ধাক্কা মেরে আমার সব টিফিন ফেলে দিল তার বেলা কিছু না। অথচ আমি ওকে এক ঘা মেরেছি বলে স্যার আমাকে সারা টিফিন ব্রেকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখল।
-    বুঝেছি। এটা ঢিল রাগ নয়, মিল রাগ। পেট ভরে খাবার মিললেই ভালো হয়ে যাবে।
ভজহরিদা মুহূর্তের মধ্যে কোথা থেকে অনেকগুলো আম নিয়ে হাজির। বলল,
-    আমগুলো পুকুরের জলে ধুয়ে হাত দিয়ে সারা গা চটকে নরম করে ফেল। তারপর ডগার দিকে দাঁত দিয়ে কেটে একটা ফুটো করে মুখ লাগিয়ে খা।
ভজহরিদার কথা মত ও আমটা ধুয়ে, চটকে, ডগায় একটা ফুটো করে মুখ লাগিয়ে টান দেয়।
-    আঃ!! কি দারুন খেতে ভজাদা। একেবারে আসল ফ্রুট জুস।
-    রাগ কমল এইবার?
-    একদম ভ্যানিশ। আচ্ছা, তুমি রাগ নিয়ে এতো কিছু জানো কি করে ?
-    জানতেই হয়। আমাদের স্কুলে রাগ নিয়ে অনেক লেখাপড়া করতে হয়। রাগ কন্ট্রোল করতে না পারাটা ভূতকূলের এক বড় সমস্যা।
-    কি রকম ?
-    ভূতেরা ইচ্ছে মতন অদৃশ্য বা সশরীরী হতে পারে। কিন্তু রাগ হলে এই ক্ষমতা লোপ পেয়ে যায়। তখন ভূতেরা ইচ্ছে করলেও আর অদৃশ্য হতে পারেনা। ফলে আশেপাশে কোন মানুষ থাকলে তারা ভূতদের দেখে ফেলে আর অজ্ঞান হয়ে যায়।  আমাদের জন্যে এটা খুব নিন্দনীয় ব্যাপার।
-    তোমরা এসব নিয়ে এতো ভাবো?
-    এই নিয়ে রীতিমত রিসার্চ হয়। রিসার্চে দেখা গেছে যে ভূতেরা যদি দশ সেকেন্ডের কম দেখা দেয় তাহলে মানুষরা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেও অজ্ঞান হয়না। চোখ বন্ধ করে চোখ কচলে আবার যখন তাকায় ততক্ষনে ভূত ভ্যানিস। কিন্তু দশ সেকেন্ডের বেশি থাকলে সাধারনতঃ মানুষরা অজ্ঞান হয়ে যায়। এমনকী হার্ট ফেল করে মারাও যেতে পারে। একমাত্র পাগলরা মিনিট পাঁচেক দেখেও অজ্ঞান হয় না।
-    কি ভাবে রাগ কমানো শেখায় তোমাদের?
-    রাগ কমানো নয় রাগ কন্ট্রোল করা শেখায়। অনেক বই পড়তে হয়। প্রাক্টিস করার জন্যে অনেক ভিডিও গেমস খেলতে দেয়। পরীক্ষাও নেওয়া হয় ভিডিও গেমস খেলেই।
-    কিরকম খেলা সেগুলো?
-    খেলায় অনেক লেভেল আছে। প্রত্যেক লেভেলে নানারকম ঘটনা ঘটিয়ে আমাদের রাগিয়ে দেওয়া হয়। রেগে গেলে মানুষের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মেপে দেখা হয় কে কত তাড়াতাড়ি রাগ কন্ট্রোল করে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে। এরকম একশোটা লেভেলে পেরোতে পারলে তবেই পাস।
-    আমারও খুব রাগ হয়ে যায় জানো। রাগ হলে আমি অনেক ভুল কাজ করে ফেলি। এমনকি পড়াও মনে করতে পারিনা। স্কুলে সব বন্ধুরা আমার পেছনে লাগে।
-    রাগ তো সবারই কম বেশী হয়। কিন্তু রাগকে কন্ট্রোল করতে পারলেই কেল্লা ফতে। রাগ হবে তোর পোষা কুকুরের মতো।
-    মানে?
-    ধর তোর একটা কুকুর আছে। তার গলায় একটা চেন বাঁধা। চেনটা তুই শক্ত করে ধরে আছিস। এখন কুকুর যেদিকে যাবে তুই কি সেদিকেই যাবি নাকি তুই যেদিকে যেতে চাইবি কুকুরটাকে সেদিকেই নিয়ে যাবি?
-    আমি যেদিকে যেতে চাইবো সেদিকেই কুকুরটাকে নিয়ে যাবো।
-    হ্যাঁ ঠিক সেরকম। তোকে তোর রাগকে পোষা কুকুরের মতো কন্ট্রোলে রাখতে হবে। তুই যদি চাস তো আমি তোকে দুদিনের একটা ক্র্যাশ কোর্স করিয়ে দিতে পারি।