৩
মাঝে মাঝে স্কুল থেকে ফেরার সময় সাগ্নিক রন্টুদার দোকানে ঢুঁ মারে। সাইকেল জোগাড় হলে চলে আসে আমলকী বাগানে। ভজহরিদার দেখা মিললে একটু গল্প গুজব হয়। একদিন দেখে, জলে টুপ টাপ একের পর এক ঢিল পড়ছে।
- কি ব্যাপার আমাকে দেখেও দেখা দিচ্ছ না যে।
অদৃশ্য ভজহরিদা সশরীরে দেখা দিল। মুখটা ম্রিয়মান। দুঃখী গলায় বলল,
- আমি পরীক্ষায় ফেল করেছি।
- তাতে কি হয়েছে? পরের বছর ভালো করে পড়ে আবার পরীক্ষা দেবে।
সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করল সাগ্নিক।
- ভূতসমাজে ফেল করলে শাস্তি দেওয়া হয়।
- এমন নিমপাতা মার্কা যাচ্ছেতাই নিয়ম কে বানিয়েছে?
- আমাদের মাননীয় সরকার।
- তোমাদেরও সরকার আছে?
- থাকবে না? এত বড় দেশ। রীতিমত ভূততান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার নির্বাচন করা হয়।
- শাস্তিটা কি?
- খুব অপমানজনক শাস্তি!! যারা পরীক্ষায় ফেল করে তাদেরকে এক ডোজ করে ভূতজোলাকিয়া খাওয়ানো হয়। তাতে সেই ভূত পরবর্তী এক শতাব্দীর জন্যে ভূতঘুমে চলে যায়।
- একশো বছর ধরে ঘুমাবে? কি অদ্ভূত শাস্তি !!
- হ্যাঁ। ফলে একশো বছরের জন্যে সরকার নিশ্চিন্ত। তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে না। তাদের রাগ নিয়েও ভূত বা মনুষ্য সমাজে কোন সমস্যা তৈরী হবে না।
- কিন্তু তুমি আমাকে এতো ভালো রাগ কন্ট্রোল করা শিখিয়েছ। তুমি ফেল করলে কেন?
- ঐ যে সেদিন তোর সঙ্গে সশরীরে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলাম। ওরা ভেবেছে আমি আমার রাগ কন্ট্রোল করতে পারিনি। আসলে সেদিন তুই আমাকে দেখে একটুও ভয় পাসনি, বন্ধুর মতো কত গল্প করলি। তাই আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে তুই মানুষ আর তোর কাছে আমার অদৃশ্য থাকা উচিত।
- বুঝেছি। তুমি আমাকে তোমাদের হেডস্যারের কাছে নিয়ে চলো। আমি বুঝিয়ে বললে তিনি নিশ্চয় বুঝবেন।
ঝটিকা সফর। ওরা এসে পৌঁছলো এক শুনশান জায়গায়। এক দিকে ঘন বাঁশবন। বাঁশের গায়ে বাঁশ লেগে থেকে থেকে কটাকট্ট্ট্করে আওয়াজ হচ্ছে। অন্যদিকে দিগন্ত বিস্তৃত ফাঁকা মাঠ। আকাশে সরু একফালি চাঁদ। কেউ কোত্থাও নেই। এমনকী কোন ব্যাং বা ঝিঁঝিঁর ডাক পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না। ভজহরিদা ফিসফিসিয়ে কি সব কথা বলল। তারপর আস্তে আস্তে চারপাশে দৃশ্যমান হতে থাকল আর এক দুনিয়া।
ঘরের মধ্যে ওরা দাঁড়িয়ে। চারিদিকে চেয়ার টেবিল, কম্পিউটার। অসংখ্য ভূত কাজ করছে। কেউ কেউ ব্যাস্ত হয়ে এদিক ওদিক যাতায়াত করছে। একটা বিশাল ভুঁড়িওয়ালা ভূত ভজহরিদার সঙ্গে কী সব আলোচনা করল। তারপর ওকে ধরে ঢুকিয়ে দিল একটা ছোট্ট কাঁচের ঘরে। সেখানে অনেক যন্ত্রপাতি। লাল নীল সবুজ রঙের আলো জ্বলছে। বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে সাগ্নিক জিগ্যেস করল,
- আমাকে এই ঘরে পুরে দেওয়া হল কেন জানতে পারি?
ভুঁড়িওয়ালা ভূত বলল, নিশ্চয়। এই যে এতগুলো ভূত একসঙ্গে দেখেও তুমি অজ্ঞান হচ্ছ না। আমরা আমাদের ভূতবুদ্ধিতে এটার ব্যাখ্যা করতে পারছি না। আমাদের ধারণা তুমি কোন বিশেষ গুনের অধিকারী। তাই আমরা একটু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখতে চাই।
সেই ঘরে একটা বেঁটে গুড়গুড়ে ভূত বুট জুতো পরে কম্পিউটারে নিয়ে বসেছিল। তার স্ক্রিনে ফুটে উঠতে থাকল নানান রকম ছবি। মাত্র কয়েক মিনিট। তারপরেই সে মতামত দিল যে, ওর মাথায় গিজগিজ করছে রাগ। সেই জন্যে সাধারন নিয়মগুলো কাজ করেনি।
সাগ্নিক বলল, হ্যাঁ আমার রাগ একটু বেশী। কিন্তু ভজহরিদাকে সশরীরে দেখেও অজ্ঞান না হয়ে যাওয়াটাতে ওর কোন দোষ ছিল না। তাই ওকে শাস্তি দেওয়াটা মোটেই তোমাদের উচিত হবে না।
ভূঁড়িওয়ালা ভূত বলল, সেদিন ভজহরি তোমার সঙ্গে সশরীরে প্রায় আধঘন্টা কথা বলেছিল। এটা আমাদের সর্বোচ্চ মাত্রার অনেক বেশী।
- হতে পারে। কিন্তু সেটার সঙ্গে রাগের কোন সম্পর্ক নেই। আমি ওকে দেখে এমন গল্প জুড়েছিলাম যে ভজহরিদা অদৃশ্য হতে ভুলে গিয়েছিল।
- গল্প করতে গিয়ে সাধারন নিয়ম কানুনগুলো ভুলে যাওয়ার ফল তো খুব মারাত্মক হতে পারে। ভূত ও মানুষ উভয়ের পক্ষেই এটা ক্ষতিকারক।
- বন্ধুর সঙ্গে বন্ধু গল্প করলে ক্ষতি হবে কেন? তোমরা মানুষদের বন্ধু ভাবতে পারো না আর মানুষরাও তোমাদের বন্ধু ভাবে না তাই তো এত ঝামেলা। নাহলে মানুষরা তোমাদের দেখে অজ্ঞান হত না আর ভূতেদেরও এত নিয়ম কানুন আবিষ্কার করতে হত না।
সেই বেঁটে গুড়গুড়ে ভূতটি এতক্ষন চুপচাপ সব শুনছিল। এখন এগিয়ে এসে বলল,
- আমি এই স্কুলের হেডস্যার। আমি ভজহরির শাস্তিটাকে তুলে নিতে পারি। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে। তোমাকে রাগ কমাতে হবে। কারন রাগ ভূতজগতে এবং মনুষ্যজগতে সমান নিন্দনীয় ও ক্ষতিকারক। আমাদের রিসার্চের রেজাল্ট অনুযায়ী ইচ্ছে থাকলে ও চেষ্টা করলে আশি শতাংশ পর্যান্ত রাগ সহজেই কমানো সম্ভব। এব্যাপারে ভজহরি তোমাকে প্রয়োজনীয় ট্রেনিং দিয়ে দেবে। তোমাকে ঠিকঠাক শিক্ষা দিতে পারলে ভজহরির শাস্তি তুলে নেওয়া হবে।
ভজহরি চেঁচিয়ে বলে উঠলো, আমি রাগ ম্যানেজমেন্টের একটা ক্র্যাশ কোর্স ওকে আগেই করিয়ে দিয়েছি।
হেডস্যার শুনে অবাক। বলল, পরীক্ষা দিতে পারবে?
পরীক্ষার কথা শুনে বুকটা একটু কেঁপে গেল সাগ্নিকের। ভজহরিদা কানে কানে বলল,
- আরে, এই সুযোগে তুই ভিডিও গেমস খেলতে পাবি।
শুনে সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় নেড়ে সম্মতি দিল ও।
ওকে বসিয়ে দিল একটা অদ্ভূত দেখতে কম্পিউটারের সামনে। মাথায় লাগিয়ে দিল হেলমেট।
- ভজহরিদা, মাউস নেই, কী বোর্ড নেই। কি করে খেলবো?
- কিচ্ছু লাগবে না। মাথায় ওটা লাগানো আছে না? যা ভাববি তাই ঘটতে থাকবে। দেখ না কি হয়। শুধু মনে রাখবি বুদ্ধিমানেরা কখনো রাগ করে না ।
সে এক রূদ্ধশ্বাস উত্তেজনাময় খেলা। যেন অন্য এক পৃথিবীতে এসে পড়েছে। যেখানে ওর বাড়ি, স্কুল সবই আছে, আছে এমনকি ওর পরিচিতরাও সবাই। সবাই নানা ভাবে ওকে রাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু আজ সে কিছুতেই রাগল না। যখন খেলা শেষ হলো তখন তার মুখ ভর্তি জয়ের হাসি।
যারপরনাই খুশী ভজহরিও। পরীক্ষায় সসম্মানে উর্ত্তীর্ন হল সাগ্নিক। ভজহরির শাস্তি তো মকুব হলই। উপরন্ত হেডস্যার ঘোষণা করলেন যে, ভজহরি রাগ নিয়ে রিসার্চের দুনিয়াতে ভূতেদের জন্যে একটা নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। তাই ওকে স্কুলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করা হবে। এবং ভূতসমাজ ছাড়িয়ে মনুষ্যসমাজের জন্যেও ওর এই বিশেষ অবদানের জন্যে ওকে একটি পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হবে।
রুচিরা
ব্যাঙ্গালোর, কর্ণাটক
ছবিঃ
কৌস্তুভ রায়
কলকাতা