শুরু হয়ে গেল নাটকের রিহার্সাল। সবাই মিলে হাত লাগিয়ে বানিয়ে ফেলা হল নাটকের সেট। পোষাক বানাতে দেওয়া হল বলিউড টেইলার্সে। পরমহংস স্যারের সঙ্গে গিয়ে ইলেক্ট্রিক আর মাইকের দোকানেও কথা বলে আসা হল এক সময়ে। স্কুলছুটির পর হলঘরে শুরু হল আমাদের মহড়া। রিহার্সালে দ্রাঘিমাংশ এসে চুপটি করে বসত আমার পাশে। মনোযোগ গিয়ে সব দেখত। মহড়া শেষ হলে গুটিগুটি ফিরে যেত বাড়ির দিকে।
এসে পড়ল আমাদের নাটক প্রতিযোগিতার দিন। পাঁচটার সময়ে আমাদের নাটক। ঠিক সময়ে রবীন্দ্র ভবনে এসে পড়লাম সবাই।শুধু নক্ষত্র রায়ের পার্ট যে করবে সেই রণজয়ের তখনও কোনও পাত্তা নেই। পরমহংস স্যার পায়চারি করছেন আর ঘড়ি দেখছেন বারবার। পাঁচ মিনিট যায়, দশ মিনিট যায়, রণজয়ের দেখা নেই।
চারটের সময়ে রণজয়ের কাকা স্কুটার চালিয়ে এলেন রবীন্দ্র ভবনে। আমরা সবাই ঘিরে ধরলাম তাঁকে। ভদ্রলোক বললেন, দাদার সকাল থেকেই বুকে ব্যথা করছিল। ডাক্তারের কথামত হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। ওঁর হার্টের অবস্থা ভাল নয়। রণজয় বাবার কাছে আছে, ওর পক্ষে আজ আর অভিনয় করা সম্ভব নয়।
পরমহংস স্যার শুকনো গলায় বললেন, সর্বনাশ! নক্ষত্র রায়ের পার্ট কে করবে এখন?
সবাই চুপ। পরমহংস স্যার এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন যেভাবে বানভাসি মানুষ আঁকড়ে ধরার জন্য খড়কুটো খোঁজে। হটাত করে আমার দিকে তাকিয়ে বড় বড় চোখ করে বললেন, তুই তো এতদিন প্রম্পটিং করেছিস। তুই পারবি না চালিয়ে দিতে?
আমি থতমত খেয়ে বললাম, আমার সকাল থেকেই কেমন গা গুলোচ্ছে, আমি পারব না স্যার।
দ্রাঘিমাংশ পাশ থেকে বলল, আমি পারব।
পরমহংস স্যার বিস্মিত হয়ে বললেন, পাগল নাকি? পার্ট মুখস্থ না হলে কেমন করে ম্যানেজ করবি তুই?
দ্রাঘিমাংশ বলল, শুধু নক্ষত্র রায় কেন, একমাস ধরে মহড়ায় শুনে শুনে প্রত্যেকটা চরিত্রের পার্ট আমা্র আগাগোড়া মুখস্থ। শুনিয়ে দেব?
পরমহংস স্যার অসহায়ের মত ঠোঁট কামড়ালেন। তারপর দ্রাঘিমাংশর কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, যা, তুই গ্রিনরুমে গিয়ে মেক আপ করে নে। তারপর যা আছে কপালে।
শুরু হল আমাদের নাটক। রঘুপতির ভূমিকায় দারুণ অভিনয় করল সুমন। গোবিন্দমাণিক্য আর জয়সিংহের চরিত্রে প্রচুর হাততালি পেল অক্ষাংশ আর কৌশিক। এমনকী গুণবতী আর অপর্ণার রোলেও দিব্যি মানিয়ে গেল রাজেশ আর সোমনাথকে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে নক্ষত্র রায়ের রোলে জমিয়ে দিল দ্রাঘিমাংশ। মনেই হল না একটুক্ষণ আগেই সে জানতে পেরেছে যে তাকে নক্ষত্র রায় সাজতে হবে। রঘুপতির প্ররোচনায় সিংহাসনে বসার লোভ কখনও চকচক করছে নক্ষত্র রায়ের চোখে। ওদিকে আবার দাদা গোবিন্দমাণিক্যর সামনে জড়োসড়ো হয়ে যাচ্ছে নক্ষত্রর ক্ষুদ্র ব্যক্তিত্ব। দ্রাঘিমাংশ এত সুন্দর তার চরিত্রটা ফুটিয়ে তুলল যে জাজ্রা পর্যন্ত হাততালি দিয়ে উঠলেন সামনের সারি থেকে।
নাটক প্রতিযোগিতায় প্রায় সব প্রাইজ জিতে নিল আমাদের বিন্দুবাসিনী বয়েজ। সেরা নির্দেশকের প্রাইজ পেলেন পরমহংস স্যার। সুমন পেল শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরষ্কার। নক্ষত্র রায়ের চরিত্রকে প্রাণদান করার জন্য দ্রাঘিমাংশ পেল বিশেষ পুরষ্কার। কুশীলবের প্রেসিডেণ্ট গ্রিনরুমে এসে দেখা করে গেলেন দ্রাঘিমাংশর সাথে। বললেন, তোমার ভেতরে নাটক আছে, তুমি অনেকদূর যাবে।
গ্রিনরুমে মেক আপ তুলছে নাটকের অভিনেতারা। আমরা সাহায্য করছি তাদের। পরমহংস স্যার কখন যেন এসে দাঁড়িয়েছেন আমাদের মধ্যে। বড় একটা শ্বাস ফেলে পরমহংস স্যার বললেন, বেশ কয়েকবছর আগে কুশীলবের রিহার্সালে গিয়েছিলাম আমি। আমার ধারণা ছিল যে মূল চরিত্রে অভিনয় না করতে পারলে অভিনয় করাই বৃথা।
আমরা তাকিয়ে আছি তাঁর দিকে। পরমহংস স্যার বললেন, আজ বুড়ো বয়সে আমার ছেলের কাছ থেকে এক বিরাট শিক্ষা পেলাম আমি।আসলে ছোট পার্ট বড় পার্ট বলে কিছু হয় না। ভাল অভিনয়টাই আসল, অন্য কিছু নয়। প্রত্যেক অভিনেতা সমান তালে অভিনয় না করলে কখনওই একটা সার্থক নাটক সৃষ্টি হয় না। শুধু তাই নয়, মঞ্চের বাইরে থেকে যারা রূপসজ্জা করে, আলোর কাজ করে, প্রপস্ সাজায় কিংবা শব্দ সংযোজনা করে তারা প্রত্যেকেই একটা বড় চাকার ছোট ছোট নাট বল্টুর মত গুরুত্বপূর্ন অংশ।
সবার চোখ চকচক করছে খুশিতে। সবাই আলিঙ্গন করছে দ্রাঘিমাংশকে। শেষে আমার টার্ন এল। আমি ওকে জড়িয়ে ধরতেই আমার কানের কাছে মুখটা এনে দ্রাঘিমাংশ বলল, তুই অত দাঁত ক্যালাচ্ছিস কেন, সবার ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। প্রম্পটারের কথা কিন্তু কিছু বলা হয়নি!
আমি হাঁ করে তাকালাম ওর দিকে। আমার পিঠে একটা চাপড় মেরে হো হো করে হেসে ফেলল দ্রাঘিমাংশ।
ছবিঃ
কৌস্তুভ রায়
কলকাতা