৩
দুটো দিন কেটে গেছে।
বেশ খুশী খুশী মনে চিলেকোঠার ঘরটায় এলেন পটলবাবু। পা মচকে গেছে বলে গোবিন্দকেও কয়েকদিনের জন্য ঠেকিয়ে রাখা গেছে। গিন্নীকেও রওনা করে দিয়েছেন দিল্লীর পথে। রিটার্ন টিকিট কেটে দেওয়া নেই। কাজেই এখন কয়েক দিনের জন্য নিশ্চিন্ত। নাতিকে পেয়ে প্রতিমা কয়েকটা দিন সুখেই কাটাবেন নিশ্চয়ই। যখন তাঁর ছেলে শ্যামল দিল্লীতে চাকরিটা পেয়ে গেল,তখন একদিক থেকে স্বার্থপরের মত একটু খুশিই হয়েছিলেন পটলবাবু। তারপরে মেয়ে নীলার বিয়েও হয়েছে পুনেতে। এখন বাড়ি ফাঁকা পেয়ে বেশ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি। চিলেকোঠার ঘরটায় কেউ বড় একটা আসেনা। আসবেই বা কেন? এখানে তো তেমন কিছু নেই। থাকার মধ্যে পুরনো কাঠের একটা আলমারি, একটা চৌকি, একটা ইজিচেয়ার আর পুরনো কাগজ, ম্যাগাজিন এইসব। এই ঘরটাই গবেষনাগার তৈরী করার পক্ষে আদর্শ।
পুরনো কাগজের মধ্যে চাপা পড়ে থাকা একটা খাতা বের করে আনলেন তিনি। ছাত্রজীবনে যা নোটস ছিল তা অনেকদিনই হারিয়েছে। তবে সম্প্রতি নতুন করে প্ল্যান করা শুরু করেছিলেন তিনি। ল্যাব তৈরী করতে খরচ খরচা লাগবে আন্দাজ করে আগে থেকে কিছু টাকাপয়সাও জমা করে রেখেছিলেন। ইজিচেয়ারে বসে নোটসগুলো একটু ঝালিয়ে নিতে শুরু করলেন পটলবাবু। অনেক কিছু লাগবে এখানে। একটা পাথর বসিয়ে তার ওপরে বুনসেন বার্নার, টেস্ট টিউব, বকযন্ত্র, চারকোল এইসব তো লাগবেই। অন্যদিকে থাকবে একটা ব্ল্যাকবোর্ড। আরেক পাশে ড্রয়িং এর ব্যবস্থা। ইলেকট্রনিক্সের ছোটখাট সার্কিট বোর্ড, আইসি, রেসিস্টেন্স, ট্রান্সিটর, এলইডি আরও কত কি। যেমন ভাবা তেমন কাজ শুরু হয়ে গেল। ল্যাবরেটরি হই হই করে গজিয়ে উঠল।
প্রথমে কি নিয়ে কাজ শুরু করবেন একটা ঠিক করতে একটু অসুবিধেয় পড়লেন। একবার ভাবলেন একটা রোবটের প্রোটোটাইপ বানাবেন অর্থাৎ ছোটোখাট একটা মডেল রোবট। তবে রোবট তৈরী তো আর সহজ কথা নয়। যেমন মেকানিক্স বুঝতে হবে, তেমনি ইলেকট্রনিক্স।
ল্যাবরেটরিতে ঢুকলে যে বাবু আর বাবু থাকেন না সেটা প্রথম বুঝতে পারল বাড়ির চাকর খেঁদু। নাওয়া খাওয়ার ঠিক নেই। কারো সাথে কথা বলেন না। দেখা করেন না। রাতেও অনেকক্ষন ধরে কাজ করতে থাকেন। শব্দ পাওয়া যায়। তাও আবার এক এক সময় এক এক রকম। কখনও আস্তে, কখনও জোরে। কখনও লোহা ঘষার, কখনো করাতের। আবার কখনো বা হাতুড়ি পেটার। তিনতলার ঘরে আবার একটা চিমনি হয়েছে। তাতে এক এক সময় এক এক রঙের সব ধোঁয়া বেরোতে দেখা যায়। গিন্নীমা নেই। আর খেঁদুর এত সাহস নেই যে সে বাবুকে গিয়ে কিছু বলে। সে কাজে নতুন বহাল হয়েছে। আগের লোকটিকে কেন ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সেই নিয়ে তার ঠিক ধারনা নেই। আর গ্রামের বাইরে এই প্রথম সে এসেছে। শহরের গতিক ঠিক এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। এদিকে বাবুর শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে। দাড়ি টাড়ি কামান তো উঠেই গেছে।
ওদিকে বাবুর এক বন্ধু এসে দিনে দুবার করে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে। বেশ লম্বা চওড়া চেহারা। তার ওপরে বুড়ো বয়সে শরীরের গঠন এক্কেবারে মজবুত। কথা শুনলে হাত পা গুলো যেন সেঁধিয়ে যায় পেটের ভেতরে। বাবু বলে রেখেছেন, যে কেউ এলেই যেন বলা হয় পুনেতে মেয়ের কাছে গেছেন। আর সকলকে তো না হয় সেই কথা শোনান যাচ্ছে, কিন্তু এই একটা লোকের সামনে মিথ্যে বলতেই যেন থরথর করে কেঁপে ওঠে খেঁদু। আর যেখানেই বাঘের ভয়, সেইখানেই সন্ধ্যে হয়। বেলা এগারোটা নাগাদ গোবিন্দবাবু এসে হাজির।