সে দিন তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে গেল। স্কুলবাস রানীকে ঘরে পৌঁছে দিল। স্কুলের আগে ছুটি হবার কথা কারো জানা ছিলো না,তাই রানীকে নীচে থেকে নিয়ে যেতে কেউ এলো না। একটু সময় সে চুপ চাপ বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। এমনি সময় তার মনে পড়ল বন্ধুর কথা। ও তাকালো সামনের বস্তির দিকে। ওই যে বস্তির ঘরগুলি।এরই একটাতে থাকে তার বন্ধু। রানী এগিয়ে গেল।খুঁজতে লাগলো সেই ঘরটা যাতে থাকে তার বন্ধু.এখনো সে বন্ধুর নাম জানে না!
রানী চিনতে পারলো,ওই তো ঐটাই রাজাদের ঘর।এগিয়ে গেল ও।বাঁশ কঞ্চির তৈরী দরজা,বাইরে থেকে ঘরে কেউ আছে বলে মনে হলো না।কাছে গিয়ে দরজার ফাঁকা দিয়ে উঁকি মারলো রানী।শুরুতে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই তার চোখে পড়ল না।কিছু সময় পরেই ও দেখতে পেল,ঘুমোচ্ছে,তার বন্ধু ঘুমোচ্ছে! ঘরে আর কেউ নেই!
বন্ধুকে ডেকে উঠলো সে,এই,এই,এই...না,কোনো সাড়া নেই। এবার দরজায় ধাক্কা লাগলো রানী,একবার, দুবার,তিনবার,না ঘুম ভাঙ্গে না!দরজায় চড়ে চীত্কার করে ডাকবে কি না ভাবলো,দরজার ওপর অনেকটা ফাঁকা। ও ভাবলো দরজায় চড়ে ওই ফাঁকা জাগা দিয়ে ওকে ডাকলে কেমন হয়!দরজায় দুপা উঠতে গিয়েই ঘটে গেল বিপদ।লড়বড়ে দরজা নিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেলো রানী. একেবারে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়ল।আচমকা ভয় পেয়ে গেল ও।পড়ে গিয়েই জোরে চীত্কার করে কেঁদে উঠলো।ওদিকে রাজার ঘুম ভেঙে গেল,সেও ভয় পেয়ে কেঁদে উঠলো। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে দু তিন বার কান্নার সুর টেনে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলো!উভয়ের মুখে ধীরে ধীরে হাসি ফুটল।
রানী বলল,তোর নাম কি?
রাজা আধো কথা বলতে শিখেছে।খানিক তুতলে সে বলে উঠলো,নাজা!
--আমার নাম রানী.তুই আমায় চিনিস?রানী প্রশ্ন করল।
কথা বলল না রাজা,এক ধরণের চিনতে পারার হাসি হাসল।
--জানিস আমি ওই বাড়িতে থাকি,বলে আঙ্গুল দিয়ে রাস্তার ও পারের বড় বাড়িটা দেখিয়ে দিল রানী।
রাজা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকলো,তারপর ওপরে যেখানে রানী দাঁড়িয়ে থাকে রাজা তার আঙ্গুল দিয়ে সে জায়গাটা দেখালো।আর হাসতে হাসতে বলতে লাগলো,উখানে,উখানে ...
তুই কি খেলিস দেখাত আমাকে?চল আমরা খেলব.রাজাকে রানী বলে।
রাজা পরম উত্সাহে ঘরের এক কোন থেকে সব টেনেটুনে বের করে আনে। খেলার সমস্ত সরঞ্জাম তাতে রাখা।
রানীর খুব ভালো লাগলো।রাজার ছোট,বড়,সাদা,লাল,কালো,নানা রঙের পাথরগুলি,সত্যি দেখতে বেশ সুন্দর--এমন জিনিস তো তার কাছে নেই!
রাজাদের ঘর খুব নোংরা,ভাঙা,রানীর একদম ভালো লাগলো না.কিন্তু রাজা?সে তো ভালো,সুন্দর হাসে,সুন্দর আধ-আধ কথা বলে!দূর থেকে ইশারায় তাকে ডাকে।যেন কত দিনের বন্ধু ওরা!
এদিকে সময় কেটে গেছে অনেক।এতক্ষণ নিয়ম মত স্কুল বাসের এসে যাবার কথা। রানীর মা বাসের অপেক্ষায় ঘরবার করছেন।ব্যালকনি থেকে বারবার বাস এলো কিনা দেখছেন।কে জানে,এত দেরী হচ্ছে কেনো বাস আসার!
অগত্যা স্কুলে ফোন করা হল। জানা গেলো বেলা একটায় আজ ছুটি হয়ে গেছে।শুনে ভয় পেয়ে গেলেন রানীর মা।
ঘরের চাকর দীনু। ওকে পাঠানো হলো নীচে।রাস্তার আশপাশ,অলি গলিতে খুঁজে দেখতে।
রানীকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।রানীর বাবাকে ফোন করা হলো।খবর শুনে রানীর বাবা আঁতকে উঠলেন...আমি এক্ষুনি আসছি,বলে ফোন রাখলেন তিনি।
তখন সন্ধ্যে হয় হয়।রানীর মা কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে গেলেন।রানীর বাবা স্কুলে খোঁজ নিতে গেলেন।
এমনি সময় রানীর বাড়ির কথা মনে পড়ল। ধীরে ধীরে বন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো।
মা কাঁদতে কাঁদতে ঘরের দরজার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন।সামনে মেয়েকে দেখে,কোথায় ছিলি,বলে জাপটে ধরলেন।
--আমি না বন্ধুর বাড়ি গিয়ে ছিলাম,রানী বলে ওঠে।
এবার ধমকে ওঠেন মা,না বলে কেন গিয়ে ছিলে?জানো না আমরা তোমার জন্যে কত চিন্তা করছি!
--কোথায় গিয়েছি!এই তো পাশে,সহজ ভাবে রানী বলে ওঠে।
--চুপ!আমরা চিন্তা করি তুমি জানো না বুঝি?মা আবার ধমকান।
--ঠিক আছে,না বলে আর যাব না,কেমন?রানী পাকা বুড়ির মত বলে চলে,আমার বন্ধু ওখানে থাকে তাই একটু গিয়ে ছিলাম।
মা আর থাকতে পারলেন না,মেয়েকে জাপটে ধরে কাঁদতে থাকলেন।