সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
একটা ছোট্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে

অনেক, অনেকদিন আগে, রাশিয়ার বিস্তীর্ণ স্তেপ অঞ্চলে একটা ছোট্ট গ্রাম ছিল। সেই গ্রামের অধিবাসীদের ঘোড়া পালন করাই প্রায় সবার অন্যতম জীবিকা ছিল। প্রত্যেক বছরে অক্টোবর মাসে সদর শহরে গবাদি পশুর একটা বিরাট বাজার বসত। একবার কী হল, দুই ভাই, যাদের একজন পয়সাওলা আর একজন গরিব, তারা দুজনে মিলে সেই বাজারে গেল। পয়সাওলা ভাই গেল একটা ঘোড়ায় চড়ে, আর তার গরিব ভাই গেল একটা অল্পবয়সী ঘুড়ীর পিঠে চেপে।

সন্ধের মুখে তারা একটা ফাঁকা কুঁড়েঘরের পাশে এসে থামল আর দুটো খড়ের গাদায় দুজনে শুতে যাওয়ার আগে তাদের ঘোড়াগুলোকে ঘরের বাইরেটায় বেঁধে রাখল। পরের দিন সকালে দুটোর জায়গায় তিনটে ঘোড়া দেখে তারা যারপরনাই অবাক হয়ে গেল। ও, ভালো কথা, নতুন যে এসেছে, সে কিন্তু একটা বড়ো ঘোড়া নয়। সেটা ওই ঘুড়ীটার বাচ্চা। রাত্তিরে ঘুড়ীটা ওকে জন্ম দিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা পেল, আর একবার মায়ের দুধ খেয়েই, নড়বড় করতে করতে জীবনের প্রথম কয়েক পা হাঁটল। পুরুষ ঘোড়াটা একটা আনন্দের চিৎকার করে তাকে অভিনন্দন জানাল। ভাই দুজন যখন ঘুড়ীর বাচ্চাটাকে প্রথম দেখল, তখন সে ঘোড়াটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

'এটা আমার!' বাচ্চাটাকে দেখামাত্র বলে উঠল বড়োলোক দিমিত্রি। 'এটা আমার ঘোড়াটার বাচ্চা।' এই শুনে গরিব ইভান হাসতে লাগল।

'ঘোড়ার বাচ্চার কথা কে কবে শুনেছে? এটা আমার ঘুড়ীটার বাচ্চা।'

'না, মিথ্যে কথা! ও ঘোড়াটার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল, তাই ও ঘোড়াটারই বাচ্চা। আর তাই, এটা আমার।' দু-ভাইয়ে ঝগড়া করতে শুরু করল। তারা ঠিক করল যে তারা শহরে যাবে। সেখানে বিচারকদের কাছে গোটা ব্যাপারটা বলে বিচার চাইবে। তর্ক করতে করতেই তারা বিচারশালাটা যেখানে সেই বড়ো চত্বরটার দিকে পা বাড়াল। কিন্তু তারা যেকথাটা জানত না সেটা হল, সেই দিনটা ছিল একটা বিশেষ দিন। বছরে একবার ওই দিনটায় সম্রাট নিজে বিচার করতেন। যারা তাঁর কাছে বিচার চাইতে আসত সবাইকে তিনি নিজে অভ্যর্থনা জানাতেন। দু-ভাইকে তাঁর সামনে হাজির করা হলে তারা তাঁকে গোলমালটা সম্পর্কে সব কিছু বলল।

একথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সম্রাট ভালো করেই বুঝেছিলেন ঘুড়ীর বাচ্চাটার আসল মালিক কে। তিনি যখন গরিব ইভানের পক্ষেই রায় দিতে যাবেন ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ ইভানের চোখটা নেচে উঠল। তুচ্ছ এক চাষির এ-রকম আচরণ দেখে সম্রাট তো গেলেন বেজায় খেপে। তক্ষুনি তিনি ঠিক করলেন এই বেয়াদপির জন্য ইভানকে শাস্তি দেবেন । দু-পক্ষের গল্পটা শোনার পর, তিনি বললেন, দেখো, ওই বাচ্চাটা যে ঠিক কার এটা বলা খুব শক্ত, এমনকী অসম্ভবও বলা যেতে পারে। সম্রাট ছিলেন আমোদপ্রিয়। তাই তিনি মাঝে মাঝেই তাঁর পারিষদদের নানারকম ধাঁধা বলে তার উত্তর বের করতে বলতেন। তিনি একটু মজা করার জন্য এই বলে চেঁচিয়ে উঠলেন,

'তোমাদের মধ্যে কার এই বাচ্চাটা পাওয়া উচিত সেকথা বলা শক্ত। তাই আমি তোমাদের চারটে ধাঁধা দিচ্ছি। তোমাদের মধ্যে যে এই চারটে ধাঁধার সঠিক উত্তর দিতে পারবে সে এই বাচ্চাটা পাবে।
ক) এই দুনিয়ায় সবচেয়ে দ্রুতগামী কী?
খ) এই দুনিয়ায় সবচেয়ে মোটা কী?
গ) এই দুনিয়ায় সবচেয়ে নরম কী?
আর ঘ) এই দুনিয়ায় সবচেয়ে দামি কী?
এক সপ্তাহের মধ্যে এই চারটে প্রশ্নের উত্তর নিয়ে প্রাসাদে ফিরে আসতে আমি তোমাদের আদেশ দিচ্ছি।'

বিচারশালা থেকে বেরোনোর সঙ্গেসঙ্গে দিমিত্রি ধাঁধার সমাধান করার চেষ্টা করতে শুরু করে দিল। যখন সে বাড়ি পৌঁছোল, সে বুঝতে পারল যে তাকে সাহায্য করার কেউ নেই। তার বৌ-এর অত বুদ্ধি নেই।

'দেখা যাক, আমাকে তো সাহায্য চাইতেই হবে, কারণ এই ধাঁধাগুলোর উত্তর বের করতে না পারলে তো আমি বাচ্চাটা পাব না!' এইসব ভাবতে ভাবতে তার এক পড়শি মহিলার কথা মনে পড়ল যাঁকে সে একটা রুপোর মুদ্রা ধার দিয়েছিল। সেও নয় নয় করে বেশ কিছুদিনই হয়ে গেল। সুদসমেত সেই একটা রুপোর মুদ্রা এখন তিনটেতে গিয়ে ঠেকেছে। আর যেহেতু তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতি বলে বেশ নাম আছে, কিন্তু বেশ চতুরও, তাই দিমিত্রি তার পরামর্শ নেবে ঠিক করল, বদলে তাঁর ঋণের একটা অংশ সে মকুব করে দেবে। কিন্তু সেই মহিলা, তাঁর বুদ্ধির ধার আসলে ঠিক কতটা তা দেখাতে মোটেও দেরি করলেন না। তিনি সঙ্গেসঙ্গে দাবি করলেন যে, ওই উত্তরগুলোর বদলে তাঁর পুরো ঋণটাই মকুব করে দিতে হবে।

'এই দুনিয়ার দ্রুততম জিনিস হল আমার স্বামীর লালচে-বাদামি ঘোড়াটা,' বললেন তিনি। 'কেউই তাকে হারাতে পারে না! আমাদের শুয়োরটা হল সবচেয়ে মোটা! ও-রকম একটা হোঁতকা জানোয়ার কেউ কখনো দেখেনি। আমার নিজের রাজহাঁসটার পালক দিয়ে আমি আমাদের বিছানার জন্য যে তোশকটা বানিয়েছি, সেটা সবচেয়ে নরম। আমার সব বন্ধু ওটা দেখে হিংসে করে। আর এই দুনিয়ার সবচেয়ে দামি হল আমার তিন মাসের ভাইপো। ওর চেয়ে সুন্দর বাচ্চা আর হয় না। পৃথিবীতে যত সোনা আছে তার পরিবর্তেও আমি ওকে দিয়ে দিতে পারব না। আর সেই কারণেই ও হল এই পৃথিবীর সবচেয়ে দামি জিনিস।'

মহিলার উত্তরগুলো সম্পর্কে দিমিত্রি কিন্তু বেশ ধন্দে ছিল। এদিকে, তাকে তো কিছু একটা উত্তর নিয়ে সম্রাটের সামনে হাজির হতে হবে। তার মনে হল, এই উত্তরগুলো নিয়ে যেতে না পারলে সে শাস্তি পাবে। তার ভাবনাটা ঠিকই ছিল।

ইতিমধ্যে হয়েছে কী, বিপত্নীক ইভান ফিরে গেল তার ছোট্ট কুঁড়েতে যেখানে সে তার বাচ্চা মেয়েটার সঙ্গে থাকত। মাত্র সাত বছরের বাচ্চা মেয়েটা প্রায়ই একা একা থাকত আর তার ফলে সে তার বয়সের তুলনায় হয়ে উঠেছিল ভাবুক ও বেশ চালাক । গরিব ভাই তার দাদার মতোই বুঝতে পেরেছিল যে সে নিজে নিজে ওই ধাঁধাগুলোর উত্তর বের করতে পারবে না। তাই সে বাচ্চা মেয়েটার ওপর ভরসা করল। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর বাচ্চা মেয়েটা তাকে জোরের সঙ্গে বলল,

'সম্রাটকে বলো, এই দুনিয়ায় সবচেয়ে দ্রুতগামী হল শীতের উত্তুরে হাওয়া। সবচেয়ে মোটা হল আমাদের জমির মাটি যার ফসল মানুষ আর পশু দুজনকেই জীবন দেয়। সবচেয়ে নরম হল একটা শিশুর স্নেহস্পর্শ আর সবচেয়ে দামি হল সততা।'

অবশেষে দুই ভাইয়ের সম্রাটের সামনে হাজির হওয়ার দিনটা এল। তাদের তাঁর সামনে হাজির করা হল। তারা কী বলবে সেটা শোনার জন্য সম্রাট উৎসুক হয়ে বসে ছিলেন। কিন্তু দিমিত্রির বোকা বোকা উত্তরগুলো শুনে তিনি হাসিতে ফেটে পড়লেন। যাই হোক, যখন ইভানের বলার পালা এল, সম্রাটের ভুরু কুঁচকে গেল। গরিব ভাইয়ের বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর, বিশেষ করে সততা সম্পর্কে শেষেরটা শুনে তিনি ছটফট করে উঠলেন। সম্রাট ভালো করেই জানতেন যে, গরিব ভাইয়ের সঙ্গে তিনি অসৎ আচরণ করেছেন, কারণ তিনি তাকে ন্যায়বিচার দেননি। কিন্তু নিজের পারিষদদের সামনে তিনি সেকথা স্বীকার করতে পারলেন না আর তাই রেগেমেগে বললেন,

'কে তোকে এই উত্তরগুলো দিয়েছে?' ইভান তখন সম্রাটকে জানাল যে তার বাচ্চা মেয়েটা এই উত্তরগুলো দিয়েছে। তাতেও সম্রাটের রাগ যায় না। তিনি বললেন,

'এ-রকম বুদ্ধিমতী আর চালাক মেয়ের জন্য তোকে পুরস্কার দেওয়া হবে। তোর ভাই যে ঘুড়ীর বাচ্চাটা দাবি করেছিল সেটা তোকে পুরস্কার দেওয়া হবে, তার সঙ্গে এক-শোটা রুপোর মুদ্রাও দেওয়া হবে . . . কিন্তু . . .কিন্তু . . .' বলতে বলতে সম্রাট পারিষদদের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন।

'সাতদিনের মধ্যে তুই তোর মেয়েকে নিয়ে আমার কাছে আসবি। তবে যেহেতু ও খুব বুদ্ধি ধরে, ও আমার সামনে খালি গায়েও আসতে পারবে না আবার জামাকাপড় পরেও আসতে পারবে না, হেঁটেও আসতে পারবে না আবার ঘোড়ার পিঠে চড়েও আসতে পারবে না, আমার জন্য কোনো উপহার নিয়েও আসতে পারবে না আবার খালি হাতেও আসতে পারবে না। যদি ও এই শর্ত ঠিকঠাক মানতে পারে, তাহলে তুই তোর পুরস্কার পাবি। না হলে, হঠকারিতার জন্য তোর গর্দান নেওয়া হবে!'

যারা দর্শক ছিল তারা সবাই এই ভেবে হাসতে লাগল যে, গরিব ভাইটা কখনোই সম্রাটের শর্ত পূরণ করতে পারবে না। ইভান হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে গেল, তার চোখ জলে টস টস করতে লাগল। কিন্তু যখন সে তার মেয়েকে গোটা ব্যাপারটা বলল, তার মেয়ে শান্তভাবে বলল,

'কাল একটা বড়সড়ো খরগোশ আর একটা তিতির পাখি ধরে আনবে। দুটোই কিন্তু জ্যান্ত হওয়া চাই। তুমি তোমার ঘোড়ার বাচ্চা আর একশো রুপোর মুদ্রা পাবে! ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও!' ইভান মেয়ের কথামতোই কাজ করল। ওই দুটো প্রাণী যে কেন দরকার সে-সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিল না। কিন্তু তার মেয়ের বুদ্ধির ওপর তার ভরসা ছিল।

নির্দিষ্ট দিনে রাজপ্রাসাদ সম্রাটের উপস্থিতিতে দর্শকে ভরে গেল। সবাই উন্মুখ হয়ে ইভান আর তার বাচ্চা মেয়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। অবশেষে, বাচ্চা মেয়েটা এসে হাজির হল, মাছ ধরার জাল দিয়ে তার সারা শরীর মোড়া। সে এসেছে খরগোশের পিঠে চেপে, হাতে ধরা একটা তিতির পাখি। সে খালি গায়েও ছিল না, আবার তার গায়ে জামাও নেই, সে হেঁটেও আসেনি আবার ঘোড়ার পিঠে চেপেও নয়। রেগেমেগে সম্রাট তাকে বললেন, 'আমি বলেছিলাম উপহার নিয়েও আসা যাবে না আবার খালি হাতেও আসা যাবে না!' একথা শুনে বাচ্চা মেয়েটা তিতির পাখিটাকে বের করল। সম্রাট সেটাকে ধরার জন্য হাত বাড়ালেন, কিন্তু পাখিটা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে শূন্যে উড়ে গেল। তৃতীয় শর্তটাও পূরণ হল। বাচ্চা মেয়েটা এত বুদ্ধি করে এ-রকম একটা পরীক্ষায় উৎরে গেল যে সম্রাট নিজের মুখে তার প্রশংসা না করে পারলেন না। তিনি মৃদু, নরম স্বরে বললেন,

'তোর বাবা কি সত্যিই খুব গরিব আর সে কি মরিয়া হয়ে ঘোড়ার বাচ্চাটা চায়?'
'ওহ, হ্যাঁ হ্যাঁ! আমরা সত্যিই খুব গরীব' বাচ্চা মেয়েটা উত্তর দিল। ' বাবা নদী থেকে যে খরগোশ আর গাছ থেকে যে মাছ ধরেন তাই খেয়েই আমরা বাঁচি!'

'আহা!' সম্রাট যেন জিতেই গেলেন। 'তার মানে তোকে যতটা চালাক মনে হয় তুই ততটা চালাক নোস। জলে খরগোশ আর গাছে মাছের কথা কে কবে শুনেছে!' একথার উত্তরে বাচ্চা মেয়েটা চটপট বলল,

'আর কে-ই বা কবে শুনেছে যে ঘোড়ার বাচ্চা হয়?' একথা শুনে সম্রাট এবং রাজসভার প্রত্যেকে হাসিতে ফেটে পড়ল। তক্ষুনি ইভানকে একশো রুপোর মুদ্রা আর ঘোড়ার বাচ্চাটা দিয়ে দেওয়া হল। এদিকে সম্রাটও নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ানোর এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না। তিনি সগর্বে ঘোষণা করলেন,

'কেবলমাত্র আমার রাজ্যেই এ-রকম একটা বুদ্ধিমতী মেয়ে জন্মাতে পারে!'


ছবিঃ ত্রিপর্ণা মাইতি

ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র অনমিত্র রায়ের পথ চলার সঙ্গী গানের সুর,ছবির রং আর চারপাশ ঘিরে থাকা চেনা-অচেনা মানুষজন, পশুপাখি, গাছপালা—বিচিত্র জীবনধারা। কলম দিয়ে ছবি আঁকেন বাইরের জগৎ, মনের জগৎ-- দুইয়েরই। কখনো কবিতায়, কখনো গদ্যে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা