সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
ডকুমেন্টারির গল্প

এক যে ছিল রাজা আর এক যে ছিল রানী – এইভাবেই শুরু হয় বেশির ভাগ গল্প – কল্পকাহিনী। তাতে থাকে নানা নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাত। শত্রুর বিরুদ্ধে নায়ক নায়িকার যুদ্ধ, শেষে দুষ্ট রাক্ষসের দমন আর নায়ক নায়িকার মিলন। অবশ্য যুদ্ধ যে সবসময় শুধুমাত্র কোনও রাক্ষসের সঙ্গে এমন তো নয়। পরিস্থিতির প্রতিকুলতার বিরুদ্ধেও তাদের লড়াই করতে হয়। তারপর যুদ্ধ জয়ের শেষে তাদের আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছান। কিন্তু সেরকম লড়াই শুধু গল্পে কেন, আমাদের প্রতিদিনকার বাস্তবেও তো লড়তে হচ্ছে কত মানুষকে। আর সেই সব মানুষের লড়াই যখন সিনেমার পর্দায় বলা হয়, তখন তার নাম হয় ডকুমেন্টারি। বাংলায় তথ্যচিত্র, বা বাস্তবচিত্র, বা প্রামান্যচিত্র। ধরা যাক, স্বপ্না বর্মণ। এই তো সবে এশিয়ান গেমস থেকে সোনা জিতে এলেন। কী কঠিন তাঁর লড়াই! কোচবিহারের দরিদ্র রাজবংশী পরিবারের মেয়ে স্বপ্না। সেখান থেকে উঠে এসে বছরের পর বছর কলকাতায় থেকে প্র্যাকটিস করে কত শত চোট আঘাত পেরিয়ে শেষে হেপ্টাথলনের মতো কঠিন খেলায় সোনা জেতা কি চাট্টিখানি কথা! এই গল্প নিয়েও তো সিনেমা হতে পারে। হচ্ছেও তো। মনিপুরের চ্যাম্পিয়ন বক্সার মেরি কমের গল্প নিয়ে যেমন সিনেমা হলো। যদিও তাতে সত্যিকারের মেরি কম ছিলেন না। ওঁর জীবনের গল্প নিয়ে কিছুটা কল্পনা মিশিয়ে চিত্রনাট্য তৈরি করে সেখানে মেরি কমের ভূমিকায় প্রিয়াঙ্কা চোপরা অভিনয় করলেন। সুতরাং সেটাকে কিন্তু আমরা ডকুমেন্টারি বলব না। তা সে ছবি যতই সত্যিকারের মেরি কমের জীবনের ওপর আধারিত হোক না কেন। এবার ধরা যাক স্বপ্না বর্মণকে নিয়ে যদি এখন একটা ডকুমেন্টারি তৈরি করতে হয়, তাহলে সেটা কেমন হতে পারে? স্বপ্না এশিয়াড থেকে সোনা নিয়ে ফিরলেন বটে, কিন্তু তাঁর স্বপ্ন তো আরোও অনেক বড়। তিনি অলিম্পিক থেকেও পদক জিততে চান। দু'বছর পর টোকিওতে বসছে পরবর্তী অলিম্পিকের আসর। এদিকে স্বপ্না আবার নানারকম চোট আঘাতে জর্জরিত। সেইসব প্রতিকূলতা পেরিয়ে তিনি কি পারবেন টোকিও থেকে পদক আনতে? এটাই কিন্তু একটা খুব ভাল তথ্যচিত্রের বিষয় হতে পারে। আর এটা করতে গেলে আমাদের আগামী দুবছর ধরে শুটিং করতে হবে - স্বপ্নার প্র্যাকটিস, পরিশ্রম, ট্রায়াল, জীবনের আরো নানারকম সব ওঠাপড়া। তারপর তাঁর সাথে চলে যেতে হবে টোকিও। এবার আমরা তো জানিনা শেষ অবধি স্বপ্না পদক পাবেন কিনা! যদি পান, তাহলে একরকম। যদি না পান? তাতেও তো ওর লড়াই ব্যর্থ হয়ে যায়না। আমরাই তো বলি, হার-জিতটাই সব নয়, খেলায় অংশ নেওয়াটাই আসল। অলিম্পিকের মতো আসরে সেটাই বা কজন পারে? যাই হোক, এরকম একটা ডকুমেন্টারি আমরা স্বপ্না বর্মণকে নিয়ে বানিয়ে ফেলতেই পারি। তাই না?

ডকুমেন্টারির গল্প
তথ্যচিত্র তুলতে গিয়ে...

বছর তিনেক আগে এক টোটো মেয়েকে নিয়ে আমি এমনই একটা ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলাম। টোটোরা হল ভারতের প্রাচীনতম উপজাতিগুলোর একটা। সব মিলিয়ে এখন টোটোদের মোট জনসংখ্যা ষোলশো। পশ্চিমবঙ্গ আর ভুটানের সীমান্তে যেখানে তোরসা নদী নেমে এসেছে পাহাড় থেকে, সেখানে একটামাত্র গ্রামে সমগ্র টোটো জনজাতির বাস। সেই গ্রামের নাম টোটোপাড়া। তো সেই গ্রামের মেয়ে শোভা। ওদের গ্রামে বেশি পড়াশোনা করার সুযোগ নেই। তাই ছোটবেলা থেকেই শোভা গ্রাম থেকে বাবা-মায়ের থেকে দূরে আলিপুরদুয়ার আর কোচবিহারের হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছে। ভূগোলে অনার্স নিয়ে স্নাতক হয়েছে। এবার তার কলকাতায় আসার পালা। আরো পড়তে হবে। চাকরি করতে হবে। এটাই ছিল সেই ডকুমেন্টারির বিষয়। আসলে কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিল শোভার গল্পের মাধ্যমে টোটো উপজাতির সাথে দর্শকের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। তাই ছবিতে শোভার কণ্ঠেই আমরা টোটোদের অনেক কথা শুনলাম। একে বলে ন্যারেশন, বা বর্ণনা দেওয়া। ন্যারেশন কিন্তু কাহিনীচিত্রের ডায়লগ বা সংলাপের থেকে আলাদা। কাহিনীচিত্রের চরিত্ররা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বললে তখন সেটা হল সংলাপ। আর ডকুমেন্টারির ন্যারেটর যে কথা বলে, সেটা সরাসরি দর্শককে উদ্দেশ্য করে, যেন একটা গল্প তাকে বলা হচ্ছে। এই ন্যারেশন ছবির কোন চরিত্রের গলায় হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে, ছবিতে যাকে দেখা যাচ্ছে না, তার গলায় আমরা ন্যারেশন শুনছি। যেন কোন তৃতীয় ব্যক্তি গল্পটা বলছে। হয়ত সেটা ছবির পরিচালকের বয়ান। অনেকে একে 'ভয়েস অফ গড' ন্যারেশন বলে।

ডকুমেন্টারির গল্প
টোটোপাড়ায় শ্যুটিং করার ফাঁকে

আগেকার দিনে বেশির ভাগ তথ্যচিত্রেই এরকম 'ভয়েস অফ গড' ন্যারেশন ব্যবহার হত। অনেক দিন চলতে চলতে আর এগুলো ভালো লাগছিল না, একঘেয়ে লাগছিল। তখন তথ্যচিত্রে গল্প বলার অন্যরকম ভাষার খোঁজ শুরু হল। দেখা গেল দর্শক আসলে অনেকটা পরিণত হয়ে গেছে। সব কথা ন্যারেশনে বলে না দিলেও স্রেফ ছবি দেখেই সে অনেক কিছু বুঝে ফেলছে। এইভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে ডকুমেন্টারির নির্মাণে আরো নানারকম আঙ্গিক তৈরি হল। আর বাস্তবের কত যে আশ্চর্য সব গল্প উঠে এল ডকুমেন্টারিতে! কথায় আছে না – 'ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন'! আবার আরেক রকমের ছবি আছে যাকে ডকুড্রামা বলে। এমন কিছু বিষয় যা প্রকৃতই ঘটেছিল, সত্যিকারের ঘটনা, তাকে অভিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হয়, অনেকটা কাহিনিচিত্রের মতো। তার সাথে বাস্তবের ছবি, বা ইন্টারভিউ মিলেমিশে যায়। মূলত টেলিভিশনের জন্য ঐতিহাসিক কাহিনিনির্ভর অনেক ডকুড্রামা বানানো হয়। তবে এই ধরনের ছবিকে অনেকেই সত্যিকারের ডকুমেন্টারি বলতে একেবারেই নারাজ।


ল্যুমিয়ের ভাইদের তোলা প্রথম চলমান ছবিগুলির মধ্যে একটি - অ্যারাইভাল অফ আ ট্রেন অ্যাত লা সিওতা। মূল ছবিতে শব্দ ছিল না, ইউটিউবে প্রাপ্য এই ছবিতে পরে শব্দ সংযোগ করা হয়েছে।

১৮৯৫ সালে ফ্রান্সের ল্যুমিয়ের ভাইয়েরা বিশ্বে প্রথম চলমান ছবি তোলেন ও তার প্রদর্শন করেন। একদিক থেকে দেখলে তাঁদের তোলা সেইসব ছবি সবই ছিল বাস্তবচিত্র – ছুটির পরে শ্রমিকরা দলে দলে কারখানার থেকে বেরিয়ে আসছে, অথবা স্টেশনে ট্রেন এসে থামছে আর যাত্রীরা ওঠানামা করছে – এইরকম। সুতরাং প্রথম চলচ্চিত্রকে একভাবে ডকুমেন্টারিও বলা যেতে পারে। কাহিনিচিত্রের জন্ম এর বেশ কিছুটা পরে। কিন্তু আমরা যেহেতু গল্প শুনতে পড়তে বা দেখতে ভালোবাসি, স্বাভাবিকভাবেই কাহিনিচিত্র অনেক দ্রুত অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠল। বাস্তবচিত্র মূলত সংবাদ বা তথ্য পরিবেশনের জন্যই ব্যবহৃত হতে লাগল। পরে সময়ের সাথে সাথে ডকুমেন্টারি যখন আরো বেশি সৃষ্টিশীল, আরো বেশি বৈচিত্র্যময় হয়ে ঊঠল, মানুষের আগ্রহও তত বাড়ল। আমেরিকায়, জাপানে, ইউরোপের নানা দেশে বড় বড় সিনেমা হলে আজকাল ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়। রীতিমতো টিকিট কেটে দর্শক সেইসব ছবি দেখেন। আমাদের দেশে এরকম পরিস্থিতি এখনও তৈরি হয়নি। কিন্তু যেহেতু খুব ভালো ভালো ডকুমেন্টারি তৈরি হতে শুরু করেছে, আশা করা যায় এখানেও অনেকে ডকুমেন্টারির দর্শক হয়ে ঊঠবেন। শেষে রইল ১৯৫৮ সালে নির্মিত একটি ছোট্ট কিন্তু বহু চর্চিত ডকুমেন্টারি। ছবিটির নাম 'গ্লাস', পরিচালক বার্ট হান্সট্রা। কাঁচের জিনিষ তৈরি কারখানার কলাকুশলীদের এবং তাঁদের কাজকর্ম নিয়ে তৈরি এই ছোট্ট তথ্যচিত্রটি আমাদের সামনে এক অচেনা জগৎকে নিয়ে আসে।

 

ছবিঃ ব্যক্তিগত সংগ্রহ

More articles from this author

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা