সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

১৯১৪ সাল। জানুয়ারি মাস। ক্যালিফোর্নিয়ার কিস্টোন স্টুডিও মালিক ম্যাক সেনেট সেদিন শ্যুটিং করছেন 'মেব্‌ল্‌স্‌ স্ট্রেঞ্জ প্রেডিকামেণ্টস' নামের একটি ছবির। কিন্তু নির্বাক এই ছবিতে যতটা মজা থাকা উচিত, ততটা ঠিক যেন জমছে না। তাঁর কোম্পানিতে তখন সদ্য যোগ দিয়েছেন এক তরুণ অভিনেতা, চার্লস চ্যাপলিন। চ্যাপলিনকে ডেকে সেনেট নির্দেশ দিলেন, একটু হাস্যকর সাজগোজ করে এসে কিছু মজাদার অভিনয় করতে, যাতে গল্পটা বেশ জমে যায়।

charlie chaplin as the tramp

চ্যাপলিন পরে নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, সাজঘরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে একটু ভাবনা চিন্তা করতেই তাঁর মাথায় এসে গেছিল সেই ছবির প্রয়োজন অনুযায়ী 'হাস্যকর' চরিত্রের সাজঃ পরণে ঢিলেঢালা প্যান্টস্‌, বড় মাপের জুতো, একটা ছড়ি আর একটা ছোট্ট ডার্বি টুপি। সবকিছু হবে বিপরীত- বড় প্যান্টস্‌ , তাই তার সাথে চাপা কোট, ছোট্ট টুপির সাথে বড় মাপের জুতো। তখন চ্যাপলিনের বয়স মোটে চব্বিশ, তাই নাকের নিচে লাগালেন ছোট ব্রাশের মত গোঁফ - বয়স যাতে একটু বেশি লাগে, কিন্তু মুখের ভাবভঙ্গী পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়।

তিনি আরোও লিখেছিলেন, "পোষাক আর মেকআপ আমাকে সেই মানুষটিকে অনুভব কররে সাহায্য করল। আমি তাকে চিনতে শুরু করলাম, আর যতক্ষণে আমি স্টেজে গিয়ে পৌঁছালাম, ততক্ষণে তার পুরোপুরি জন্ম হয়ে গেছে" -আর, এইভাবেই জন্ম নিল বিশ্বের সবথেকে জনপ্রিয় চরিত্রগুলির মধ্যে একজন - সেই ট্র্যাম্প বা ভবঘুরে। শ্যুটিং সফলভাবে শেষ হল। কোম্পানীর মালিক ম্যাক সেনেট এবং ছবির নির্দেশক তথা নায়িকা মেব্‌ল্‌ নরম্যান্ড খুবই খুশি হলেন।

kids auto races at venice
'কিড্‌স অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস' ছবিতে প্রথম দেখা দিল ট্র্যাম্প

যদিও 'মেব্‌ল্‌স্‌ স্ট্রেঞ্জ প্রেডিকামেণ্টস' ছবিটি আগে তৈরি হয়েছিল, কিন্তু সিনেমার দর্শকদের সামনে সেই ট্র্যাম্প বা ভবঘুরে প্রথম দেখা দিল অন্য একটি ছবিতে, যে ছবিটি বাজারে মুক্তি পায় 'মেব্‌ল্‌স্‌ স্ট্রেঞ্জ প্রেডিকামেণ্টস' মুক্তির মাত্র দুদিন আগে। সেটিও কিস্টোনের-ই ছবি, সেটির নাম 'কিড্‌স্‌ অটো রেসেস এ্যাট ভেনিস'; ছবিটি মুক্তি পায় ১৯১৪ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি। সেই ছবিতে দেখা যায়, ছোট ছেলেদের গাড়ি চালানোর প্রতিযোগিতা হচ্ছে, এবং মুভি ক্যামেরায় সেই রেসের ঘটনাক্রম ধরে রাখা হচ্ছে। ভীড়ের মধ্যে থেকে এই অদ্ভূত চরিত্রটি অতি উৎসাহে মাঝে মাঝেই ক্যামেরার সামনে এসে পড়ছে। তাকে তখন গিয়ে ক্যামেরার সামনে থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মুশকিল হল এই যে, প্রথম দুই-একবারের পরেই , সে বুঝে গেল যে ক্যামেরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে ক্যামেরাম্যান খুব বিরক্ত হচ্ছেন ! ছবির শেষের দিকের পুরোটাই হচ্ছে সেই মজাদার মানুষটির নানারকমের ফন্দীর কাছে ক্যামেরাম্যান এবং তাঁর সঙ্গীর নাস্তানাবুদ হওয়ার গল্প।


এডনা পারভেয়ান্স এর সাথে জুটি বেঁধে 'ট্র্যাম্প' চরিত্রে চার্লি চ্যাপলিন অনেকগুলি ছবিতে অভিনয় করেন

প্রথম ছবি সফল হওয়ার পরেই এই ভবঘুরেকে মুখ্য চরিত্র করে তৈরি হয় অসংখ্যা ছোট এবং পরে বেশ কয়েকটি পূর্ণ দৈর্ঘের ছবি।নির্বাক ছায়াছবি দুনিয়ার সফল বহু অভিনেতা-অভিনেত্রী - এড্‌না পারভেয়ান্স, মেরি পিকফোর্ড, ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস- নিয়মিত এই সব ছবিতে অভিনয় করেন। ভবঘুরে এই চরিত্রটি চার্লিি চ্যাপলিনকে এনে দেয় সাফল্য, খ্যাতি, আর বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষের সম্মান আর ভালবাসা।

একশো বছর কেটে গেছে। ছায়াছবির দুনিয়ায় কতই না বদল হয়েছে। কিন্তু চ্যাপলিনের এই ট্র্যাম্পই আজও একমাত্র আন্তর্জাতিক নায়ক, যার জনপ্রিয়তা কিন্তু একফোঁটাও কমেনি। তার প্রথম আবির্ভাবে সে ঠিক যতটা সবার মন কেড়ে নিয়েছিল, আজও সেইভাবেই সে ছোট-বড় -সবার মন কেড়ে নেয়।তার মজাদার কান্ডকারখানা দেখে আমরা হেসে গড়াগড়ি যাই, ফন্দী এঁটে মন্দ লোকেদের সে যখন জব্দ করে তখন আমরা বেজায় মজা পাই, আবার তার ছোট ছোট দুঃখে আমাদের প্রাণ ফেটে যায়, তার জলভরা চোখের দিকে তাকিয়ে আমাদের চোখের কোণে জল চিকচিক করে ওঠে, গলার কাছে জমে আসে কষ্টের দলা।


'দ্য ট্র্যাম্প' ছবির একটি দৃশ্য

শিশুর মত সরল, দিলদরিয়া এই চরিত্রটিকে চ্যাপলিন কোন নাম দেন নি। কোন কোন ছবিতে তাকে 'চার্লি' বলা হলেও, বেশিরভাগ ছবিতেই তার কোন নাম নেই। সে যে সব ছবিতেই ভবঘুরের চরিত্রে অভিনয় করেছে এমনও নয়। যে সব ছবিতে সে ভবঘুরে, সেখানেও দেখা যায়, সে কিন্তু ভদ্রসমাজের সব আদবকায়দাগুলো মেনে চলতে চেষ্টা চালিয়ে যায়। আবার প্রয়োজন পড়লেই গল্পের অন্যান্য চরিত্রদের, বিশেষতঃ যারা সামাজিকভাবে ক্ষমতাশালী, যেমন পুলিশ, তাদেরকে বোকা বানিয়ে নিজের কাজ হাসিল করে নিতে তার বেশি সময় লাগে না।

চার্লি চ্যাপলিনের আত্মজীবনী এবং তাঁর ছবিগুলির ওপর পরববর্তী কালে যে সমস্ত গবেষণা বা ভাবনা-চিন্তা হয়েছে, সেইসব কিছু খুঁটিয়ে পড়লে বোঝা যায়, কিভাবে ও কেন এই সাধারণ ভবঘুরে মানুষটি পৃথিবীর সব দর্শকের কাছে এত প্রিয় হয়ে উঠেছিল। যদি তুমি সময় নিয়ে সেইসব আলোচনা পড়, তাহলে বুঝতে পারবে, যে সময়ের সাথে সাথে ভবঘুরে চরিত্রটিকে নিয়ে তৈরি ছবিগুলির দৈর্ঘ্য যত বড় হতে থাকে, সেই সব ছবিতে তত বেশি করে দেখা যায় চ্যাপলিনের জীবনদর্শনের প্রতিফলন - ক্রমাগত শিল্পোন্নত, যন্ত্রনির্ভর হতে থাকা বিশ্বের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষদের দুঃখ, সমস্যা, যন্ত্রণা, এবং তারই সাথে মিশে থাকা সুন্দর ভবিষ্যতের আশা,স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গ-এই সব টুকরো টুকরো ছবি দিয়েই তৈরি হয় একেকটি মাস্টারপিস - 'দ্য ইমিগ্রান্ট' (১৯১৭), 'আ ডগ্‌স্‌ লাইফ' (১৯১৮), 'দ্য কিড' (১৯২১), 'দ্য গোল্ড রাশ' (১৯২৫), 'দ্য সার্কাস' (১৯২৮), 'সিটি লাইট্‌স্‌' (১৯৩১), 'মডার্ন টাইম্‌স্‌' (১৯৩৬) ।


'আ ডগ্‌স্‌ লাইফ' ছবির একটি দৃশ্য

২০১৪ সালের পুরোটা জুড়েই পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় চার্লি চ্যাপলিনের ছবিগুলিকে আবার প্রদর্শনের মাধ্যমে, এবং নানা আলোচনার মধ্যে দিয়ে পালন করা হচ্ছে আমাদের প্রিয় ভবঘুরে চরিত্রটির একশো বছরের জন্মদিন। বিভিন্ন পত্র- পত্রিকায় এবং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এইসব আলোচনা পড়ে আমরা জানতে পারছি, কিভাবে এই ভবঘুরে চরিত্রটি একটু একটু করে পরিবর্তিত হয়েছে। একদম প্রথম দিকে কিস্টোন স্টুডিওতে তৈরি ছোট ছোট ছবিগুলির মধ্যে এই মজাদার চরিত্রটি মোটেও বেকার, আশ্রয়হীন, ভবঘুরে ছিলনা। বরং প্রথম দিকের বেশির ভাগ ছবিতেই দেখা গেছে সে কিছু না কিছু একটা কাজ করে, অনেক ছবিতে তার স্ত্রী-পুত্রও আছে, আর সে অনেক সময়েই অন্য লোকজনকে ইচ্ছে করে বোকা বানায় নিজের কিছু সুবিধা হবে বলে। এখানে একটা কথা, চার্লি চ্যাপলিন - নামটা বললেই আমরা তাঁর সাথে এই ট্র্যাম্প চেহারাটিকে মিলিয়ে নিই, কিন্তু মনে রাখলে ভাল হয় যে চ্যাপলিনের সমস্ত ছবিতে কিন্তু এই ভবঘুরে চরিত্রটি নায়ক নয়। চার্লি চ্যাপলিন আরো অসংখ্য ছবিতে নানা ধরণের চরিত্রে, এমনকি ছোট্ট পার্শ্বচরিত্রেও অভিনয় করেছেন। এই ছবিগুলির বেশিরভাগ গল্প তাঁর লেখা, নির্দেশনা এবং প্রযোজনায় তৈরি হয়েছিল।

ট্র্যাম্প এর যে বৈশিষ্টগুলো আমাদের টানে - নিজে যথেষ্ট দুঃখ কষ্টের মধ্যে থাকা সত্বেও অন্য মানুষের প্রতি দরদ,অন্যের দুঃখে বেশি দুঃখী হওয়া- সেই সমস্ত বৈশিষ্ট প্রথম দেখা যায় ১৯১৫ সালে এসেনে স্টুডিওস থেকে প্রকাশ পাওয়া 'দ্য ট্র্যাম্প' ছবিতে। আমরা যদি এই সময়ের বিশ্ব-ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে বুঝতে পারব, কিভাবে সেই মূহুর্তের রাজনৈতিক- সামাজিক পরিস্থিতি এবং চ্যাপলিনের নিজের পেশাগত অবস্থান ছবিগুলিতেও ছাপ ফেলে, এবং ট্র্যাম্প-এর চরিত্রেও বদল আনে।

মহাশ্বেতা রায় চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। ওয়েব ডিজাইন, ফরমায়েশি লেখালিখি এবং অনুবাদ করা পেশা । একদা রূপনারায়ণপুর, এই মূহুর্তে কলকাতার বাসিন্দা মহাশ্বেতা ইচ্ছামতী ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনা এবং বিভিন্ন বিভাগে লেখালিখি ছাড়াও এই ওয়েবসাইটের দেখভাল এবং অলংকরণের কাজ করেন। মূলতঃ ইচ্ছামতীর পাতায় ছোটদের জন্য লিখলেও, মাঝেমধ্যে বড়দের জন্যেও লেখার চেষ্টা করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা