সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
ঊদেয়ার রাজাদের দেশ- মহীশূর-পর্ব ১০চামুন্ডী পাহাড়

মাইসোরে যাঁরা ভ্রমনে যান, বিশেষ করে সপরিবারে বেড়াতে, তাঁরা চামুণ্ডী পাহাড়ে এবং বৃন্দাবন গার্ডেনে অবশ্যই যান। মাইসোর শহরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই আকাশের গায়ে দূরে যে ছোট ছোট পাহাড় দেখা যায় তারই মধ্যে একটির নাম চামুণ্ডী হিল - চামুণ্ডী পাহাড়। একটি মাঝারি মাপের পাহাড় যার ওপর চামুণ্ডেশ্বরীর মন্দির। যে মাতা চামুণ্ডেশ্বরী ওয়াদেয়ার রাজপরিবারের আরাধ্যা দেবী। এবং সেই একই পাহাড়ে একটা বিশাল আকারের ষাঁড়ের পাথরে কাটা মূর্তি আছে, ঘুর পথে পাহাড় থেকে নামার পথে সেখানে গাড়িগুলো দাঁড়ায়। সে ষাঁড়টিকে মহাদেবের বৃষ 'নন্দী' নামে পুজো করা হয়। দক্ষিণ ভারতের মানুষ মহাদেবের পাশাপাশি ওনার এই বৃষ বাহন নন্দীকেও পুজো করে। নন্দীর মন্দির আছে বেঙ্গালুরুতেও। সেই নন্দীর মাপ আরও বড়! এই চামুণ্ডী পাহাড়ের পাহাড়ি ঘুরপথ বেয়ে উঠতে উঠতে অনেকটা ওপরে উঠে গেলে একসময় নিচে মাইসোর শহরের অনেকটা দেখা যায়, পাহাড়ের কাছাকাছি বিস্তৃত অঞ্চলেরও একটা সুন্দর দৃশ্য চোখে পড়ে। দেখবে কনভেন্ট স্কুলের সুন্দর মাঠ, বাগান বাড়ি, বাংলো, এমন কত কী চোখে পড়ছে। একটু খেয়াল করলে ধবধবে সাদা লীলা প্যালেসও দেখতে পাবে। এটিও ওয়াদেয়ারদের আর একটি প্রাসাদ, তবে এখন পাঁচ তারা হোটেল হয়ে গেছে। ছায়াছবির শুটিংও হয়।

এছাড়া বৃন্দাবন গার্ডেনের কথা বললাম - সেটি একটি বড় এবং সুন্দর বাগান। মাইসোর তথা কর্ণাটকের একটু খুব গুরুত্বপূর্ণ জলের রিজারভয়ের, বা জলাধার হ'ল কৃষ্ণ রাজ সাগর রিজারভয়ের। কাবেরী নদীর জল সঞ্চয় করার এই প্রকল্পটি খুব গুরুত্বপূর্ণ জল সম্পদ, এবং যে বাঁধ দিয়ে জল ধরে রাখা হয় সেই বাঁধটির নাম কৃষ্ণ রাজ সাগর ড্যাম। যখন জল বেশি থাকে সেই সময় এই রিজারভয়ের ড্যামটিও একটি আকর্ষণীয় জায়গা হয়ে যায়। আর তারই খুব কাছাকাছি এই বৃন্দাবন গার্ডেন। বাগানের সাথে সন্ধেবেলার মিউজিকাল ফাউন্টেনটিও অনেকে পছন্দ করেন। এই বৃন্দাবন বাগানও ছায়াছবির শুটিং এর জন্য প্রাইম লোকেশন ধরে নেওয়া হ'ত... বিশেষ করে গানের শুটিং এর জন্য। সেই সময় এখনকার মত একটা গানের শুটিং করতে কথায় কথায় সিংগাপুর, ইতালি, মরিশাস চলে যেতে পারত না আঞ্চলিক ছবির লোকজন।

ঊদেয়ার রাজাদের দেশ- মহীশূর-পর্ব ১০বৃন্দাবন গার্ডেন

তবে কী জানো? এই যে মাইসোর বেড়ানোর গল্পটা তোমাকে এখন বলছি, এই বার এসব কিছুই দেখা হয় নি। প্যালেস দেখে বেরোতে বেরোতেই বিকেল গড়িয়ে গেল! মাইসোরে এসে বুঝেছিলাম, এই বৃন্দাবন গার্ডেন, কে এস আর ড্যাম, চামুন্ডী হিল... এইসব ছাড়াও আছে চিড়িয়াখানা, সুন্দর সুন্দর পার্ক, স্যাংচুয়ারী... এমন কত কী! একদিন এতকিছু দেখে শেষ করা অসম্ভব। হিসেবে করে দেখলে কম করে দু'দিন লাগবেই। মাইসোর এবং তার আশেপাশে দেখার মত যে কত কী ছড়িয়ে আছে তা তোমাকে কী বলব! আমি পরে আবার গেছিলাম কিছু কিছু করে এইগুলো সব দেখার জন্য। তুমি যদি মাইসোর ঘুরতে যাও, বড়দের অবশ্যই বল খুব ভাল করে পরিকল্পনা করে নিতে আগে থেকে। ক'দিনের জন্য যাওয়া, কী কী দেখতেই হবে... সব! নাহ'লে কিন্তু আমার মত অবস্থা হবে।

তা যাক গে! কী আর করা। বুঝতেই যখন পারলাম যে খুব শিগগির সন্ধে হয়ে যাবে... চললুম ফিলোমেনার গির্জার দিকে।

ঊদেয়ার রাজাদের দেশ- মহীশূর-পর্ব ১০সন্ত ফিলোমেনার গির্জা

মাইসোর প্যালেস থেকে যাওয়ার পথে আরুইন রোড সিগনাল পার করে এগিয়ে গেলেই বুঝতে পারবে যে তুমি মাইসোর শহরের জনবসতি অঞ্চলের দিকে এগোচ্ছ। সন্ত ফিলোমেনা'র ক্যাথিড্রাল যে অঞ্চলে নির্মিত, তার কাছে যেতে বেশ জনবহুল অঞ্চল পার করে যেতে হয়। বোঝা যায় বেশ পুরনো জনবসতি। কাছাকাছি খোয়াজা বাজার আর জমজম বাজার বলে দুটো বাজার আছে, আর মসজিদও চোখে পড়বে। তবে গির্জার সামনের অঞ্চলটা আবার একটু অন্যরকম, একটু খোলামেলা। প্রথমবার দেখার আগে অবধি এই সন্ত ফিলোমেনা'র ক্যাথিড্রাল (St. Philomena's Cathedral) সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানতাম না। আসলে এমন অনেক জিনিস থাকে, যা না দেখা পর্যন্ত মস্তিষ্কের সেই বিশেষ স্নায়ুতে চাপ পড়ে না, যেটা তার সম্পর্কে কৌতূহলের জন্ম দেয়। প্রথমবার গির্জাটি দেখার পর, সেই গির্জা চত্বরে অনেকক্ষণ থাকার পর ফিরে এসে তার সম্বন্ধে আরও তথ্য জানতে পারি। এরপর যতবার গেছি, ততবার সন্ধের কিছুটা সময় এই গির্জাতে কাটিয়েছি। এখন গির্জা চত্বরে মূল গির্জার পাশে একটি ছোট চ্যাপেলও স্থাপিত হয়েছে প্রার্থনার জন্য।

ক্যাথিড্রালের সামনে যখন এসে পৌঁছলাম, তখন আকাশের আলো কমছে, সূর্য পাটে বসেই গেছে... এখন অবশিষ্ট আলো। তবে ভেতরে ঢোকার আগে কিছু কথা তোমাদের জানিয়ে রাখি, যেগুলি আমি জেনেছিলাম ভেতরে ঢোকার পরে -

সন্ত ফিলোমেনা ছিলেন একজন লাতিন ক্যাথোলিক সন্ত বা সন্ন্যাসিনী যাঁকে শহীদও বলা হয়। ঠিক কেমন শহীদ তা তোমাকে এখন বোঝানো একটু জটিল ব্যাপার। সত্যি বলতে না বোঝাই ভাল। বরং তার গল্পটা যতটা জেনেছিলাম, শোনো -
১৪ বছর বয়সী একটি মেয়ে ( বলা হয়ে গ্রীক রাজকন্যা) চতুর্থ শতক (মানে আজ থেকে আনুমানিক ১৬০০ বছর আগে) মারা যায়। বলা হয়, তাকে হত্যা করা হয়। সেই মেয়েটির দেহটি সেই সময় বিধিসম্মত ভাবেই সমাধিও দেওয়া হয়েছিল। তারপর হাজার বছরেরও বেশি সময় পার করে, ১৮০২ খ্রীষ্টাব্দের ২৪শে মে এই সমাধিটি প্রত্নতাত্ত্বিকরা নতুন করে আবিষ্কার করেন রোমের ভিয়া স্যালেরিয়া (Via Salaria) অঞ্চলে। এক কালে মাটির নিচে (অনেকটা বেসমেন্ট কন্সট্রাকশনের মত) সমাধি গৃহ নির্মান করা হ'ত, তাকে ইংরিজীতে বলে ক্যাটাকম্ব (Catacomb)। অনেকটা গ্যালারির মত দেখতে যার মাঝে মাঝে এক একজনের সমাধি। সেইরকমে একটি ক্যাটাকম্ব, যার নাম সন্ত প্রিসিলার (Saint Priscilla) ক্যাটাকম্ব, সেখানে অন্যান্য ধ্বংশাবশেষের মাঝে একটি সমাধীর ওপর সুপ্রাচীন টাইলের ওপর লাতিন লিপি পাওয়া যায় - 'LUMENA PAXTE CUM FI'; অথচ এর কোনও মানেই করতে পারলেন না কেউ। তারপর একটু দেখেশুনে বোঝা গেল, কী কাণ্ড! এতো এলোমেলো হয়ে আছে! তখন আবার ঠিক করে সাজাতে দেখা গেল আসলে লেখা আছে - 'PAX TECUM FILUMENA'। যার অর্থ - তুমি শান্তিতে থাকো ফিলুমেনা! তার সঙ্গেই পাওয়া গেল একটি পাত্র, যাতে শুকনো রক্তের অবশেষ রাখা আছে। আর একটি চিহ্ন যার অর্থ সেই রাজকন্যাকে একজন শহীদ হিসেবে স্মরণ করা হচ্ছে। কেন শহীদ, কী ভাবে শহীদ তা অবশ্য জানা নেই। হয়ত রাজবংশে কোনও লড়াই বা হত্যাকাণ্ডে শহীদ হয়েছিলেন; আবার এমনও হ'তে পারে যে ধর্মীয় কোনও বিবাদের জেড়ে... সেসব কথা বাদ দাও। তো এইসব কিছু থেকেই বোঝা গেল যে ফিলোমেনা নামক গ্রীক রাজকন্যার দেহাবশেষ রোমের এই বিশেষ অঞ্চলে সমাধি দেওয়া হয়েছিল; তারই অবশেষ এখনও থেকে গেছে। এবং সেই অবশেষ, সেই পাত্র যাতে ফিলোমেনার শুকিয়ে যাওয়া রক্ত আছে... সেই সব কিছু নিয়ে আসা হ'ল ভারতবর্ষে! রাখা আছে সেন্ট ফিলোমেনা গির্জার বেসমেণ্টে (গির্জার মেঝের নিচের একটি কক্ষে) ঠিক যেমন ভাবে ক্যাটাকম্ব নির্মিত হয়, সেভাবে। সেই রাজকন্যার নামেই এই গির্জা - সন্ত ফিলোমেনা'র ক্যাথিড্রাল।

গির্জার বড় গেটটা দিয়ে ভেতরে ঢুকলে এখনও সেই ফলকটা দেখতে পাবে, যা আসলে এই গির্জার ভিত্তি প্রস্তর। সেখানে ইংরিজীতে লেখা আছে - "In the name of that only God - the universal Lord who creates, protects, and reigns over the universe of Light, the mundane world and the assemblage of all created lives - this church is built 1843 years after the incarnation of Jesus Christ, the Enlightenment of the World, as man"

অর্থাৎ ১৮৪৩ খৃষ্টাব্দে এই সেন্ট ফিলোমেনা'র গির্জা নির্মিত হয়। এই একই জায়গায় গির্জার নির্মানের জন্য জমি দান করেন মহারাজ মুম্মাদি কৃষ্ণরাজ ওয়াদেয়ার। ১৮৪৩ সালে যে গির্জাটি নির্মিত হয়েছিল, তা ছিল আপেক্ষিকভাবে ছোট মাপের এবং মূলত কাঠের তৈরি (ঠিক তখনকার রাজবাড়ি যেমন কাঠের তৈরি ছিল)। আমার ধারণা, সেই প্রাচীন গির্জাটির নামও হয়ত ফিলোমেনার নামে ছিল না... সে সব হয়েছে পরে... বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। ১৯২৬ সালে মাইসোরের মহারাজ নলবড়ি কৃষ্ণরাজ ওয়াদেয়ারের হুজুর সেক্রেটারী স্যার টি তুম্বু চেট্টী সন্ত ফিলোমেনার সমাধিস্থ দেহের অবশেষটি সংগ্রহ করেন ইস্ট ইণ্ডিজের বিশিষ্ট অ্যাপস্টেল পিয়ার পিসানির কাছ থেকে। সন্তের পবিত্র দেহাবশেষ দায়িত্ব প্রদান করা হয় ফাদার কশে (Father Cochet) নামক এক পাদ্রীকে। সেই ফাদার আবেদন জানালেন রাজার কাছে (অবশ্যই রাজার সেই সেক্রেটারীরও ইচ্ছে ছিলো), যে এই পবিত্র দেহাবশেষ এই গির্জাতে স্থাপন করলে পুনর্নিমান প্রয়োজন - গির্জার আকার বড় করতে এবং সেন্ট ফিলোমেনার নামে উৎসর্গ করতে রাজার সাহায্য প্রার্থনা করা হয়। মহারাজ রাজি হয়ে যান, এবং যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করে নির্মাণ শুরু হয় নতুন গির্জার... অতি সুন্দর নির্মাণ শৈলী এবং অঞ্চলের সব থেকে সুন্দর গির্জা হিসেবে এক নিদর্শন হিসেবে গড়ে তোলা হয় এই নতুন ক্যাথিড্রালটি। নতুন গির্জার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয় ২৮শে অক্টোবর ১৯৩৩ সালে... তারপর তরতর করে কাজ এগিয়ে চলে বিশপ রেনে ফিউগা'র তত্ত্বাবধানে।

ঊদেয়ার রাজাদের দেশ- মহীশূর-পর্ব ১০সন্ত ফিলোমেনার গির্জার ভেতরে

গির্জা বললে, দেশ বিদেশের অন্য কোনও কথা নয়... সবার আগে কলকাতার কথাই মনে পড়ে। এই ব্যস্ত শহরটা মাত্র ৩০০ বছরের মধ্যেই এত রকম সংস্কৃতি আর সংস্কারের আসা যাওয়া দেখেছে যে কিছু না কিছু ছাপ আর নিদর্শন রেখে গেছে প্রায় সবাই। ঠিক তেমন, কলকাতা এবং তার আশেপাশে যে কম করে পনেরোটি বেশ পুরনো গির্জা আছে... যাদের সকলেরই বয়স এখন একশো পার করেছে; কেউ কেউ দেড়শো। তার মধ্যে বেশ কয়েকটি দেখা আছে, আর গির্জা এবং তার নির্মান শৈলী দেখতে খুব ভাল লাগে বলেই এই ফিলোমেনা'র ক্যাথিড্রালও বাইরে থেকেই খুব সুন্দর লাগল। গির্জার প্রধান দ্বারের দু'পাশে একজোড়া সুউচ্চ স্পায়ার আছে (Spire - পিরামিড কিংবা চোঙ আকৃতি চূড়া বিশিষ্ট লম্বা মিনারের মত স্থাপত্য, যা মূলতঃ গির্জাতেই দেখা যায়)। এই স্পায়ার দুটিই এই গির্জার মূল বৈশিষ্ট, যা দিয়ে অনেক দূর থেকে এই গির্জাটির অবস্থান চিহ্নিত করা যায়। আশেপাশের সব বাড়িঘর, গাছপালার মাঝে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ক্যাথিড্রালের এই জোড়া মিনার... অনেকটা আমাদের কলকাতার জোড়া গির্জার (সেন্ট জেমস চার্চ) মত। গির্জার বাইরের চত্বরটা বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে বাঁধানো... সিঁড়ির ধাপে ধাপে পর্যটকদের ভিড়। কেউ ছবি তুলছে, কেউ বসে আছে। বাংলা ভাষায় কথাবার্তাও কানে এলো। গির্জার মূল প্রবেশ দ্বারের কাছে গিয়ে দেখলাম সেই বিশাল কাঠের দরজাটি ভীষণ সুন্দর কারুকার্য করা। তখনও ভেতরে ভাল ভীড়। মনে হ'ল সান্ধ্যকালীন প্রার্থনা কিছুক্ষণ আগেই শেষ হয়েছে। সাদা আলখাল্লা পরা স্থানীয় পাদ্রীদেরও দেখতে পেলাম। একদম সামনের দিকে অনেকে হাত বাড়িয়ে একজন পাদ্রীর থেকে কিছু নিচ্ছে। হয়ত তিনিই প্রধান, প্রার্থনাসভায় সভাপতিত্ব করেন। এছাড়া কনফেশন (খ্রিষ্টধর্মীয়দের মধ্যে ঈশ্বরের কাছ অপরাধ স্বীকারের প্রথা) বক্সেও পাদ্রীরা বসে। কেউ কেউ এসে কনফেশনে বসেছেন কাঠের জাফরির আড়ালে, পাদ্রী শুনছেন তার কথা। প্রার্থনা করছেন ঈশ্বরের কাছে ক্ষমাভিক্ষা করে। ভেতরে বসে থাকা সকলেই স্থানীয় এমন নয়, অনেকেই পর্যটক বা কাছাকাছি অন্য জায়গা থেকে এসেছেন। আবার অনেককেই দেখে মনে হ'ল স্থানীয়, নিয়মিত প্রেয়ারের জন্য এসেছেন। আর একটা জিনিস দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য, তা হ'ল - মন্দিরের ভেতরের বহু মূর্তি... এমন কি মাদার মেরির মূর্তিটিকেও শাড়ি পরানো। হ্যাঁ শাড়ি! ভারতীয় কিংবা স্থানীয় সংস্কৃতির এই ভাবে গির্জায় প্রকট হওয়া মনে রাখার মতই একটা ব্যাপার... এমন শাড়ি পরানো মাদার মেরি সচরাচর চোখে পড়ার কথা নয়। আসনের হিসেবে ৮০০ আসনের কথা বলা হলেও, ১০০০ জন মানুষ হেসে খেলে প্রার্থনা করতে পারে এই ক্যাথিড্রালের মূল প্রার্থনা গৃহে।

গির্জার আভ্যন্তরীণ নির্মানশৈলী এবং শিল্পনিদর্শনগুলি দেখতে দেখতে চোখ জুড়িয়ে যায়। প্রবেশ দরজার কারুকার্যের কথা তো আগেই বলেছি, এ ছাড়া গির্জার ভেতরে একাধিক কাঠের দরজা জানলা ইত্যাদিতে এমন কাঠের কাজ করা। দেওয়ালে কিছুদূর অন্তর অন্তর গ্রীক শিল্পশৈলীর অনুকরণে সৃষ্টি করা মার্বেল পাথরের মূর্তি। আর ওপরে তাকে বিশাল বড় বড় স্টেইন্ড গ্লাস পেইটিং। কাঁচের ওপর আঁকা সুন্দর সুন্দর ছবিতে যীশু খীষ্টের জীবনের এক একটি মুহূর্ত। খ্রীষ্টে জন্ম, 'লাস্ট সাপার', ক্রুশ-বিদ্ধ হওয়া, পুনর্জীবন লাভ... এই সবই ফুটে উঠেছে এক একটি চিত্রের মধ্যে দিয়ে। অল্টার এবং ডায়াস যেখানে সেই জায়গাটিও ভীষণ সুন্দর ভাবে সাজানো। আর অল্টার একটু আগে, মাঝামাঝি অংশে একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে দিকে। সেই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যেতে পারেন পর্যটকরা। সেখানেই পূর্ণ মর্যাদায় শায়িত আছে সন্ত ফিলোমেনার সেই দেহাবশেষ। ভীষণ ভাবে নিয়ম মেনে চলা হয়, সম্পূর্ণ নীরবতা সেই ঘরে। ভেতরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ, অর্থাৎ 'নো ক্যামেরা, নো মোবাইল ফোন, নো ফটো তোলাতুলি'। আমি যেমন পা টিপে টিপে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেছিলাম, সেরকমই বাইরে বেরিয়ে এলাম অন্য দরজা দিয়ে। গির্জাটা পুরো প্রদক্ষিণ করে দেখলাম, সত্যিই দেখার মত সুন্দর ক্যাথিড্রাল। ছবিও তুললাম বেশ কিছু, ওই কমে যাওয়া আলোয়, সন্ধের সাজানো গির্জার ছবি যেমন হয় আর কি! দালী (Daly) নামক একজন ফরাসী স্থপতি নিও-গথিক শৈলীতে এই গির্জার নক্সা প্রস্তুত করেন। অনেকটা কোলোন ক্যাথিড্রালের (Cologne Cathidral) আদলে নির্মিত এই গির্জাটির প্রধান আকর্ষণ ওই স্পায়ার দুটির এক একটির উচ্চতা ১৭৫ ফিট!

গির্জার চারপাশ ঘুরে যখন আবার প্রধান প্রবেশ দ্বারের কাছে ফিরে এসেছি... দেখলাম তখনও পর্যটকরা আসছে, স্থানীয় মানুষরাও গির্জার ভেতরে। কেউ কেউ এগিয়ে গিয়ে একটি বিশেষ জায়গায় মোমবাতি জ্বালাচ্ছে। কেউ কেউ আবার মন্দিরে প্রণাম করার মত গির্জার মেঝেতে একদম শুয়ে পড়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করছে... যাকে বলে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম।
সন্ধেবেলা আলোয় সাজানো গির্জা, পাইন গাছ, চারপাশের পরিবেশ দেখে ভাবছিলাম...কখনও ২৪শে ডিসেম্বার অথবা ২৫শে ডিসেম্বার এই গির্জায় আসতে পারলে কী ভালই না হয়! সে সুযোগ অবশ্য হয়েছিল, প্রায় ৪ বছর পর... সে অন্য গল্প, পরে কোনও দিন সেই দিনের কথা তোমাকে শোনাবো, কেমন?

এই ক্যাথিড্রাল থেকে বেরিয়েই আবার পেটের ভেতর কেমন চুঁই করে উঠল। বেরিয়ে একটা বেকারি থেকে এগ পাফ, কুকি বিস্কুট, ঠাণ্ডা জলের বোতল... এইসব কিনে নিয়ে গাড়িতে বসলাম। তখন প্রায় সন্ধে সাড়ে ছ'টা বেজে গেছে। মহেশকেও একটু ক্লান্ত লাগছিল। একটা এগ পাফ আর এক কাপ চেয়ে খেয়ে ও গাড়িতে এসে বসল। 'টি হোনা স্যার? কফি?' আমি বললাম নাহ্‌, যা দরকার সব কেনা হয়ে গেছে... এবার মানে মানে ব্যাঙ্গালোর ফিরে চল বাপ, এবার ঘরে গিয়ে টেনে ঘুম দেতে হবে। 'ওককে স্যার' বলে মহেশ স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে অশোকা রোডের দিকে ঘুরিয়ে নিলো আমাদের গাড়ি। ক্যাথিড্রাল আর মাইসোর শহরকে পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে গেলাম, প্রথমে বৃহদ মাইসোরের কিছুটা অংশ, তারপর সিদ্দলিঙ্গপুরা... তারপরেই জাতীয় সড়ক। ততক্ষনে একেবারে সন্ধে নেমে গেছে, আকাশ অন্ধকার। মনে হচ্ছে মেঘ জমছে ধীরে ধীরে... রাতের দিকে বৃষ্টি হবে। ব্যাঙ্গালোর পৌঁছনোর আগে রাস্তাতেই হয়ত ঝেঁপে বৃষ্টি নামবে। একটা ভীষণ সুন্দর দিন... এতকিছু প্রথমবার দেখার, জানার অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা আস্ত দিন পেছনে ফেলে এলাম। তবে সেই মুহূর্ত, সেই বিস্ময়, আর সেই স্মৃতিগুলো থেকে গেছে... তাই থেকেই মনে করে করে তোমাকে এতক্ষণ ধরে এতকিছু বলতে পারলাম। আসার সময় একটা অদ্ভুত আগ্রহ থাকলেও ঠিক হাইওয়েতে উঠে এই ঠাণ্ডা হাওয়া চোখে মুখে লাগতে বুঝতে পারলাম শরীরে কতটা ক্লান্তি জমে উঠেছে সারাদিন ঘোরার পর। ফেরার সময় আর জানলা দিয়ে সব কিছু দেখার আগ্রহই থাকল না। মহেশ কন্নড় ভাষায় গান চালিয়ে দিয়েছিল, পুরনো সিনেমার গান... সেই শুনতে শুনতেই চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছিল ঠাণ্ডা হাওয়ায়। এবারে যা কিছু দেখা হ'ল না, তার জন্য আবার আসতে হবে... আসতেই হবে অন্ততঃ আরও একবার বাকিটুকু দেখে নিতে; এইসব ভাবতে ভাবতে মোবাইল ফোনটা সাইলেণ্ট করে চোখ বন্ধ করে নিলাম। মহেশ কে বললাম রামনগর পার হ'লে কোনও হোটেল বা রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড় করাতে। সেখানেই আমরা খেয়ে নেব। আর রামনগর আসতে এখনও অনেক দেরি... ব্যস্‌ আর কোনও চিন্তা নেই!
সেই একই রাস্তা... একই ভাবে শহর, গ্রাম, মফঃস্বল পার করে এগিয়ে যাওয়া... শ্রীরঙ্গপত্তনার ফাটক পেছনে চলে গেলো, চন্নপত্তনার ফাটক পেছনে চলে গেলো... সরকারী সবুজ বোর্ডে একটু একটু করে কমছে ব্যাঙ্গালোরের সঙ্গে দূরত্ব... ১৩৪ কিমি... ১১২ কিমি... ৯৪ কিমি...

(সমাপ্ত)

ছবিঃ উইকিপিডিয়া ও উইকিমিডিয়া কমন্‌স্‌

পুরোপুরি কলকাতার মানুষ হলেও, জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের নিবাস এখন ব্যাঙ্গালোর বা ব্যাঙ্গালুরু। কলকাতারই কলেজ থেকে বি টেক পাশ করে এখন একটি বহুজাতিক সংস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের কর্মী। বাংলা সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা থেকেই মাঝে মধ্যে একটু লেখা আর সময় সুযোগ হ'লে ব্যাগ গুছিয়ে কাছে-দূরে কোথাও বেরিয়ে পড়া, এই নিয়েই জয়দীপ। সেই সব বেড়াতে যাওয়ার নানা রকম অভিজ্ঞতা ছোটদের কাছে বলার ইচ্ছে বহুদিন। সেই ইচ্ছাপূরণ করতেই ইচ্ছামতীর ছোট্ট বন্ধুদের জন্য কলম ধরা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা