সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

বিশ্রী একটা পচা গন্ধ নাকে আসায় আমরা যখন রুমাল দিয়ে জোরে নাক চেপে ধরতে ব্যস্ত তখন সবার আগে থাকা জীবন একটা উঁচু গাছের মগডালে কিছু দেখতে পেল। সকলে এবার দেখলাম মগডালে মরা হরিণ ঝুলছে।

জীবন বললো লেপার্ড মানে চিতা অনেক সময় শিকার নিয়ে যায় মগডালে, যাতে আরাম করে খেতে পারে, এটা তারই কাজ হতে পারে। মেরুদণ্ড দিয়ে একটা হিমেল স্রোত চলে গেল, আমরা সবাই নিরস্ত্র, একটা ছুরিও কার কাছে নেই। কিন্তু জীবন এমন ভাবে আমাদের দিকে দেখছে যেন ব্যাপারটা কিছুই নয়।

কতগুলো শুকনো মোটা গাছের ডাল কুড়িয়ে আনল আর আমাদের হাতে হাতে দিল। এ দিয়ে কি হবে? ও যেন তৈরি হয়েই এসেছিল। ব্যাকপ্যাক থেকে ডিজেল ভেজানো কাপড় বার করল। লাঠির গায়ে জড়িয়ে খুব তাড়াতাড়ি মশাল বানাল। এবার বেরল মানুষের কিম্ভুতকিমাকার মুখোশ।

সবাই এই মুখোশ মাথার পেছন দিকে লাগিয়ে মশাল জ্বালিয়ে এগোলাম, দুপাশে লম্বা লম্বা গাছের ঘন জঙ্গলের বুক চিরে, সাপের মতো আঁকা বাঁকা বনের একফালি শুঁড়ি রাস্তায়। জীবন চলছিল সবার আগে আমরা ওর থেকে পিছিয়ে পড়ছিলাম।

এক জায়গায় রাস্তা বড় বেশি এঁকে বেঁকে গেছে, এটা পেরিয়ে যেতেই আমরা লক্ষ্য করলাম জীবনকে তো আর দেখা যাচ্ছে না। সবাই মিলে গলা ফাটিয়ে ডেকেও সারা পেলাম না। কি হল ওর? ওর ও তো উচিত ছিল একবার পিছন ফিরে দেখা। আরও কয়েকবার চেঁচিয়ে ডেকেও যখন সাড়া পেলাম না তখন মনে কু গেয়ে উঠছিলো।

জীবনের সেই 'আগে গেলে বাঘে...' --- কিন্তু কিছুতো একটা আমরা শুনবো। আমাদের মধ্যে একজন ফিস ফিস করে বলল "চিতা বাঘ নাকি নিঃসাড়ে..." আমরা সবাই তাকে ধমকে উঠলেও, ভয় কিন্তু এবার সবার হতে লাগলো। জীবনের জন্যে আবার নিজেদের জন্যেও।

জীবন সত্যি গেল কোথায়? কিছু পরে তার উত্তরও পেয়ে গেলাম। এমন কিছু পেলাম যা আমরা ভাবিনি কখনও, প্রস্তুতও ছিলাম না একজনও কেউই আমাদের মধ্যে। সবার আগে আমি দেখতে পাই সেটা।

সামান্য দূরে একটা বাঁ হাতি সরু রাস্তা এসে মিলেছে এই রাস্তার সাথে। ঠিক সেই মোড়ের মাথা থেকে একটু দূরে গাছগুলোর আড়ালে একটা মশাল মাটিতে পড়েও জ্বলছে, ওটা যে জীবনের তা যেমন বলার দরকার নেই আর দরকার নেই বলার যে কেন ওটা ওখানে পড়ে।

এতক্ষণ আমরা প্রাণভয়ে ভীত ছিলাম, মুহূর্তের মধ্যে সেটা আদিম হিংস্র মানবের ক্রোধে পরিনত হল। সকলে নিজের নিজের জামা খুলে তৈরি হলাম মশাল গুলো আরো মোটা করতে, বাঘটার আভাস পেলেই সবাই একসাথে ছুড়ে মারব। সবাই মিলে আমরা বৃত্তাকার হয়ে রইলাম,একে অন্যের মুখের দিকে চেয়ে, কোনোদিক থেকে শয়তানটা ঝাঁপাবে কে জানে?

একটা ক্ষীণ আওয়াজ আসছে, আরে এটা তো জীবনের গলা। কিন্তু মনে হছে কাছেই কিন্তু এত লোকের মশালেও তো দেখা যাচ্ছে না, আমরা সবাই মিলে এবার শুনলাম "হেল্প, হেল্প, আমি এখানে"

সবাই মিলে এগিয়ে গেলাম, হঠাৎএকজন আমাকে পেছন থেকে জাপটে না ধরলে আমার অবস্থাও জীবনের মত হত, পড়তাম সোজা একটা পিটের মধ্যে। অবশ্য একা হতাম না।

অন্ধকারে ও যাতে ঘাবড়ে না যায়, সেজন্য একটা মশাল তৈরি করে তার গায়ে দেশলাই বেঁধে নামিয়ে দেওয়া হল, ও চটপট জ্বালিয়ে নিল। কিভাবে ওকে উদ্ধার করা যায় সে নিয়ে আমরা বলাবলি করছি, ও দেখি হঠাৎ গায়েব, গেল কথায়? বলতে না বলতে কোথা থেকে মাটি ফুঁড়ে যেন উদয় হল জীবন।

অভিজ্ঞ লোক, আলো পেয়েই বুঝে নিয়েছে, এখানে কি কাণ্ড- কারখানা চলছিল আর বেরোবার ঢালু রাস্তাটা অর্থাৎ সাব- ইনক্লাইন ও এডীট টা কোথায়।

এখানে চলছিল কোনও বেআইনি খনি এবং সেটা সোনার। পদ্ধতি গত নিয়ম গুলি না মেনে খেয়াল খুসি মতো মাইনিং করলে সোনার ডিম দেওয়া হাঁসের পেটে ছুরি মারার মত হয়। একটু পরে তাতে আর মাইনিং করা যায় না। এখানেও ঠিক সেই কারনে বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে বেআইনি সোনার খনি। আসার সময় দু হাতে যে পাথর গুলো এনেছিল তাতে বেশ কিছু নাগেট খালি চোখে দেখা যাচ্ছে। টন পিছু কম পক্ষে বিশ- পঁচিশ গ্রাম সোনা থাকতে পারে। জীবন যে পিটে পড়ে গেছিল এবার আমরা তাতে সাব-ইনক্লাইন দিয়ে নেমে আরো কিছু পাথর নিয়ে এলাম। সেগুলো স্যাময় চামড়াতে রেখে, হাতুড়ির হাল্কা ঘা দেওয়া হল কিছুক্ষণ ধরে। চামড়ার টুকরোটা হেলিয়ে ধরতেই পাথর গড়িয়ে পড়ল, সোনার দানা চামড়ার টুকরো তে আটকে রইল। আমাদের অনুমানের চাইতে বেশি সোনা আছে দেখা গেল।

আমরা যা খুঁজছিলাম তা পেয়ে গেলাম, বাকি শুধু গ্রানাইট পাহাড়ে ধোঁয়াটে কোয়ার্টজ খুঁজে পাওয়া। সেটা পাওয়া গেলে ওপর থেকে নীচ অবধি... ভাবা যায় না। ইচ্ছে তো করছে এখনই উঠে পড়ি, কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে সাহস আর নেই কারোরই, তার ওপর প্রকৃতি আবার বিগড়ালো। বলতে না বলতে দমকা হাওয়ার সাথে একপশলা বৃষ্টি আমাদের ভেজালো এবং আরও ভেজাবার হুমকি দেবার জন্য কালো মেঘ আকাশের গায়ে রেখে গেলো।

রাতে থাকার ব্যবস্থা জীবন করেছে সরকারী বন-আবাসে, জি পি এস- এ তার স্থানাঙ্ক দিতেই পথ নির্দেশ দেখা গেলো, কিন্তু মেঘের ঘনঘটায় জি পি এস একটু ভুল করলো, আমরা সেটা যখন বুঝলাম, তখন একটু অন্য রাস্তায় চলে এসেছি এক পাহাড়ী ঝর্নার ধারে, প্রায় বিকেল হব হব করছে।

যে পাহাড়ের গা বেয়ে ঝর্না, তাতে একটা গুহা । দেখে মনে হচ্ছে গুহাটা বড়সড়ই হবে। আমাদের সকলের ব্যাকপ্যাকে মিলিয়ে জুলিয়ে যা আছে তাতে অনাহারে রাত কাটবে না, আর শুকনো কাঠের অভাব নেই, নুড্ল্‌ কাপ বানানোতো যেতেই পারে। আর হাঁটা যায় না। প্রায় সবাই আমরা এখানেই রাত কাটাবার জন্য রাজি ছিলাম,কিন্তু জীবন যে যুক্তি দেখাল সেটাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সামনে জলের ঝরনা আর পরিতক্ত্য গুহা, রাতের হিংস্র প্রানিদের আবাসস্থল হতে পারে। গুহার কাছে গিয়ে কিন্তু সত্যি একটা বোঁটকা গন্ধ পাওয়া গেল। কিন্তু জীবন,আমরা যাই কোথায়? তোমার জি পি এস তো ভুলভাল রাস্তা দেখাচ্ছে।

ঝরনার মিষ্টি জল খেয়ে মাথায় একটা বুদ্ধি খেলল সবাই সেটা মেনেও নিল। এই ঝরনা ধরে মাত্র আধ কিলোমিটার নেমে গেলে অবশ্যই থুলি নদী, আমাদের টোপোগ্রাফিক ম্যাপ তো আর জি পি এস নয় যে ভুল কিছু পথ দেখাবে। কিন্তু তাতে কি? আরে ভাই বোঝো না কেন? নদী মানেই এই নদীর পাড়ে বা তার আশেপাশে গ্রাম বা মানুষের বসতি হতে পারে। রাতের আশ্রয় মিলতে পারে এমন কি খাবারও হয়ত।

জীবন আর ওর দেশোয়ালি এক ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আমাদের একজন রসিকতা করতে ছাড়ে না। " দেখগে হয় তো এদের কারো শ্বশুর বাড়ি হতে পারে, কি জীবন! জামাই আদরের খাবারের ভাগটা দেবে তো... "

রসিকতা শুনে জীবন আর তার সঙ্গী দুজনেই সাদা দাঁত বের করে হেসে ওঠে।

হাসতে হাসতে আমরা থুলি নদীর পাড়ের কাছে পৌঁছালাম অনেক তাড়াতাড়িই আর সেখানে এসে বেশ কিছু নিষ্ঠুর সত্যির সামনে দাঁড়ালাম।

প্রদীপ কুমার বিশ্বাস পেশায় খনিজ অনুসন্ধানিক ভুতত্ববিদ; নেশা লেখা এবং অন্যের লেখা পড়া। পেশার জন্য পৃথিবীর নানাদেশে কাজ করতে হয়েছে, দেখেছেন কাছ থেকে,প্রকৃতির বিভিন্ন রূপ, মানুষ এবং জীব জন্তু এবং অনুভব করেছেন তাদের সুখ, দুঃখ, হাসি কান্না। বেশি লেখা সেই সব অভিজ্ঞতা নিয়ে।

More articles from this author

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা