সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

ঝরনার জলে স্নান করে আমরা যখন ফিরে এলাম গেস্ট হাউসের আঙ্গিনার টিন শেডে তখন কাঠের উনু্ন জ্বলছে দু তিনটে।

রবার্ট গাড়ি ঠিক করিয়ে, মেকানিক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে খুঁজে খুঁজে চলে এসেছে। সঙ্গে একবস্তা জোয়ার-গম মেশানো আটা, সয়াবিন তেল আর তেলচুকচুকে কালো রঙের একটা পাঁঠাও এনেছে। মুরগি আজ অনেকগুলো কেটে ফেলেছে, কালো পাঁঠার সদব্যবহার কাল হবে। আপাততঃ সে আগুনের অদূরে এক জায়গায় বাঁধা, কাঁঠাল পাতা মত কিছু চিবিয়ে চলেছে।

মেকানিক লোকটি বয়স্ক,ও এখানকার সব পাহাড় জঙ্গল হাতের তালুর মত চেনে। এখানের পাহাড় জঙ্গলের গল্প শুনছিলাম আমরা সব। তাকে আমরা যখন এক জায়গাতে গাছের ওপরে মরা হরিন দেখার কথা বললাম সে হেসে আকুল। এটা কোনো 'পোচার' অর্থাৎ চোরা শিকারি বাহিনীর কাজ। ও দিকে আর চিতা কই? এ তল্লাটে একটা চিতার পরিবার ছিল,শুনি একটা তরুণী চিতা আর তার বাচ্চা দু- তিনটে এখনো বেঁচে আছে। তবে আজ শুনলাম সে মাদি চিতাটার কয়েকদিন হল দেখা নেই, বাচ্চা গুলোকে হয়তো লুকিয়ে গেছে গুহাটায়...

"গুহাটায় মানে? আমরা একটু আগে সেই ঝরনার ধারে..."
মেকানিক বন্ধুটি তাচ্ছিল্যের সাথে বলে, " হ্যাঁ, এ তল্লাটে এই ঝরনার মত, বাঘদের থাকার মতো তো ওই একটাই গুহা"
জীবন আমাদের দিকে, বিশেষ করে আমাদের কয়জন যারা আজ রাতটা ওই গুহা তে থাকবার প্ল্যানিং করেছিলুম, তাকিয়ে বলল, "আমি তো তখনি তোমাদের মানা করেছিলাম, ভাগ্যিস তোমরা আমার কথাটা..." জীবন এটা অবশ্য বললো না যে চিতার গুহাতে কার জি পি এস এর জন্য পথ ভুলে আমরা পৌঁছেছিলাম।

মেকানিক ভদ্রলোক বললেন, "ভাগ্য তোমাদের সাথে এই বিকেলেও ছিল। সেটা না হলে তোমাদের মধ্যে কেউ একজন এখানে আমাদের সাথে গল্প করত না"
আমি বললাম "তুমি কি বলতে চাইছো?"
"দিন দুই আগে হলে সন্ধে হব হব সময়ে, ঘাসের বনের বুক চিরে যে পাকদণ্ডী রাস্তাটা এখানে এসেছে, সেখানে একটা চতুর পুরুষ চিতা অপেক্ষা করত পথভোলা কোনো বাছুর বা ভেড়ার জন্যে। পায়েচলা তোমরা তো তার কাছে আরো সোজা শিকার ছিলে। তোমাদের ভাগ্য ভালো, যে তোমাদের একদিন আগে আসা অতিথিরা তার কপালে কতোগুলো বুলেট বিঁধিয়ে দিয়ে, তার চামড়া টা হয়ত এখন হারারের বাজারে বিক্রি করে দিয়েছে। তোমরা যে চিতার গুহায় আজ রাত্রে থাকবে বলে ঠিক করেছিলে, সেটা এই বাংলোর ছাত থেকে দেখা যায়। আকাশে মেঘের তেমন উৎপাত না থাকলে এই চাঁদনি রাতে দেখা যায় ঝরনা সমেত পুরো উপত্যকাটা "

গভীর রাতে ছাদে ক্লান্ত সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, আমি আর জীবন ঘুমাইনি। দুটো নাইট ভিসন বাইনোকুলার নিয়ে আগুন পোয়াতে পোয়াতে শুনছি, জ্যোৎস্না ধোয়া আকাশে, রাতের প্রকৃতির অর্কেস্ট্রা। ঝর্ণার কলতানের সাথে ঝিঁঝিঁর ঐকতান, সংযোজনায় প্রহর জাগা শিয়াল আর রাত জাগা পেঁচা। দর্শকের অভাবে তাতে বেদনা মাখা সুর। কিন্তু এলো সেই ডাকে সাড়া দিয়ে একদল বাদামি ইম্পালা হরিনের দল,ঘাড় নামিয়ে মুখ ডোবায় ঝর্নার স্ফটিক জলে।

হঠাৎ কেন জানি, এক সতর্ক আওয়াজ আসে তাদের মধ্যে। নিস্তব্ধ উপত্যকা ছাড়িয়ে সেটা আমাদেরও কানে আসে। মুহূর্তে তাদের বিদ্যুৎ বেগে পালিয়ে যাওয়ার আওয়াজে ঘাসবনে ধূলিঝড় ওঠে, তবে কি...। ফিস ফিস করে জীবন বলে ঝরনার দিকে আর গুহার কাছে নজর রাখো কিছু দেখা যেতে পারে।

আধ ঘণ্টা কেটে যায়, বাইনো ধরা হাত দুটো ব্যথা করে, ঘুম নেমে আসে চোখে, কিন্তু এটা কি? গেস্ট হাউস থেকে ঝরনাতে যাবার জন্যে রাস্তায় দেওয়ালে একটা বড় গর্ত করা আছে। অবশ্য ওটা একটা বাঁশের গেট দিয়ে বন্ধ করা আছে।

ঠিক সেই দিকের দেওয়ালের ধারে এক জোড়া আগুনের ভাঁটার মত জ্বলছে ওটা কি? ওদিকে অনেক কটা গাছ পাশাপাশি, চাঁদ এখন ঠিক ওগুলোর ওপরে থাকায় বেশ অনেকটা ছায়া তৈরি হয়েছে। নাইট ভিসনও বোঝা যাচ্ছে না। জীবন ওর নাইট ভিসন কে গলায় ঝুলিয়ে ঢুলছিল, টোকা মারি ওর পিঠে।

ব্যাপারটা চট করে জীবন বুঝে নিয়ে ছাদের সিঁড়ি রাস্তায় নামানো কোলাপসিবল সাটারের দিকে তাকিয়ে আমাকে আশ্বস্তকরে বললো "আরো এরকম দুটো বন্ধ গেট পেরিয়ে তবে জানোয়ারটা এখানে আসতে পারে। ভয় নেই, আমি নিজে বন্ধ করেছি। আমাদের মধ্যে কেউ যদি ঝরনা থেকে ফেরার পথে গেটটা বন্ধ করতে ভুলে যায় তবেই এই আঙ্গিনা তে ঢুকতে পারে, আর শুধু শুধু আঙ্গিনাতে ঢুকবেই বা কেন?"

জীবনের কথা শেষ হতে না হতেই টিন শেডে বেঁধে রাখা রবার্টের আনা নধর পাঁঠাটা বোধ করি বিপদ আন্দাজ করে ব্যা, ব্যা আর্তনাদ করে ডেকে আমাদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিল।

পলক ফেলার কম সময়ে মনে হল আঙ্গিনাতে একটা ঝড় বয়ে গেল,চাঁদের আলো আর নাইট ভিসন থাকা সত্ত্বেও মনে হল অনেক গুলো সাদা কালো বিন্দু একসাথে টিন শেডের দিকে তীব্র বেগে হারিয়ে গেল।

পরিষ্কার দেখা গেল তাকে, তার ফেরার সময়ে, কালো পাঁঠাটাকে মুখে কামড়ে টেনে নিয়ে যেতে ব্যস্ত সে তখন। এটি খুব সম্ভবত সেই তরুনি চিতাবাঘটি। কি মনে করে সে এক লহমার জন্যে আঙ্গিনাতে থেমে গেল, সদ্য শিকার করা পাঁঠাটাকে একবার দেখে নিলে।

কিছু পরে, গভীর রাতের স্তব্ধ উপত্যকায় একবার শোনা গেল বাঘের চাপা হুঙ্কার, নাইট ভিসনে দেখা যাচ্ছিলো ঠিক গুহার কাছে তিন চার জোড়া ছোটো ছোটো আগুন চোখ।

আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল, আজ বিকালে থুলি নদীর তীরে দেখা সেই শ্রমিক রমণীটিকে। আমাদের কাছ থেকে পাওয়া আর আমার ইচ্ছে করে ছেড়ে আসা কাপ নুড্‌লগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে ঘরে রেখে আসা অভুক্ত শিশুদের কথা মনে করতে করতে এপ্রনের ভিতর দ্রুত লুকিয়ে নেওয়া সেই খুশি-খুশি মুখ। যেটা দেখিনি তখন সেটা এখন পুরো হল। এক ক্লান্ত উপবাসক্লিষ্ট মা বয়ে নিয়ে চলেছে, তার পথ চেয়ে থাকা উপোসি শিশুগুলোর উপাদেয় আহার। সত্যি, মায়েরা সব সমান, তা সে মানুষ হোক আর চিতাবাঘ।


(* এই সত্যাশ্রয়ী গল্পটি কিছু সত্য ঘটনার আংশিক সংমিশ্রণে রচিত কাহিনি মাত্র, বাস্তব কোনও স্থান, কাল, ব্যাক্তির সাথে সাদৃশ্য কাকতালীয় মাত্র। সমস্ত আলোকচিত্রগুলি লেখক দ্বারা গৃহীত।)

প্রদীপ কুমার বিশ্বাস পেশায় খনিজ অনুসন্ধানিক ভুতত্ববিদ; নেশা লেখা এবং অন্যের লেখা পড়া। পেশার জন্য পৃথিবীর নানাদেশে কাজ করতে হয়েছে, দেখেছেন কাছ থেকে,প্রকৃতির বিভিন্ন রূপ, মানুষ এবং জীব জন্তু এবং অনুভব করেছেন তাদের সুখ, দুঃখ, হাসি কান্না। বেশি লেখা সেই সব অভিজ্ঞতা নিয়ে।

More articles from this author

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা