সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
ঊদেয়ার রাজাদের দেশ - মহীশূর - পর্ব ৫
টিপু সুলতানের গ্রীষ্মাবাস

সময় বেশ দ্রুত কেটে যাচ্ছিল... এই ভাবে চলল, শ্রীরঙ্গপত্তনা শেষ করতেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল এসে যাবে। সৌধের বাগান থেকে বেরিয়ে আবার বড় রাস্তায় এসে পৌঁছলাম। কিছু দূরে এগিয়েই রাস্তার ঠিক উলটো দিকে আবার ফলক - Tipu's Summer Palace। একটা বিশাল ফাটক (দেখে অনেকটা স্কুলবাড়ির মত মনে হবে), আর তার ওপারে সেকেলে জমিদার বাড়িতে যেমন ঠাকুরদালান থাকত, সেরকম ঠাকুরদালানের মত একটা ইমারৎ। তবে বেশ প্রশস্ত, আর উঁচু। এই ইমারৎটিকে টিপু সুলতানের গ্রীষ্মকালীন আবাস বলে চিহ্নিত করা হয়। বাগান বাড়ির মধ্যে দোতলা পাকা বাড়ি। সামনে লম্বা জলাধারে ফোয়ারার ব্যবস্থা। আর চারপাশে সুন্দর করে সাজানো বাগিচা, নানারকমের ফুলের, ফলের আর বাহারে গাছ। বাগিচার মাঝখানে প্রাসাদ বলে নাম দরিয়া দৌলত বাগ। দরিয়া কোথায় তা টের পেলাম না অবস্য। হয়ত কাবেরী নদী (যা অনেকটা পেছনে ফেলে এসেছি, তার কোনও ধারা এই প্রাসাদের ভেতরে খাল কেটে টেনে আনা হত পরিখা করে। কিংবা কোনও বৃহৎ জলাশয় ছিল বাগানের একদিকে, তা আর নেই এখন। এখন শুধু নামেই রয়েগেছে দরিয়া দৌলত বাগ... বাগ আছে... দরিয়া বা দৌলতের চিহ্নমাত্র নেই। সাহেবদের নাম 'টিপু'জ সামার প্যালেস' (Tipu's Summer Palace)। ব্যাঙ্গালোরেও সুলতানের একটি গ্রীষ্মকালীন আবাস রয়েছে, তাকেও সামার প্যালেস বলেই চিহ্নিত করা হয়। তবে সে কাঠামো নেহাৎই ছোটখাটো এর তুলনায়। বিস্তৃত জমি, বাগান, রাজকীয় ফোয়ারা আর তোপের মাঝে সাজানো এই প্রাসাদ, সামার প্যালেস হিসেবে অনেক বেশি খোলতাই।

ঊদেয়ার রাজাদের দেশ - মহীশূর - পর্ব ৫
গ্রীষ্মাবাসের সামনে

গেট পার হয়ে ঢুকতে হ'ল সেই টিকিট কেটেই। পর্যটকদের ভিড় এখানেও কম নয়। তার ওপর দেখলাম একটা বাস থেকে বেশ কিছু স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীও নেমে এলো। একদম লাইন দিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে পিলপিল করে। সঙ্গে থাকা শিক্ষক বা স্কুলের কর্মীরা তাদের শোরগোল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে রীতিমত। সবার মাথায় লাল-হলুদ টুপি রোদ্দুরে ঝলমল করছে। সেই লম্বা জলাশয়ের ধার দিয়েই বাঁধানো হাঁটার রাস্তা চলে গেছে প্রাসাদের দিকে। আর সেই রাস্তার দু'ধারে গাছের সুন্দর করে রক্ষণাবেক্ষণ করা গাছের সারি। সেই জলাশয়ের বেশ খানিকটা অংশ যে মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে তাও বোঝা যায়। সেইখানে বেড়ে উঠেছে ছোট ছোট রঙিন পাতার গাছ, যত্ন করেই রাখা। জলাশয় অবশ্য একেবারে খটখট করছিল... জল ছিল না। হয়ত মাঝে মাঝে জল দিয়ে রাখে, ফোয়ারাও চালায়, বিশেষ বিশেষ সময় বা দিনে। দেখে বোঝা যায়, এমন সুন্দর করে সাজানো বাগানে, এই ফোয়ারার জলে যদি পদ্মপাতা ভাসে, পদ্মফুল ফোটে... আর ছোটছোট মাছ ঘুরে বেড়ায় জলে, তাহ'লে কি চমৎকারই না লাগবে! তোমরা যখন যাবে, তখন কেমন তার চেহারা থাকে, জানিও... কেমন?

ঊদেয়ার রাজাদের দেশ - মহীশূর - পর্ব ৫
সবুজ চিকে ঢাকা গ্রীষ্মাবাস ভবন

প্রাসাদের কাছাকাছি এসে বুঝলাম, ভেতরে বেশ ভিড়। হয়ত বাইরে রোদ্দুরের তেজ বেড়েছে বলেই, ওই ঠাণ্ডা ঘরগুলোয়, ছায়ার মধ্যে খানিকটা সময় কাটিয়ে নিতে চাইছে অনেকে। আসলে সব জানলা, দরজা, এমনকি দোতলার বারান্দাগুলোও লম্বা সবুজ চিকের পর্দা দিয়ে ঢাকা। মনে হচ্ছিল, এর জন্য বাইরের গরম হয়ত ভেতরে যায় না সেভাবে। বাইরেও ভিড় কম নয় যদিও, বড় বড় গাছের ছায়ায়... বাগানের এদিক ওদিক মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় নিজেদের আর মুহূর্তগুলোকে ধরে রাখার জন্য ব্যস্ত সবাই। প্রাসাদের ঢোকার ঠিক মুখেই দু'দিকে দু'টো পেল্লায় কামান। এদিক ওদিক আরও কিছু মাঝারী-ছোট কামান চোখে পড়ে। কিন্তু এই কামানদু'টি সত্যিই রাজকীয়। ভাল করে লক্ষ করলে ওপরে কোনও বৃটিশ কোম্পানীর শিলমোহর দেখা যায়। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা টিপু সুলতানের প্রাসাদেজ বৃটিশ শিলমোহর দেওয়া কামান! এসব ভেবে তোমরা আবার অবাক হয়েও না। এমন হয়েই থাকে। সেইসময় বিলিতি কামান-প্রস্তুত কারক অনেক সংস্থা আমাদের দেশে রাজা-বাদশাহদের জন্য কামান তৈরী করে দিতো মোটা অর্থের বিনিময়ে। আবার, কোনও কোনও যুদ্ধে বিপক্ষকে পরাস্ত করার পরে, তাদের অস্ত্রও বিজয়ীদের দখলে চলে যেতো। এই কামানগুলোর এখানে থাকাও সেইরকমই কোনও কারণ।


পুরনো কামান এবং সাথে রাখা পাথরের গোলা

কামান দু'টোকে দেখে তখনকার মত প্রাসাদের ভেতরে যাওয়ার ইচ্ছেটা ফিকে হয়ে গেল। কিছুক্ষণ তার গায়েই হাত দিয়ে দেখলাম। না জানি কোন যুদ্ধে কোন কাজে লেগেছিল। কত তোপই না দাগা হয়েছে এদের থেকে। এখন সামনের দিকে মুখটা বন্ধ করে দেওয়া। আর যেখানে ডালা খুলে গোলা রাখা হয়, সেও একদম সিল করে দেওয়া ঢালাই লোহা দিয়ে। মুখের ব্যাস আর কামানের দৈর্ঘ্য দেখলে বোঝা যায়, জোরালো কামান ছিল নিজের সময়ের। আর একটা কামানের ঠিক পাশেই রাখাছিল স্তুপ করে রাখা বড় বড় গোল পাথরের গোলা। কেউ কেউ ওগুলোকে দেখিয়ে বলছিল, কামানের গোলা। আসলে তা নয় মোটেই। এইরকম কামানের ভেতরে অমন বড় আয়তনের পাথরের গোলা ব্যবহার হওয়ার কথাই নয়। এগুলো প্রতিরক্ষার জন্য ব্যবহার হ'ত। প্রাসাদে কখনও অতর্কিতে আক্রমণ হ'লে... প্রাসাদের খুব কাছাকাছি শত্রুপক্ষের কেউ চলে এলে এই সব ভারী ভারী পাথর প্রাসাদের ওপর থেকে তাদের লক্ষ করে, তাদের ঘোড়াদের লক্ষ করে ছুঁড়ে ফেলা হ'ত। অনেক সময় এইগুলোকে খুব জোরে গড়িয়ে দেওয়া হ'ত ঘোড়াদের দিকে, যাতে তালগোল পাকিয়ে পড়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে। বেশ কিছুক্ষণ এই কামান আর গোলাগুলোর কাছাকাছি ঘুরে ফিরে দেখলাম। অনেকে এইসব কামানের পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিল। গোলাগুলোকে তোলার চেষ্টা করে ছবি তুলছিল একদল ছেলেপুলে। তাদের অঙ্গভঙ্গি আর হাবভাব দেখলে তুমি হেসে কুটোপাটি যেতে।


গ্রীষ্মাবাসের ভেতরে টিপু সুলতানের প্রতিকৃতি

প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করেই দু'টো কথা টের পেলাম; কেন এর নাম সামার প্যালেস... আর কেন যারা ভেতরে ঢুকছে, তারা বাইরে আসতে এত সময় দিচ্ছে। সত্যিই ভেতরের তাপমাত্রা বাইরের থেকে খানিকটা কম। বাগানের ঠাণ্ডা হাওয়া, যা বাইরে রোদ্দুরে টের পাওয়া যায় না... তা এই দালানে দাঁড়িয়ে দিব্যি টের পাওয়া যায়; ফুরফুরে হাওয়া বইছে এদিক ওদিক। পুরোপুরি নির্মানশৈলীর কেরামতি। চারিদিকে চিকের পর্দা বাইরের রোদ্দুর আটকে রেখেছে। বাড়ির দেওয়াল বেশ চওড়া এবং ছুঁয়ে দেখলে বোঝা যায় কেমন ঠাণ্ডা। তার ওপরে এমন বাগানের হাওয়া খেলে বেড়াচ্ছে। ভেতরে এতলোকজন, এতরকম কথাবার্তার শব্দ... ছোটদের চ্যাঁচামেচির মধ্যেও ঘরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে আছে। বুঝতে পারলাম, দোতলায় যাওয়া নিষেধ... যা কিছু সব এই একতলাতেই ঘুরে দেখতে হবে। আর লোকজন দল বেঁধে এ ঘর ও ঘর ঘুরে আবার বারান্দার দিকে ফিরে আসছে... না হলে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত। লোকজনের এই ভিড় সামলেই যা কিছু চোখে পড়ে, তা বোঝার চেষ্টা করলাম। ঠিক আমাদের পুরনো জমিদার বাড়িগুলো যেমন হয়, সেরকম নির্মান। ছাতে ঝাড় বাতি... দেওয়ালে দেওয়ালে ঝাড় লণ্ঠন। যদিও তাদের সংখ্যা বেশি নয়, আর চাকচিক্ক ম্লান হয়ে গেছে। তাও সুলতানের 'দৌলত'-এর যে রোশনাই ছিল, তা আন্দাজ করা যায়। ঘরের দরজাগুলোও বেশ উঁচু উঁচু। স্থানীয় লোকজন বলে, সুলতান নিজে নাকি খুবই লম্বা ছিলেন। হয়ত এই দরজাও সেই কারণেই এতটা উঁচু। অবশ্য, এমন লম্বা হওয়ার গপ্পো প্রায় সব নবাব-সুলতানের সম্বন্ধেই চলে। বাংলার নবাব মুরশিদ কুলী খাঁয়ের সমাধি দেখতে গিয়েও শুনেছি ওনার উচ্চতার কথা। যাইহোক, এই প্রাসাদ বা রাজবাড়ি... এখন আসলে একটি সংগ্রহশালা। টিপু-সুলতান এবং শ্রীরঙ্গপত্তনার সেই সময়ের নিদর্শনের একটু ক্ষুদ্র যাদুঘর বলতে পারো। দেওয়ালে রঙ-এর ওপর সেই সময় আঁকা পটচিত্র এখনও সুন্দর ভাবে রক্ষিত। বেশ কিছু তৈলচিত্র আছে ঘরগুলোতে। সুলতানের নিজের একটি দীর্ঘ তৈলচিত্র সযত্নে রক্ষিত। এ ছাড়াও আছে সুলতানের পোষাক, বর্ম, কৃপাণ, তলোয়ার। সেই সময় ব্যবহৃত বন্দুক। সেই সময়কার শ্রীরঙ্গপত্তনমের ছবি... শিল্পীর চোখে। পুরনো আমলের স্কেচ উনবিংশ শতাব্দী বা অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রীরঙ্গপত্তনা। এবং এরকম আরও অনেক কিছু। ভেতরে ছবি তোলা নিষিদ্ধ। তাও অনেকে ক্যামেরা মোবাইলের ব্যবহার করে। কিন্তু বিশ্বাস কর, ওতে কোনও লাভ নেই। ও জিনিস সামনে থেকে দেখে যা আনন্দ পাবে, ছবি দেখে তা পাবে না।

এই দরিয়া দৌলত বাগের ওই সুলতানী গ্রীষ্মাবাসের ভেতরে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে, আবার যখন বাইরে বেরোলাম, তখন একেবারে ঝাঁঝাঁ রোদ। সকালের সেই মেঘলা দিন একেবারে ফুস করে উবে গেছে আমাকে বোকা বানিয়ে। পর্যটকদের ভিড় বেড়েই চলেছে। সেই বাগানের বাঁধানো পথ ধরেই গেটের দিকে হাঁটতে থাকলাম আবার। আশেপাশের বাগান দেখে মনে হচ্ছিল, কোনও সময় যদি সত্যিই এমন পর্যটকের ভিড় না থাকে, এর থেকে সুন্দর জায়গা আর পরিবেশ আর কিছু হতেই পারে না। অথচ ইচ্ছে থাকলেও এই গরমে আর এত ভিড়ে এখানে থাকার কোনও মানে নেই বেশিক্ষণ। এদিকে ঘড়ির কাঁটা ছুটছে... একটা বাজতে যায়। বেরিয়ে আসতেই মহেশ বলল "স্যার লাঞ্চ হোনা?" আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম ওর খিদে পেয়েছে কি না, বলল "পরোয়া নেই"। আমিও বলে দিলাম সঙ্গে সঙ্গে... "তো শ্রীরঙ্গপট্‌না কমপ্লিট করকে লাঞ্চ করেঙ্গে... ফির মাইসোর।" মহেশ এক কথা "ওক্‌কে স্যার" বলে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিলো। আমাদের গাড়ি ওই রাস্তা ছেড়ে আবার মাইসোর হাইওয়ে তে এসে পড়ল... এগিয়ে গেল রাস্তার ওপারে দিকে... সামনে শ্রীরঙ্গপত্তনা নগরীর একসময়ের প্রধান দ্বার... এখন ভগ্নদশাপ্রাপ্ত।


ছবিঃ লেখক

পুরোপুরি কলকাতার মানুষ হলেও, জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের নিবাস এখন ব্যাঙ্গালোর বা ব্যাঙ্গালুরু। কলকাতারই কলেজ থেকে বি টেক পাশ করে এখন একটি বহুজাতিক সংস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের কর্মী। বাংলা সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা থেকেই মাঝে মধ্যে একটু লেখা আর সময় সুযোগ হ'লে ব্যাগ গুছিয়ে কাছে-দূরে কোথাও বেরিয়ে পড়া, এই নিয়েই জয়দীপ। সেই সব বেড়াতে যাওয়ার নানা রকম অভিজ্ঞতা ছোটদের কাছে বলার ইচ্ছে বহুদিন। সেই ইচ্ছাপূরণ করতেই ইচ্ছামতীর ছোট্ট বন্ধুদের জন্য কলম ধরা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা