সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
আর্মি -র ডাক্তার

আমরা তিন বুড়ো রোজই বিকালের দিকে জুবিলী পার্কের বেঞ্চে বসে আড্ডা মারি। আমরা তিনজন-ই প্রাক্তন সরকারী কর্মচারী এবং এখন পেনশনভূক। তিনজনই প্রায় একই সময়ে অবসর গ্রহণ করেছি। তাছাড়া আমাদের পারিবারিক অবস্থা প্রায় একই আর, য়ার মনের মিলও খুব। ফলে, আমাদের আড্ডা জমে ভালো এবং খোলা মনে, খোলামেলা আলোচনাও চালানো যায়।

আমাদের একজন, যাকে আমরা দুজন সমীর দা বলে ডাকি , তিনি তাঁর বুকের ব্যথা নিয়ে মাসখানেক যাবৎ, একটু চিন্তিত ছিলেন। আমাদের বলতেন যে , তিনি ডাক্তার দেখাচ্ছেন , নানান পরীক্ষা -নিরীক্ষা করাছেন এবং গাদা -গাদা ওষুধ খাচ্ছেন। অথচ , তাঁর অসুবিধা এখনো মাঝে-মাঝেই চাগিয়ে ওঠে । মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, সব ওষুধ তিনি বন্ধ করে কিছুদিন দেখবেন , কিন্তু , আমাদের বৌদির তীক্ষ্ণ নজর ও জিজ্ঞাসাবাদের ঠ্যালায় , সেটা হবার যো নেই ।

অনেক ইতস্ততঃ করার পর এবং মেলা আগু-পিছু ভাবার পর, আমি একদিন বলেই বসলাম , " দাদা আপনার অসুখটা ও তার চিকিৎসা নিয়ে একটু বলুন তো শুনি, ডাক্তার না হয়েও যদি আপনাকে আমি কোন সদুপোদেশ দিতে পারি।" সমীর-দা চট করে রাজী হয়ে বললেন - "ভায়া ,আমি তো কতদিন ভেবেছি যে, আপনাদের আমার অসুখের ব্যাপারটা একটু বলব । কিন্তু, যদি আপনাদের মনে বিরক্তি ঘটে বা আপনারা অসহায়ভাবে বলে দেন, দেখুন দাদা, আমরা তো কেউ ডাক্তার নই যে..... তাই আর বলে উঠতে পারি নি । আজ আমার দ্বিধা থাকলো না এবং তাহলে শুনুন,

গত মাস-খানেক ধরে আমার বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছিলো। তার সঙ্গে পরিশ্রম বা আপনাদের বৌদির সঙ্গে প্রায়ই ঝগড়া লেগে যাওয়া ইত্যাদি কোন কিছুর যোগাযোগ নেই। এর সাথে খালি পেট বা ভরাপেট কিংবা দিনের বা রাতের কোন সময়ের কোন সরাসরি সম্বন্ধও নেই । আমার ওই সুগার-ফুগার বা ব্লাড -প্রেশার আজও হয় নি । তাই আমি ব্যথা শুরু হবার সপ্তাহ দুই বাদে পাড়ার এক ডাক্তারকে দেখাই। ডাক্তারবাবু তো আমাকে খুব কথা শোনালেন , আমি কেন নিজের সম্পর্কে এত উদাসীন সেটাও জিজ্ঞাসা করলেন ,তারপর নানান রক্ত-পরীক্ষা আর ইসিজি করাতে বলে দু-সপ্তাহের ওষুধ লিখে, রিপোর্ট নিয়ে কদিন পরে আসতে বললেন। সেই মতো, পরে আবার আমি যেতে, উনি রিপোর্ট দেখে বললেন , আপনার তো কোলেস্টেরল বেশী আর হার্টে ইসকিমিয়া হয়েছে। তারপর, পাঁচটা আরো নতুন ওষুধ লিখে রেস্ট-এ থাকতে বলে একমাস পরে রিপিট -ইসিজি সহ যেতে বললেন। সেই ওষুধ খেয়ে আমার সারাদিন মাথা ধরে থাকতো আর বুকের ওই চিনচিনে ব্যথার খুব উপশম হল না । মনে তো ভয় ঢুকে গেল, আমি একজনের সাহায্যে, গেলাম মেডিকেলে এক কার্ডিওলোজিস্ট-কে দেখাতে। বাপস, কি ভীড়। আমার আবার একটা ইসিজি হল ওখানে। উনি আমার ইসিজি দেখে, আগের ডাক্তারের প্রেসকিপশন পড়ে বললেন, আপনার হার্টে ইসকিমিয়া আছেই তো. আমি নতুন করে অন্য ছয়টা ওষুধ লিখে দিছি। আগেরগুলো বাতিল করে এখন থেকে এই ওষুধ খেয়ে ,ছয় সপ্তাহ পরে আসবেন। বুকে অসময়ে বেশী ব্যথা উঠলে, হাসপাতালের ইমার্জেন্সী -তে চলে আসবেন। আপনাকে আই .সি. ইউ -তে তক্ষুনি ভর্তি নিয়ে নেবে- অবশ্য যদি বেড খালি থাকে।

আমি আরো ভয় পেয়ে গেলাম । মনে ভাবলাম, যা খরচা হয় হোক , আমি বাড়ির কাছের বড় হার্ট সেন্টারে গিয়েই দেখাবো। টাকা আগে , না, প্রাণ আগে ? দু-দিন পরে ওখানে গেলাম। কর্পোরেট হাসপাতাল, ঝাঁ -চকচকে ছ - তলা বাড়ী , গেটে সিকিউরিটি ,মাঝখানে ফোয়ারা - হাসপাতাল বলে মনেই হয় না । রিসেপশানে পাঁচশো টাকা গেল টিকিটের জন্য। তারপর ওরা আমার ফাইল বানালো , আর গলায় ব্যাজ পরিয়ে দিয়ে লিফটে করে চারতলায় নিয়ে গেল । সেখানে, মুহুর্তে রক্ত-পরীক্ষা , প্রেশার মাপা এবং অ্যানজিওগ্রাম হয়ে গেল । একটু পরে বড় ডাক্তারবাবুর ঘরে ডাক পড়লো। উনি আমায় খাটে শুইয়ে , বুকে ওনার স্টেথো বসিয়ে কিছু শুনলেন, তারপর আমাকে খালি-গা করে , ইকো বলে একটা টেস্ট করলেন। তারপর ওখানেই,গভীর চিন্তান্বিত মুখে বললেন , আপনার মেডিক্লেম করা আছে তো ? আমি ' না ' বললাম। উনি বললেন , আপনি দেরী করে ফেলেছেন এখানে আসতে। অ্যানজিওগ্রাম ও ইকো -কোনটাই খারাপ কিছু শো করছে না ,কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলে, আপনার বয়সে এই সিম্পটম-টা এলার্মিং। ভর্তি হতে হবে- কারণ আপনার বাই-পাস সার্জারী লাগবে , না হলে , এই ব্যথা সারবে না। বরং উল্টে , কোনদিন ম্যাসিভ অ্যাটাক হয়ে যাবে। কিন্তু এর তো প্রচুর খরচ , সাত লাখের প্যাকেজ ,ওটাকে তবু ছয়ে নামিয়ে আনা যাবে, একদিন আগে ডিসচার্জ করে দিয়ে। যাক গে ঠিক আছে, বাড়ী গিয়ে আলোচনা করে নিন, তারপর পরশু চলে আসবেন। আমার মাথা ঘুরতে লাগলো, মুখ তো শুকিয়েই গেল। বললাম , আমার তো ব্যথা অনেক কমেছে। আর কিছুদিন ওষুধ খেয়ে দেখলে হতো না ? ডাক্তারবাবু ব্যঙ্গ করে বললেন, কে কার ওপিনিয়ন নিতে এসেছে ? আপনি আপনার জীবন নিয়ে খেলতে চাইলে , যা খুশি করুন ।

আমি বাড়ী ফিরে এলাম, কিন্তু কাউকে কিছু বলতে পারছি না। অত টাকা কোথায় পাবো - তারপর তো রাস্তায় বসতে হবে !"

আর্মি -র ডাক্তার

আমার খুব খারাপ লাগলো। বললাম, "দাদা, আমার ছেলে কলকাতা কমান্ড হাসপাতালের সিভিলিয়ান স্টাফ। ওর মুখে ,ওদের আর্মির ডাক্তারদের কথা শুনি। আপনি ওখানকার কার্ডিওলোজিস্ট-কে একবার দেখান তো ।ওনার নাম ডক্টর গোপালন, ভালো ডাক্তার বলেই শুনেছি।ভালো বাংলা বলতে শিখেছে। আপনি চাইলে, ছেলে ওনাকে দেখানোর ব্যবস্থা করে দেবে। "একটু ভেবে,সমীরদা রাজী হলেন।তবে,শর্ত দিলেন যে, উনি ডক্টর গোপালনের উপদেশ না মানলে, আমার ক্ষুব্ধ হওয়া চলবে না । বললাম,"না না-আপনার ব্যাপারটায় আপনিই শেষ কথা।"মনে ভাবলাম যে বাইপাসের চিন্তা সমীরদার মাথায় ভালোই ঢুকেছে ।

নির্দিষ্ট দিনে, তিনতলার ঘরে ডক্টর গোপালন সমীরদা কে ভালো করে দেখলেন। তারপর, বহুবিধ জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। মন দিয়ে কাগজপত্র ও রিপোর্ট দেখলেন। তারপর একবার নাড়ী ধরে পাল্‌স্‌ গুনে , সিঁড়ি দিয়ে নীচে গিয়েই উপরে উঠে আসতে বললেন। সমী্রদা সেইমতো আবার উপরে উঠে আসলে , আবার পালস গুনে ওনার হাতে জলভর্তি এক লিটারের বোতল ধরিয়ে , চারতলায় উঠে আবার নেমে আসতে বললেন। সমীরদা নেমে এলে জিজ্ঞাসা করলেন, একবার-ও কি বুকে ব্যথা হলো ? সমীরদর সত্যই কোন ব্যথা হয় নি । ডক্টর গোপালন স্টেথো দিয়ে ভালো করে সব দেখে শুনে বললেন, 'আপনার কিছুই হয় নি । আমি আপনাকে মোট তিন রকম ওষুধ খেতে দিলাম। এগুলোতে মনের মধ্যেকার দুশ্চিন্তা কমে যাবে ,বুকে ব্যথাও হবে না । তিনমাস পরে আসবেন-তখন আমার সামনে একটা ট্রেড -মিল টেস্ট করিয়ে নেবো।'

সমীরদা চিন্তামুক্ত হলেও, আমি খুব নিশ্চিন্ত হতে পারছিলাম না । কিন্তু তারপর দুই মাস কেটে গেল. সমীরদা একবারের জন্যও বুক-ব্যথার কথা বলে না । আবার আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "দাদা, ব্যাপারটা কী, তাহলে ?" উনি বললেন, "আর্মির ডাক্তাররা তাদের প্রফেশনের প্রতি ডেডিকেটেড , ধান্দাবাজ নয়। তোর্ জন্য, আমি এ-যাত্রা ধনেপ্রাণে বেঁচে গেলাম। ভাবছি , তোকে একদিন আমি পেট পুরে খাওয়াবো ।"


ছবিঃপার্থ মুখার্জি

প্রদোষ প্রদীপ ভট্টাচার্য্য পেশায় চিকিৎসক । ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন; বর্তমানে স্থায়ীভাবে কলকাতায় কর্মরত। স্কুলজীবন থেকেই লেখার অভ্যাস, কলেজে দেয়াল-পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। ছোটদের জন্য লিখতেই বেশি পছন্দ করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা