সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

লোহাজঙ্গ গ্রাম

একপাশে একটা চায়ের দোকান, সামনে বিরাট একটা গাছ, তাতে একটা বড় ঘন্টা বাঁধা আছে। গাছটার একটু পাশে একটা ছোট পাথরের মন্দির। মন্দিরের ভিতরে একটা খুব সুন্দর মুর্তি। মন্দিরটার ঠিক পিছনে একটু উুচুতে একটা পাকা বাড়ি। এটাই লোহজঙ্গ টুরিষ্ট বাংলো। বাংলোকে বাঁপাশে রেখে একটু পথ ওপরে উঠলে, একটা সাদা রঙের মন্দির, আর তার একটু ওপরে অনেকটা জায়গা নিয়ে একটা মাঠের মতো। মাঠটার একদিকে কাঁটা তার দিয়ে ঘেরা। ঘেরা দিকটা খাদের দিক হলেও, তারের থেকে বেশ খানিকটা দুরে খাদ শুরু হয়েছে। কাজেই তারের বেড়াটা কে যে দিয়েছে, এবং কেনই বা দেওয়া হয়েছে বুঝলাম না। ঘন্টা বাঁধা গাছটার নীচে আমি, সিতাংশু ও গঙ্গা, কুলিদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। বাঁদিকে অনেকটা দুরে একটা লাল মতো জায়গা দেখিয়ে গঙ্গা বললো, ওটাই ওয়ান গ্রাম। এখান থেকে দেখে মনে হচ্ছে খানিকটা জায়গা যেন সুরকি দিয়ে ঢাকা। আমরা বললাম ওয়ান তো খুব একটা দুরে নয়, আজই ওখানে চলে যাব। পিছনের দোকান থেকেও একটা লোক আজ আমাদের ওয়ান চলে যাবার পরামর্শ দিল। গঙ্গা বলছিল আজ ওয়ান পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। কুলিদেরও অত মালপত্র নিয়ে ওখানে যেতে অসুবিধা হবে। কিন্তু দোকানের লোকটার কথায় গঙ্গা চুপ করে গেল। সে বললো কুলিরা আসুক, ওদের সাথে কথা বলে দেখা যাক্। সিতাংশু বললো ওয়ান খুব একটা দুরে বলে মনে হয় না। আমি বললাম এখান থেকে সোজা দেখতে পাচ্ছি বলে বোঝা যাচ্ছে না। রাস্তা হয়তো অনেক ঘুরে গেছে, সে ক্ষেত্রে ওখানে পৌঁছাতে অন্ধকার নেমে যেতে পারে। এর মধ্যে কুলি দু’টো এসে উপস্থিত হ’ল। গঙ্গা ওদের আজই ওয়ান যাবার কথা বললো। ওরা নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ আলোচনা করে জানালো, আজ এত মালপত্র নিয়ে ওয়ান যেতে রাত হয়ে যাবে। কাল সকালে আবার হাঁটা শুরু করাই ভাল। গঙ্গা বললো "এক কাজ করো। আজ আমরা এখানেই থেকে যাই, কাল সকালে আলি বুগিয়াল হয়ে চলে যাব"। কলকাতা থেকে আসার আগে নন্দদা, অর্থাৎ যার কাছ থেকে আমরা স্লীপিং ব্যাগ নিয়েছিলাম, বলেছিলেন বৈদিনী বুগিয়াল আর ওয়ান এর মধ্যে, রাস্তায় ভীষণ জোঁকের উৎপাত। ঐ রাস্তায় পায়ে বা শরীরের কোথাও জোঁক লাগলে, আমরা যেন শরীর থেকে জোঁক ছাড়াতে না যাই। কারণ জিজ্ঞাসা করাতে নন্দদা বলেছিলেন যতক্ষণে একটা জোঁক পা থেকে ছাড়াবে, ততক্ষণে পাঁচ দশটা জোঁক গায়ে আটকে যাবে। রক্ষাকবচ হিসাবে সঙ্গে নুন নিয়ে এসেছি। আলি বুগিয়াল দিয়ে অন্য পথে গেলে সেই জোঁক দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হব। তাছাড়া ওয়ান গ্রাম দেখা হবে না। গঙ্গাকে মনের কথা খুলে বললাম "গঙ্গা, বৈদিনীর পথে প্রচুর জোঁক আছে শুনেছিলাম, জোঁক দেখা হবে না? ওয়ান এর মতো একটা সুন্দর গ্রাম দেখা হবে না? আমার কথা শুনে গঙ্গা হেসে ফেলে বললো, "বাবুজী এ পথে লোক জোঁক থেকে বাঁচতে চায়, আর তোমরা জোঁক দেখতে চাইছো"। আমি ব্যাগ থেকে নুন বার করে দেখিয়ে বললাম "এই দেখ আমরাও বাঁচতে চাই"। ও বললো ঠিক আছে, ফিরবার পথে বৈদিনী বুগিয়াল হয়ে, ওয়ান হয়ে, ব্রহ্মতাল যাব। এবার আমাদের রূপকুন্ড ছাড়া ব্রহ্মতাল, বিগুন তাল, খপলু তাল ও পিন্ডারী গ্লেসিয়ার যাবার কথা।

গঙ্গারই জয় হ’ল। আমরা ভেবে দেখলাম আগামীকাল যদি আলি বুগিয়াল হয়ে যাওয়া হয়, তাহলেও আমরা সময় মতো যাচ্ছি। কারণ আমাদের রুটচার্ট অনুযায়ী আজ আমাদের বগরীগড় থাকার কথা। গঙ্গাকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, ফিরবার সময় ওয়ান হয়ে ফিরবে তো? গঙ্গা সম্মতি জানালো। ভাবলাম ভালই হ’ল। এখন ওয়ান যেতে গেলে সন্ধ্যার মুখে জোঁকের আক্রমনে পড়তে হতে পারে। তাছাড়া এই ফাঁকে আলি বুগিয়ালটাও দেখা হয়ে যাবে। কাজেই আজ লোহাজঙ্গেই রাত কাটাবো স্থির করে ফেললাম। আমরা পাঁচজন, টুরিষ্ট বাংলোয় গেলাম। কেয়ারটেকার একটা দরজা খুলে দিল। ভিতরটা ঘর বলে মনে হলেও, আসলে চারিদিক ঘেরা বারান্দা। তারের জাল লাগানো জানালা। গঙ্গা বললো "আমরা আজ রাতে এখানে থাকবো, বাবুদের ঠান্ডা লাগবে, ঘর খুলে দাও"। কেয়ারটেকার অনিচ্ছা সত্ত্বেও, বারান্দার বাঁপাশে প্রকান্ড ঘরটার দরজা খুলে দিল। লাইট নেই। মালপত্র নামিয়ে রেখে বাইরে এলাম। ওপরের মন্দিরটা দেখে, আমরা তারঘেরা মাঠটায় গেলাম। বেশ সুন্দর জায়গা। দুরে ঠিক যেন লাল মোরাম ঢাকা খানিকটা অঞ্চল। ওটাই ওয়ান গ্রাম। হরিশ ও কুমার এসে উপস্থিত হ’ল। গঙ্গা বাংলোতেই আছে। হরিশ এপথে আগেও অনেকবার এসেছে, তবে কুমারের এই প্রথমবার এপথে আসা। সে নেপালের লোক। এখন থাকে দার্জিলিংএ। ওখানে গাইডের কাজ করতো, কাজেই মাল বওয়ার অভ্যাস না থাকায়, ওর হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। ওর কিন্তু নতুন জায়গা দেখবার আগ্রহ খুব। সে হরিশকে আলি বুগিয়াল যাবার রাস্তা কোন দিক দিয়ে, ওয়ান যেতে গেলে কোন দিক দিয়ে যেতে হবে, ইত্যাদি নানা প্রশ্ন শুরু করলো। আরও কিছুক্ষণ মাঠটায় বসে, আমরা বাংলোয় ফিরে এলাম। হরিশ ও কুমার গেল গঙ্গার নির্দেশ মতো কাঠের সন্ধানে। আমাদের ঘরটার বারান্দাটার একদিকে রান্নাঘর। এখানে জলের খুব অভাব। বাংলোর সামনেই একটা বিরাট ট্যাঙ্ক করা আছে। কিন্তু তাতে জল নেই। কোন কালে ছিল কিনা কে জানে? কোন কারণে জল আনা হয়তো সম্ভব হচ্ছে না। বড় গাছটাকে বাঁ হাতে ফেলে, ওয়ান যাবার রাস্তা দিয়ে বেশ খানিকটা পথ গেলে, জল পাওয়া যাবে। পাথরের ওপর দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। একটা গাছের পাতার সাহায্যে, পাইপ দিয়ে জল পড়ার মতো ব্যবস্থা করা হয়েছে। ওখানেই বনে জঙ্গলে সবাই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যায়। আবার সমস্ত গ্রামটার রান্নার, খাবার, বা ঘরের কাজের জন্যও ঐ জায়গা থেকেই জল বয়ে আনা হয়। কাঠ এল। হরিশ ও কুমার তাদের খাবার জন্য চাল, ডাল, আটা কিনে নিয়ে এল। কথা ছিল বিকেল বেলা খিচুড়ি রান্না হবে। আর পরের দিনের রাস্তায় খাবার জন্য, রুটি ও তরকারী তৈরী করে রাখা হবে। সবকিছু উপকরণই আমাদের সঙ্গে আছে বা গোয়ালদাম থেকে কিনে আনা হয়েছে। কিন্তু ঐ তরকারীটা করতে যে তেল বা ঘি কিছু একটা লাগবে, এটা চিন্তাও করি নি, কিনে নিয়ে আসাও হয় নি। আর বীর সিং আমাদের রেশন কেনার সময় মনে করিয়েও দেন নি। ফলে গঙ্গা গেল তেলের খোঁজে। কিছুক্ষণ পরে গঙ্গা খালি হাতে ফিরে এল। এখানকার লোকেরা বোধহয় তেল, ঘি খায় না, কিছু পাওয়া যায় নি। অগত্যা পরের দিনের জন্য আলু সিদ্ধ করে রাখা হ’ল। এটা পরিষ্কার হয়ে গেল, সারা পথে আর তেল পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। অর্থাৎ রোজই আলু সিদ্ধ আর রুটি কপালে নাচছে। সত্যি রাজকীয় খাবার আয়োজন।

আমরা দু’জন কখনও ঘরে শুয়ে বসে গল্প করে, কখনও বাইরে এসে অন্ধকারের শোভা দেখে, সময় কাটাচ্ছি। বাংলোর সামনের দিকে একটু বাঁপাশে, বহুদুরে আলোক মালায় সজ্জিত, গোয়ালদামকে দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারে এখানে আকাশে তারার সংখ্যা যেন কয়েক গুন বেড়ে গেছে। মধ্যে মধ্যে গোয়ালদামের আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঘরে ফিরে এলে কুমার থালায় করে আমাদের দু’জনের রাজভোগ নিয়ে এল। রুটি, আর তেল ঘি হীন এক সুস্বাদু তরকারী। আমাদের কাছে চার প্যাকেট মাখন আছে। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা ভেবে বার করা হ’ল না। আমাদের খাওয়া হয়ে গেলে, ওরাও খেয়ে নিল। এরপর গঙ্গা আমাদের আধ মগ করে ভারী সুন্দর কফি খাওয়ালো। বাংলোর কেয়ারটেকারও দেখি আমাদের কফি ক্লাবের সদস্য হয়ে গেছে। আর খালি পেটে যেহেতু কফি খাওয়া ক্ষতিকর, তাই কফির আগে রুটি তরকারী দিয়ে শরীরটাকে কফি সেবনের উপযোগীও করে নিল। অথচ ওই আমাদের ফাঁকা ঘরটা দিতে চাইছিল না। পরের দিনের জন্য মালপত্র গুছিয়ে ভাল করে বেঁধে নিলাম। সঙ্গে আনা মোমবাতি, জিনসপত্রের চাপে টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে গেছে। এখানে বা এরপরে আর কোথাও মোমবাতি পাওয়ার আশা নেই, তাই আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। ওরা তিনজন বারান্দায় শুয়ে গলা ছেড়ে গান ধরলো। গান শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা।


ছবিঃত্রিপর্ণা মাইতি
ফটোগ্রাফঃ ট্রেকআর্থ

ছোটবেলা থেকে মাঠে, ঘাটে, জলাজঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ফড়িং, প্রজাপতি, মাছ, পশুপাখি, গাছের সাথে সখ্যতা। একটু বড় হয়ে স্কুল, এবং তারপরে কলেজ পালানোর নেশায় এর ব্যাপ্তি আরও বৃদ্ধি পাওয়ায়, অনেক নতুন ও অদ্ভুত সব মানুষের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ ঘটে। পরবর্তীকালে ছত্রিশ বছরের কর্মজীবনে ও ভ্রমণের নেশায় আরও বিচিত্র চরিত্রের মানুষ, বিচিত্র সংস্কার, বিচিত্র জায়গা দেখার ও বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ ঘটে। সুবীর কুমার রায় কর্ম সুত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক অফিসার ছিলেন। নেশা ভ্রমণ ও লেখা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা