সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
roopkunder-haatchhani

বড় ঘরটা বেডরুম। ঘরটায় তিনটে দরজা। বাঁপাশেরটা পরিত্যক্ত ঘরটায় যাবার জন্য। ডানপাশেরটা রান্নাঘরে যাবার। তৃতীয়টা বারান্দায় যাবার জন্য। একবারে বাঁদিকের দেওয়াল ঘেঁসে পর পর চারটে তক্তাপোশ। এত সুন্দর এদের গঠন, যে চারটে তক্তাপোশ পর পর রাখায়, দু'দিকের দেওয়ালের পাশে একচুল জায়গাও নেই। যেন ঘরের মাপ নিয়ে সমান মাপের চারটে তক্তাপোশ তৈরী করা হয়েছে। প্রথম তক্তাপোশটার বাঁদিকের দেওয়ালের ধারের দুটো পা-ই নেই। অর্থাৎ ডানদিকের দুটো পায়ের ওপর, ডানদিকের তিনটে তক্তাপোশের ধাক্কায় বা চাপে, বাঁদিকের দেওয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরেরটা অক্ষত, তবে ওটার ওপর শুয়ে নড়াচড়া করলে টলমল্ করে। যেন দু'দিকে দুটো তক্তাপোশ আছে বলে, ইচ্ছা থাকলেও জায়গার অভাবে ভেঙ্গে পড়তে পারছেনা। তার পাশেরটা বেশ শক্ত সমর্থ। কিন্তু ফ্রেমের অর্ধেকটায় কোন তক্তা নেই। আর একবারে ডান দিকেরটার যথারীতি বাঁ পা দুটোই বেঁচে আছে। ডান পা দুটো কোন কারণে কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। তবে অসুবিধা নেই। ডান পা দুটো না থাক্, ডানদিকে দেওয়াল ও বাঁদিকে তিন জাত ভাইতো এখনও বেঁচে আছে। তাদের জোরে এটা ভালভাবে বাঁ দিকেরটার মতোই দাঁড়িয়ে আছে। ব্যবস্থার কোন ত্রুটি নেই। এত সুন্দর একটা রাজপ্রাসাদ কিন্তু বিশাল মাঠের মাঝে একা দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে যতদুর দৃষ্টি যায়, শুধু মাঠ আর মাঠ। অসম্ভব গতিতে হাওয়া বইছে। গোটা অঞ্চলটায় এই প্রাসাদটাই একমাত্র হাওয়ার গতিপথ রোধ করে, বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফলে ঘরের ভিতর তীব্র ঝড়ের মতো হাওয়ার আওয়াজে মনে হচ্ছে, যেকোন সময় বাড়িটাকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়ে যাবে। কোন কেয়ার টেকারের ব্যবস্থা নেই। থাকলেও তার দেখা পেলাম না। ইলেকট্রিসিটি থাকার তো কোন প্রশ্নই ওঠে না। কয়েক বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে লোকজন থাকার সম্ভাবনাও নেই। শুধু আমরা পাঁচজন।

আমরা চারজন গেষ্ট হাউসের বেডরুমে এলাম। হাঁটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঠান্ডাটা যেন বেশী লাগছে। মালপত্র তক্তাপোশের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে, আমরা রান্নাঘরে এলাম। হরিশ ব্যাগ থেকে হাঁড়ি বার করে জল আনতে গেল। সিতাংশু জানালো ওর হাতে কোন জোর নেই, কোন সাড় নেই। ও ভয় পাচ্ছে, রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে হাতদু'টো না নষ্ট হয়ে যায়। আমরা রান্নাঘরের টুকরো কাঠগুলোয় আগুন জ্বালাবার চেষ্টা করতে শুরু করলাম। যতবার পাইন জাতীয় শুকনো পাতাগুলোয় দেশলাই জ্বেলে আগুন লাগাই, চোখের পলক পড়ার আগেই, খুব দ্রুত খানিকটা জ্বলেই নিভে যাচ্ছে। অথচ প্রথমে এগুলোয় একটু আগুন ধরে না রাখতে পারলে, কাঠে আগুন লাগার কোন সম্ভাবনা নেই। সরু সরু পাতাগুলো চটপট্ আওয়াজ করে খুব দ্রুত খানিকটা পুড়েই নিভে যাচ্ছে। এদিকে বাইরে আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমে আসছে। গঙ্গা এখনও ফেরে নি। হরিশ কত দুরে জল আনতে গেছে কে জানে। আমার সাথে সিতাংশুও আগুন জ্বালাতে আপ্রাণ চেষ্টা করলো। এ কাজটায় ওর উৎসাহে কোন খামতি নেই, প্রয়োজনটা ওরই। অথচ শুধু দেশলাই কাঠি নষ্ট করা ছাড়া, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। সিতাংশু বললো দেশলাই কাঠি নষ্ট না করে মোমবাতি বার করো। ব্যাগ থেকে মোমবাতি বার করে দেখি, তিনটে বড় মোমবাতির একটা একবারে গুঁড়ো হয়ে গেছে। আর দুটো ছোট ছোট টুকরো হয়ে, সুতোয় আটকে আছে। আমি একটা ছোট টুকরো জ্বাললাম। ঘরে একটু আলো হ'ল বটে, আগুন কিন্তু জ্বালানো গেল না। মোমবাতির টুকরোটা এতই ছোট যে, শেষ হয়ে দপদপ্ করে নিভে গেল। সিতাংশু বললো আর একটা টুকরো জ্বালাতে। আমি রাজী হ'লাম না। বললাম কাল কী হবে? ও বললো কালকের কথা কালকে ভাবা যাবে। আমি বললাম "না, এখন থেকে কালকের কথা আজই ভাবতে হবে। কাল আমরা আরও উচু, আরও কষ্টকর, আরও ভয়ঙ্কর জায়গায় রাত কাটাবো। প্রায় দশ পনের মিনিট সময় কেটে গেল, কিন্তু এখন পর্যন্ত আমরা বেশ কিছু দেশলাই কাঠি পোড়ানো ছাড়া, কাজের কাজ কিছুই করতে পারিনি। কুমার বুদ্ধি দিল স্টোভ জ্বালতে। বুদ্ধিটা মনে ধরলো, কেন এতক্ষণ মাথায় আসেনি জানিনা। স্টোভে তেল ভরা হ'ল। জনতা স্টোভ। স্টোভের একবারে ভিতরে, সলতের ঠিক আগে, সব থেকে ছোট যে টিনের কভারটা থাকে, সেটা মালপত্রের চাপে কিভাবে বেঁকে গেছে। সিতাংশু ও আমি অনেক চেষ্টার পরে, মোটামুটি একটা অবস্থায় ওটাকে নিয়ে আসতে সক্ষম হলাম। ছোট কভারটার খোলা দিকটা, বেঁকে মাথার ক্লীপের মতো হয়ে গেছে। সিতাংশুর নখে যথেষ্ট জোর আছে, তবে এখন ও শুধু চেষ্টাই করলো, উপকার কিছু করতে পারলো না। কুমার স্টোভে তেল ভরে স্টোভ জ্বাললো। কিন্তু স্টোভের ভিতরের কভারটা বেঁকে যাবার জন্য, না অক্সিজেন এর অভাব জানিনা, স্টোভ একবার দপ্ করে জ্বলে, তারপরেই নিভে যাবার মতো হয়। ঐ অবস্থায় কিছুক্ষণ থেকে, নিজে নিজেই আবার দপ্ করে জ্বলে ওঠে। অর্থাৎ স্টোভ কোন কাজে আসবে না। এ জায়গাটা বুগিয়াল, অর্থাৎ তৃণভুমি। সমুদ্রতল থেকে উচ্চতাও এগার হাজার ফুট। যতদুর দৃষ্টি যায়, একটা ছোট গাছও কোথাও নেই দেখে এসেছি। রান্নাঘরে দু'তিনটে সরু সরু কাঠের টুকরো, মানে কাঠও নেই। অর্থাৎ আজ রাতে হরিমটর চিবতে হবে। সঙ্গে যা শুকনো খাবার আছে, তা যদি আজ খাই, কাল কী হবে? আবার নতুন করে চেষ্টা শুরু হ'ল। এবার কুমার, পাইন পাতা ও কাঠের টুকরোগুলোর উপর খানিকটা কেরসিন তেল ঢেলে আগুন দিল। দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। একটু পরে আগুন নিভে গেলে দেখা গেল, শুধু তেলটুকু আর পাতাগুলোই পুড়েছে। কাঠগুলো অক্ষত শরীরে ড্যাবড্যাব্ করে আমাদের দিকে চেয়ে যেন ব্যাঙ্গ বিদ্রুপ করছে। বিরক্তি প্রকাশ করছে, তাদের চন্দন বর্ণের গায়ের রঙ শ্যামবর্ণে পরিণত করায়। আবার তেল ঢালা হ'ল। এবারও শুধু তেল ও পাতাই পুড়লো। লাভের মধ্যে শুধু ঐ সাময়িক সময়ের জন্য হাতগুলো আগুনের ওপর মেলে রাখা গেল।

roopkunder-haatchhani

এর মধ্যে হরিশ ফিরে এল। এল এক নতুন সুসংবাদ নিয়ে—"বাবুজী হাঁড়ি ফুটো। সব জল পড়ে যাচ্ছে"। ও জানালো, কাছাকাছি কোথাও জল নেই। প্রায় এক কিলোমিটার দুর থেকে ও জল বয়ে নিয়ে আসছে। হাঁড়ির তলায় ফুটোর ওপর আঙ্গুল চেপে ধরে, ও অনেক কষ্টে জল নিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন ঐ জল ধরে রাখবো কোথায়, কী ভাবে? আগুন জ্বালার প্রচেষ্টা ছেড়ে জল নিয়ে পড়লাম। জল ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে বড় ঘরে গেলাম। দেখি তিনটে বেশ বড় বড় ফুটো, হাঁড়ির তলায় প্রায় একই অক্ষরেখায় অবস্থান করছেন। ঠিক করলাম ফুটোগুলোর ওপর, হাঁড়ির তলায় লিউকোপ্লাষ্টার লাগিয়ে দেব। অন্ধকারে ওটাকে খুঁজেপেতে বারও করলাম। কিন্তু ওটাকে কাটবো কী দিয়ে? সিতাংশু রান্নাঘরে বসে আছে ওর "কুবেরের ধন", হাত আগলে। ওকে ডাকতে ও জানালো, ও এখন কিছু করতে পারবে না। ও এখন সাময়িক হাত স্যাঁকা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। দাঁত দিয়ে খানিকটা প্লাষ্টার ছিঁড়ে, হাঁড়ির তলায় ও হাঁড়ির জলের ভিতর হাত ডুবিয়ে, ফুটোগুলোর ওপর ভাল করে সেঁটে দিলাম। হাত সরাতেই ফুটোর জলের চাপ, হাঁড়ির পিছনের প্লাষ্টারটাকে মাটিতে ফেলে দিল। ওঃ, কী বিপদ। আগুন যদিও বা জ্বালা যায়, রান্না হবে কী দিয়ে? জলও নেই, হাঁড়িও নেই। অথচ সিতাংশুর কোন চিন্তা নেই দেখে এত রাগ হচ্ছে বোঝাতে পারবো না। ওর ওপর আরও রাগ হচ্ছে কারণ হাঁড়িটা ওর বুদ্ধিতেই ও ওর দাদার কাছ থেকে নিয়ে এসেছে। আমি বার বার বারণ করেছিলাম। বলেছিলাম, এত কিছু মালপত্র যদি কলকাতা থেকে বয়ে নিয়ে যেতে পারি, একটা প্রেসার কুকার বা ডেকচিও বয়ে নিয়ে যেতে পারবো। কিন্তু লক্ষ্ণৌ-এ ও তার দাদার বাড়ি যাবেই, আর তখন ও পাত্রটা নিয়ে আসবে, এরকমই তার ইচ্ছা ছিল। আজ রাতে শুকনো খাবার খাওয়া মানে, আগামীকাল সারাদিন সারারাত এবং ফেরার পথে রাস্তায় অনাহারে কাটাতে হবে, এই সহজ কথাটা কী ও বুঝছে না। হাতে না হয় সাড় নেই, মাথায় কী হয়েছে? ও সেই একই ভাবে হাত সেঁকে যাচ্ছে। এবার আমি খুব বিরক্তির সঙ্গে ওকে ডাকলাম। ও খুব রেগে গিয়ে আমায় বললো, "তুমি কী আমায় বিশ্বাস করতে পারছো না যে, আমার হাতদুটো একদম কাজ করছে না"? সেই মুহুর্তে এই যুক্তি মেনে নিতে পারলাম না। কাজ করতে না পারুক, অবস্থার গুরুত্ব ও ভয়াবহতার ব্যাপারে ওর কোন চিন্তা নেই দেখে এত রাগ হ'ল যে ওকে বললাম "ওরকম হাত নিয়ে আস কেন"? শারীরিক কোন সাহায্য করতে না পারুক, জলটা ধরে রাখার একটা উপায়ও তো সে চিন্তা করতে পারে। কাছাকাছি কোথাও জলও নেই যে বলবো আবার জল নিয়ে এস। অথচ ওর কাছে এই বিপদেও হাত গরম করাটা বড় হ'ল? এই অবসরে ও গায়ে একটা ফুলহাতা সোয়েটারও চাপিয়ে নিয়েছে। একবার মনে হ'ল আমিও রান্নাঘরে গিয়ে বসে থাকি, যা হয় হোক। পরের মুহুর্তেই মনে হ'ল, তাতে শুধু টুরটাই বানচাল হবে। বাড়ি ফিরে বলতে হবে খাবারের অভাবে আমরা রূপকুন্ড যেতে পারি নি। কাজেই নতুন উদ্যোগে চেষ্টা শুরু করলাম। হরিশকে বললাম একটু মাটি নিয়ে আসতে। ও মাটি নিয়ে আসলো। এখানকার মাটিতে খুব কাঁকড়। হাঁড়ির তলায় মোটা করে মাটি লাগিয়েও, জল পড়া বন্ধ করতে পারলাম না। সঙ্গে সাবান আছে। মনে হ'ল সাবানে কাজ হতে পারে। কিন্তু সেটা কোথায় আছে কে জানে। ঘরে আলো নেই, সঙ্গীও সাহায্য করবে না, তার ওপর বার বার হাঁড়ির তলা থেকে আঙ্গুল সরানোর জন্য অর্ধেক জল ইতিমধ্যেই পড়ে গেছে। তাই চটপট্ দুটো পলিথিন ব্যাগে জল ভরে ফেললাম। কিন্তু তারপর? শক্ত কোন পাত্র হলে না হয়, দেওয়ালে ঠেস্ দিয়ে রেখে দিতাম। কিন্তু পলিথিন ব্যাগে তো আর ঐ ভাবে জল রাখা সম্ভব নয়। অনেকক্ষণ হরিশ একটা আর আমি একটা ব্যাগ হাতে করে দাঁড়িয়ে থেকে, শেষে বিরক্ত হয়ে আবার হাঁড়িতে রেখে, রান্নাঘরে চলে এলাম। মাঝ থেকে বেডরুমের মেঝে পুরো জলে ভিজে গেল। এখনও কিন্তু আগুন জ্বালা সম্ভব হয় নি, শুধু তেলই পুড়েছে। সিতাংশু তার শারীরিক অবস্থার কথা বোঝাবার চেষ্টা করলো। আমার তখন ওর কথা শুনবার, বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। সিতাংশু ফুলহাতা মোটা সোয়েটার অনেকক্ষণ পরে নিয়েছে। আমি এখনও সেই হাফহাতা পাতলা জামা পরেই আছি। এখানে ঠান্ডা বেশ ভাল রকম। কিন্তু অন্ধকারে ব্যাগ থেকে খুঁজে গরম জামা বের করে আনার মতো মানসিক অবস্থা তখন আমার আর নেই। ভীষণ একটা অশান্তি ভোগ করছি। তবে কী সামান্য একটা হাঁড়ির জন্য আমাদের পিছু হটে যেতে হবে? শুধু হাঁড়িই বা কেন? কাল সকালে কোন ভাবে হাঁড়ির ফুটো বন্ধ করতে পারলেও, রান্না হবে কী ভাবে? স্টোভও যে কাজ করছে না। এখানেই কাঠ পাওয়া যায় না, "বগুয়াবাসা"য় কাঠ পাওয়ার আশা? না, আর ভাবতে পারছি না। সিতাংশু বারবার আমাকে সোয়েটার পরে নিতে বলছে। কিন্তু ঠান্ডা লাগার ভয়ের চেয়েও ফিরে যাবার ভয়, তখন আমাকে চারিদিক থেকে গ্রাস করে ফেলেছে। সিতাংশু আবার তার কষ্টের কথা আমায় জানালো। ব্যাগ থেকে পানীয়ের বোতল বার করে ওকে খানিকটা খেতে বললাম। বাইরে তখন ভীষণ ঠান্ডা। স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া, তার সাথে কনকনে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। ও আর কথা না বাড়িয়ে ছিপি খুলে খানিকটা গলায় ঢেলে দিল। এবার শুরু হ'ল তার কাশি। ভয় হ'ল, হার্টফেল করবে না তো? একটু অপেক্ষা করে ঘরে ফিরে এলাম। এমন সময় গঙ্গা ফিরে এল। ঘি পাওয়া যায় নি। সিতাংশুর ওপর রাগটা গঙ্গার ওপর বর্ষণ করলাম। ও শান্তভাবে বললো "বাবুজী কী হয়েছে"? একে একে সমস্ত অবস্থাটা খুলে বলে, শেষে বললাম "গঙ্গা আমরা যে না খেয়ে, ঠান্ডায় মরে যাব। স্টোভ জ্বলছে না, হাঁড়ি ফুটো, মোমবাতি নেই, তবে কী আমাদের ফিরে যেতে হবে"?

এখন পর্যন্ত গঙ্গা সম্বন্ধে নিয়ে আসা খারাপ ধারণাটা, ওর আর আমাদের মধ্যে একটা্ ব্যবধান সৃষ্টি করে রেখেছিল। গঙ্গা মাতাল, গঙ্গা সুযোগ বুঝে যাত্রীদের কাছ থেকে চাপ দিয়ে টাকা আদায় করে, গঙ্গা চরিত্রহীন, গঙ্গার ব্যবহার খুব খারাপ, এইসব ধারণার বশে রাস্তায়, প্রথম থেকে সিতাংশু ও আমার ধারণা হয়েছিল, গঙ্গা সত্যিই একটা ঘুঘু লোক। ওর কাছ থেকে সব সময়েই খারাপ ব্যবহার পাওয়ার জন্য, ওর চাপে বাধ্য হয়ে বেশী টাকা দেবার জন্য, আমরা যেন প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। রাস্তায় ঐ দোকানদার আবার এই সব বিশেষণগুলো নতুন করে শুনিয়ে, দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাছাড়া এতটা পথে তাকে এমন কিছু করতেও দেখিনি, যার জন্য ধারণাটা পাল্টাতে পারে। কথাগুলো গঙ্গাকে বলে খারাপ লাগছিল, কারণ হাঁড়ি ফুটো হওয়া, স্টোভ খারাপ হওয়া, মোমবাতি গুঁড়ো হয়ে যাওয়া, কোনটার জন্যই কিন্তু গঙ্গা দায়ী নয়।

কিন্তু এ কী? "খারাপ লোক" গঙ্গা যে মুক্তিদূতের মতো ঘোষণা করলো —"বাবুজী, আমি যদি জিন্দা থাকি, তোমরাও জিন্দা থাকবে, ডরো মাৎ"। ও আবার অন্ধকারে ঐ ঠান্ডায় সম্ভবত ত্রাণসামগ্রী যোগাড়ে, আমাদের প্রাণ রক্ষার চেষ্টায় বেড়িয়ে গেল। আরও অনেকক্ষণ কাটলো আশায় আশায়। আরও তেল পুড়লো, আরও দেশলাই কাঠি ধ্বংস হ'ল, পুড়ে শেষ হ'ল রান্নাঘরের অবশিষ্ট পাইন পাতা। অপেক্ষা করে করে যখন ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছেছি, ঠিক তখনই চোখের সামনে এক দেবদূতকে দেখলাম। তিনি যেন স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন আমাদের এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে, রূপকুন্ড পেড়িয়ে দেবস্থান হোমকুন্ডে আমাদের পৌঁছে দিতে। পরশুরামের মতো এক হাতে তাঁর কুঠার, অপর হাতে ভুসোকালি মাখা একটা ডেকচি। সত্যিই সেই মুহুর্তে গঙ্গাকে দেবদূত বলে মনে হয়েছে।

roopkunder-haatchhani

কয়েক মাসের জন্য যারা এত উচ্চতায় গরু মোষ চড়াতে আসে, তাদের কাছ থেকে দু'দিনের জন্য পাঁচ টাকা ভাড়ায়, গঙ্গা ডেকচিটা নিয়ে এসেছে। কথা হয়েছে পরশু রূপকুন্ড দেখে ফেরার পথে, ডেকচিটা ফেরৎ দেওয়া হবে। ডেকচিটার যা আকার, তাতে আমাদের পাঁচজনের খিচুড়ি হওয়া মুশকিল। তা হোক্, তবু চলে যাবে। আর ভাড়া? পাঁচ টাকা কেন পঞ্চাশ টাকা বললেও, আমি অন্তত আপত্তি করবো না, একথা শপথ করে বলতে পারি। গঙ্গাকে জিজ্ঞাসা করলাম কুড়ুল কী কাজে লাগবে? গঙ্গা বললো কাঠ কাটতে হবে। কোথায় কাঠ? এই বিস্তীর্ণ বুগিয়ালে ও কাঠের সন্ধান কোথায় পেল? গঙ্গা জানলো রেষ্ট হাউসের পাশে এই ঘর মেরামতের জন্য গভর্ণমেন্ট কিছু স্লীপার এনে রেখেছে। তারই একটা সে কেটে ফেলবে। ওগুলো ঘরে ঢুকবার সময়েই দেখেছি। ওগুলো কেটে ব্যবহার করার কথা ভাবিও নি। আবার এক নতুন বিপদের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। আমি বললাম গভর্ণমেন্টের রেখে যাওয়া স্লীপার কাটলে কোন রকম ঝামেলা হবে না তো? ও জানালো এখানে দেখবার কেউ নেই। তাছাড়া আগে মানুষের প্রাণ, পরে গভর্ণমেন্ট। গঙ্গা এবার কুমারকে নিয়ে বাড়িটার ডানপাশে রাখা হাল্কা কাঠের কয়েকটা স্লীপারের একটাকে, কুড়ুল দিয়ে কাটতে শুরু করলো। গঙ্গার হাতের কাজও খুব সুন্দর। ওকে একজন দক্ষ শিল্পী বলা উচিৎ। অতি অল্প সময়ের মধ্যে ও কাঠ কাটা শেষ করে ফেললো। কাঠ কাটারও কিছু রীতি আছে দেখলাম। কিছু কাঠ মোটা মোটা করে কাটা হয়েছে, কিছু খুব সরু সরু, আবার কিছু কাঠ দারুচিনির মতো পাতলা করে কেটে, কুড়ুলের ভোঁতা দিক দিয়ে পিটিয়ে থেঁতো মতো করা হ'ল। এ সবই শুধু তাড়াতাড়ি ও সহজে আগুন জ্বালাবার জন্য। আর সত্যি হ'লও তাই। বোধহয় দুই কী তিন মিনিটের মধ্যে, গঙ্গা কাটা কাঠে আগুন জ্বেলে ফেললো। সামান্য কেরসিন তেল ঢেলে আগুন লাগিয়ে, মুখ দিয়ে যতটা সম্ভব হাওয়া টেনে খুব জোরে ফুঁ দিয়ে, অনায়াসে সে আগুন জ্বেলে ফেললো। আমি একটা শান্তির নিশ্বাস ফেলে বেডরুম থেকে সোয়েটার বার করে আনলাম। এবার আগুন ঘিরে আমরা পাঁচজন গোল হয়ে বসলাম। মনে হচ্ছে গঙ্গাকে একটা প্রণাম করি। গঙ্গা হাঁড়ির ভিতর পলিথিন ব্যাগে যতটা জল ছিল, ডেকচিতে ঢেলে কফি তৈরীর আয়োজন করলো। হরিশ বা কুমার এতক্ষণ সময়ে যা করতে পারেনি, গঙ্গা কত অল্প সময়ে তা করে দিল।

গঙ্গার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা, আস্থা, অনেক বেশী বেড়ে গেল। বই-এ পড়া বীর সিং এর কথা মনে হ'ল। মনে হ'ল বীর সিং এর রক্ত যার শরীরে বইছে, সে কখনও খারাপ হতে পারে না। ওকে আমরা চিনতে পারিনি, অকারণে ভুল বুঝেছিলাম। গঙ্গাকে বললাম কলকাতায় তার সম্বন্ধে কতো খারাপ কথা শুনেছিলাম। গঙ্গা মাতাল, গঙ্গা জুয়া খেলে, গঙ্গা লোককে ঠকিয়ে চাপ দিয়ে টাকা আদায় করে। এখন বুঝতে পারছি কতো ভুল ধারণা, তার সম্বন্ধে নিয়ে এখানে এসেছিলাম। এখন, এই মুহুর্তে তাকে নতুন করে চিনছি। আজকের রাতটা যদি বেঁচে থাকি, তবে সে শুধু গঙ্গার জন্যই।

গঙ্গা সব শুনে বললো "ওসব কথা ছেড়ে দাও বাবুজী, আমি কারো সাথে কখনও খারাপ ব্যবহার করিনি। জানিনা কেন আমার নামে এত বদনাম রটেছে। সবই আমার ভাগ্য"। ওর কথাগুলো শুনে সত্যি এখন ওর কথা ভেবে খুব খারাপ লাগছিল।

যাহোক্, কফি তৈরী হয়ে গেল। গঙ্গা আমাদের দু'জনকে দু'টো মগে কফি দিল। এই এক সমস্যা। পাঁচজন লোক, আর দু'টো মাত্র মগ্। অবশ্য একটা বাটিও আছে। মোট তিনটে কফি খাবার পাত্র। আমি গঙ্গাকে বললাম তোমরা তিনজন আগে খাও, তারপর আমাদের দু'জনকে দেবে। শুধু যে ওদের খুশী করবার জন্যই ওকে বা কুলিদের আগে কফি খেতে বললাম, তা কিন্তু নয়। সেই মুহুর্তে এটার খুব প্রয়োজনও ছিল। এবার সিতাংশুও আমার মতোই ওদের, আগে খাবার জন্য বললো। গঙ্গা কিন্তু রাজী হ'ল না। ও বললো "তা হয়না। তোমাদের জন্যই কফি তৈরী করা, তোমরা না খেলে আমরা খেতে পারিনা"। হরিশ ও কুমার ওর সাথে সুর ধরলো। আমি বললাম, গঙ্গা দু'বার ঠান্ডার মধ্যে বাইরে গেছে। হরিশকেও আবার জল আনতে যেতে হবে, কাজেই তোমাদের আগে শরীর গরম করার প্রয়োজন। আমরা একটু পরে খেলেও, কোন ক্ষতি হবে না। ওরা আরও কিছুক্ষণ না না বলে, শেষে আমাদের কথায় কফি খেতে শুরু করলো। ওরাও আমাদের ব্যবহারে খুব খুশী, আমরাও তাই। গঙ্গাকে বললাম আজ না হয় একটা ব্যবস্থা হ'ল, কাল কী হবে? আগামী কাল তো আমরা ১৪৬৫৫ ফুট উচ্চতার বগুয়াবাসার গুহায় থাকবো। ওখানে তো কিছুই পাওয়া যাবে না। গঙ্গা জানালো স্টোভ কোন কাজে আসবে না, কাজেই এখান থেকে কাঠ বয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাই একটা লোকের ব্যবস্থা করতে হবে। আমি রাজী হলাম, রাজী না হয়ে উপায়ও নেই। গঙ্গা বললো কাল সকালে সে একটা লোক যোগাড় করে নেবে। ইতিমধ্যে আমাদেরও কফি খাওয়া শেষ। হরিশ ও কুমার গেল অন্ধকারে, ঠান্ডার মধ্যে আবার জল আনতে। গঙ্গা আগামীকালের জন্য কাঠ কাটতে বসলো। আমরা আগুনের ধারে বসে নিজেদের শরীর খানিকটা গরম করে নিলাম। গঙ্গা জানালো এই বাংলো মেরামতের জন্য গভর্ণমেন্ট টেন্ডার ডাকে। যে সব থেকে কম দর দিয়েছে, তাকে অর্ডার দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, আশ্চর্য হলাম পরের কথাটা শুনে। সে জানালো, যে অর্ডার পেয়েছে, সে এক'শ টাকা দর দিয়েছে। কাঠ এসে গেছে, এবার কাজ শুরু হবে। এক'শ টাকার গল্পটা সত্যি কিনা জানিনা। তবে তাই যদি হয়, তবে এই টাকায় কী মেরামতির কাজ হবে, তা বোধহয় ভগবানও জানেন না। ঐ টেন্ডার প্রাপক ও গভর্ণমেন্ট হয়তো বলতে পারবে। এই এক'শ টাকার মধ্যে কাঠের দামও আছে কিনা জানিনা। ক'টা স্লীপার এসেছিল কে জানে। আমরা তো একটা কেটে ফেললাম। হয়তো আগেও আমাদের মতো কোন দল প্রাণ বাঁচাতে স্লীপার কেটেছে। সিতাংশু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললো, আজকের রাতের কথা সে জীবনে ভুলবে না। ভুলবো না আমিও। এই অভিজ্ঞতা কী ভোলা যায়? গঙ্গাও বললো ইয়ে রাত ইয়াদ রহেগা। গঙ্গাকে বললাম তোমার কথাও ভুলবো না। গঙ্গা বললো সকলেই এই কথা বলে, কিন্তু বাড়ি ফিরে সব ভুলে যায়। সে এক ডাক্তারের কথা বললো। সকলকে ওষুধ দিয়ে সুস্থ রেখে, শেষে ডাক্তার নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ে। গঙ্গার সেবা যত্নে সে সুস্থ হয়ে ওঠে। সেও গঙ্গাকে বলেছিল যে সে গঙ্গাকে সারা জীবন মনে রাখবে, গঙ্গাকে চিঠি দেবে। গঙ্গার জন্যই সে এ যাত্রা প্রাণে বেঁচে গেল। অথচ আজও গঙ্গা তার কোন চিঠি পায় নি। আমি বললাম আমি চিঠি দেব, ছবি পাঠাবো। হরিশ ও কুমার জল নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো তাদের ছবিও পাঠাতে। বললাম গঙ্গার ঠিকানায় তাদের ছবিও অবশ্যই পাঠাবো।

আগুন জ্বালা হয়েছে, জল আনা হয়েছে, প্রয়োজনীয় কাঠ কাটাও হয়েছে। অতএব রাতের খাবার তৈরী করা যেতেই পারে। গঙ্গা ভাড়া করে আনা ডেকচিতে খিচুড়ি চাপালো। আমরা সবাই গোল হয়ে বসে গল্পগুজব করছি। ঘরটাতে অসম্ভব ধোঁয়া হয়ে যাওয়ায় চোখ খুলতে পারছি না। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। মাঝে মাঝে ডানদিকের দরজাটা খুলে দেওয়া হচ্ছে। দমকা ঠান্ডা হাওয়ায় কিছুটা ধোঁয়া বার হয়ে যাচ্ছে। মোমবাতির খুব অভাব, তাই আলো জ্বালানো হয় নি। ওপরের জানালাটা খোলার প্রয়োজন হবে আগে জানলে, কলকাতা থেকে যাবার আগে ভাল ভাল পুষ্টিকর খাবার খেয়ে, ডন বৈঠক দিয়ে, শরীরটাকে তৈরী করে নিয়ে যেতাম। বেডরুমের মেঝে, ফুটো হাঁড়ির কৃপায় জলকাদায় থৈথৈ করছে। নানারকম অভিজ্ঞতার কথা আলোচনা হচ্ছে। গঙ্গা একাই এক'শ। ঐটুকু ডেকচিতে যতটা সম্ভব বেশী খিচুড়ি তৈরী করতে গিয়ে সে হিমশিম খাচ্ছে। বিড়ি, সিগারেট খুব দ্রুত শেষ হচ্ছে। এর মধ্যেও সিতাংশুর হাত স্যাঁকা অব্যাহত আছে। যাহোক্‌ অবশেষে খাবার তৈরী শেষ হ'ল। ব্যাগ থেকে মাখন বার করে দিলাম। গঙ্গা আমাদের দু'জনকে খেতে দিয়ে দিল। হরিশের শরীর খারাপ লাগছে বলে অনেকক্ষণ আগেই বেডরুমের একবারে ডানদিকের "পালঙ্কে" গা এলিয়ে দিয়েছে। শুধু খাওয়ার জন্য এতক্ষণ যুদ্ধ করে, তার আর খাওয়ার ইচ্ছা বা ক্ষমতা, কোনটাই নেই। গঙ্গাকে খিচুড়ি কমিয়ে দিতে বললাম। ও ভাবলো কম পরবে ভেবে আমরা খাচ্ছি না। ওকে বললাম আমার খিদে পায় নি। ও একটু কমিয়ে দিল। পরে আবার আমায় ও সিতাংশুকে বড় চামচের এক চামচ করে খিচুড়ি দিয়ে হেসে বললো, এটা আমার অনারে নিন। নিতে হ'ল, খাওয়াও শেষ হ'ল। উঠে গিয়ে এবার হরিশকে ডাকলাম। ও জানালো ওর শরীর খারাপ লাগছে, আজ রাতে সে কিছু খাবে না। ওদের কারো শরীর খারাপ হলে, আমাদের যাওয়া বন্ধ হতে পারে ভেবে, ওকে জোর করে তুলে ওষুধ দিলাম। গঙ্গাকে বললাম ওকে খাবার দিতে। গঙ্গা ও কুমার খাবার খেয়ে নিল। গঙ্গা জানালো, সে ও কুমার রান্নাঘরে শোবে। আমি বললাম ওখানে ভীষণ ধোঁয়া, তাছাড়া ঐটুকু ঘর, তার আবার অর্ধেকটায় ছাই, কাঠ আর আগুনে ভর্তি। গঙ্গা জানালো ওদের কোন অসুবিধা হবেনা। বুঝলাম আমাদের শুতে অসুবিধা হবে ভেবে, ওরা রান্নাঘরে শুতে চাইছে। গঙ্গাকে বললাম, আমাদের কোন অসুবিধা হবে না। তাছাড়া মাটিতে ধোঁয়ার মধ্যে শুয়ে তাদের শরীর খারাপ হলে, আমাদেরই ভুগতে হবে। গঙ্গা আমাদের চিন্তা করতে বারণ করে, রান্নাঘরে কুমারকে নিয়ে, মাটিতে পলিথিন সিট্ পেতে শুয়ে পড়লো। ধোঁয়ায় আমাদের কষ্ট হবে বলে, দুই ঘরের মাঝখানের দরজাটা ভেজিয়েও দিল। আমরা পরদিন ভোরবেলা হাঁটা পথ ধরবো বলে, ব্যাগগুলো গুছিয়ে রাখলাম। পরদিন রাস্তায় খাবার জন্য গঙ্গা খিচুড়ি রান্নার শেষে, রুটি তৈরী করে রেখেছে। কিছু আলুসিদ্ধও রাখা হয়েছে। সবকিছু ঠিক করে রেখে আমরা স্লীপিংব্যাগে ঢুকে পড়লাম।

ঘরের একদম বাঁদিকের তক্তাপোশে সিতাংশু শুয়েছে। ওটার দেওয়ালের দিকের দুটো পা-ই নেই। ওকে সাবধান করে দিয়ে বললাম, "তক্তাপোশটা দেওয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড় করানো আছে, বেশী নড়াচড়া কোর না। সবসুদ্ধু ভেঙ্গে পড়বার সম্ভাবনা আছে"। তার পাশেরটায় আমি শুয়েছি। এটার চারটে পা যদিও আছে, তবু একটু নড়লেই, বিকট আওয়াজে সবার পাকা ঘুম ভেঙ্গে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। আমার পাশেরটার তক্তাপোশ নাম হলেও, অর্ধেক তক্তা নেই। কাজেই ওটায় শুলে মাঝখান দিয়ে গলে নীচে মেঝেতে পরে যাবার সম্ভাবনা কম নয়। একবারে ডানদিকে, বারান্দার দিকটায়, হরিশ শুয়েছে। একটু পরেই দেখলাম সিতাংশু ঘুমিয়ে পড়েছে। গঙ্গা ও কুমারের কথাবার্তাও অনেকক্ষণ বন্ধ হয়ে গেছে। হরিশ তো অনেক আগেই ঘুমিয়েছে। আমার পোড়া চোখে ঘুম নেই। নেই কারণ, সারাদিনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, স্লীপিংব্যাগে ফ্যামিলি প্ল্যানিং এর আওতার বাইরের পিসুর দল, সর্বপরি অবিরাম একটা টপ্ টপ্ করে শব্দ। টর্চ জ্বেলে কিসের শব্দ বুঝবার চেষ্টা করলাম। কোথাও কিছু দেখতে পেলাম না। পিসুগুলো বড়ই বিরক্ত করছে। হঠাৎ আমার বাঁ হাতটা ডান কাঁধের কাছে ঠেকতে চমকে উঠলাম। এত ভিজে কেন? উঠে বসে দেখি, বাইরে হাল্কা বৃষ্টি ও কুয়াশার জন্য ছাদ থেকে টপ্ টপ্ করে জল পড়ছে। তাহলে এতক্ষণ এরই শব্দ শুনছিলাম? সর্বনাশ, বাঁদিকের তক্তাপোশে যাবার উপায় নেই। দু'জনে শুলে ওটা ভাঙ্গতে বাধ্য। ডান দিকেরটার অর্ধেক তক্তা নেই। ওটাতে একটা শিশু শুতে পারে। কিন্তু আমি স্লীপিংব্যাগে ঢুকে, নীল আর্মস্ট্রং সেজে ওখানে শুলে? সকাল বেলা আমার মৃতদেহ নির্ঘাৎ নীচের মেঝে থেকে আবিস্কার করা হবে। তখন রূপকুন্ড না গিয়ে আমাকে কাঁটাপুকুর মর্গে যেতে হবে। অতএব কোন উপায় না থাকায়, একটু ডানদিকে সরে চোখ বুজে গায়ের ওপর জল পড়াকে মাথা পেতে মেনে নিয়ে, নিদ্রা দেবীর আরাধনা করতে শুরু করলাম।

 

ছবিঃত্রিপর্ণা মাইতি ও লেখক

ছোটবেলা থেকে মাঠে, ঘাটে, জলাজঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ফড়িং, প্রজাপতি, মাছ, পশুপাখি, গাছের সাথে সখ্যতা। একটু বড় হয়ে স্কুল, এবং তারপরে কলেজ পালানোর নেশায় এর ব্যাপ্তি আরও বৃদ্ধি পাওয়ায়, অনেক নতুন ও অদ্ভুত সব মানুষের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ ঘটে। পরবর্তীকালে ছত্রিশ বছরের কর্মজীবনে ও ভ্রমণের নেশায় আরও বিচিত্র চরিত্রের মানুষ, বিচিত্র সংস্কার, বিচিত্র জায়গা দেখার ও বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ ঘটে। সুবীর কুমার রায় কর্ম সুত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক অফিসার ছিলেন। নেশা ভ্রমণ ও লেখা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা