সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
রূপকুন্ডের হাতছানি

আবার বৃষ্টি শুরু হ'ল। আমরা গঙ্গার কথা মতো দ্রুত এগিয়ে চললাম, এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই এই বিস্তীর্ণ এলাকার একমাত্র থাকবার জায়গাটা দেখতে পেলাম। একটু আগে গঙ্গার ছাগল মারা দেখে, গঙ্গা সম্বন্ধে যে ভয় পাচ্ছিলাম, বাসস্থানের নমুনা দেখে সিতাংশু সম্বন্ধে সেই ভয়টা আবার নতুন করে দেখা দিল। কারণ এখানে আসার জন্য একমাত্র আমিই দায়ী। দু'টো মাত্র ঘর বা ঐ জাতীয় কিছু একটা। ঘাস, খড়, কঞ্চি, ও লতাপাতা দিয়ে তৈরী ইগলুর মতো দেখতে, বেশ লম্বা ঘর। ঘরদুটোর চারপাশে গোবরে থৈ থৈ করছে। বৃষ্টিতে তার অবস্থা আরও শোচনীয়। ঘরে নিশ্চিন্তে ঢুকবার জন্য গোবরের ওপর পর পর কয়েকটা পাথর ফেলা আছে। ব্যবস্থাপনার কোন ত্রুটি ধরা যাবে না। গঙ্গা আমাদের বড় ঘরটার ভিতরে যেতে বললো। আমাদের গায়ে ওয়াটারপ্রুফ থাকলেও, বেশ ভিজে গেছি। জুতো মোজাও বেশ ভিজে। এই অবস্থায় ঘাস, খড়, লতাপাতার তৈরী ঘরে রাত কাটানো কতটা সুখকর হবে ভাবতে ভাবতে, সিতাংশুর পিছন পিছন পাথরের ওপর পা রেখে রেখে চোরের মতো ঘরে ঢুকছি, এমন সময় সিতাংশুর পায়ের তলার পাথরটা নড়ে যাওয়ায়, তাল সামলাতে গিয়ে ওর একটা পা পাথরের বাইরে পড়তেই, সেটা বেশ খানিকটা গোবরে ডুবে গেল। আমার যে তখন কি মনে হচ্ছে না বলাই ভাল।

যাহোক্, ঐ অবস্থায় মাথা নীচু করে ছোট দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকেই, প্রচন্ড ধোঁয়ায় আমার দম বেরিয়ে যাবার উপক্রম। চোখ জ্বালা করে উঠলো, নিশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। ওয়াটারপ্রুফের বোতাম গলা পর্যন্ত লাগানো। তাড়াতাড়ি গলার কাছের বোতামটা খোলার চেষ্টা করেও, খুলতে পারলাম না। গঙ্গা এসে একটানে বোতামের জায়গাটা ছিঁড়ে দিল। ওয়াটাপ্রুফটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, প্রাণটা বাঁচলো। ঘরের ভিতর তিনজন লোক আগুন জ্বেলে বসে আছে। দরজার কাছেই ওরা বসে আছে। লম্বা ঘরটার পিছন দিকে পর পর অনেকগুলো গরু বাঁধা আছে। গুণে না দেখলেও, চল্লিশ-পঞ্চাশটা তো হবেই।

ঘরের ভিতর ঐ লোকগুলোর দেওয়া সামান্য জলে সিতাংশু তার পা ধুয়ে পরিস্কার করে নিল। এই ঘরটার উল্টো দিকে পনের-বিশ হাত দুরে অপর ঘরটা। ঐ ঘরটায় যাবার সময় কুমারের পায়েও প্রচুর গোবর মাখামাখি হ'ল। আমাদের ঘরে, যেখানটায় আগুন জ্বালানো হয়েছে, তার ঠিক পাশে, এক ফুট বা দেড় ফুট উচ্চতার একটা পাথরের স্ল্যাব, দাঁড় করানো আছে। আড়াই ফুট মতো লম্বা এই স্ল্যাবটার খানিকটা অংশ মাটির তলায় পোঁতা আছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে বেশ পাকাপাকি ব্যবস্থা। স্ল্যাবটার অপর দিকে দু'টো শুকনো চট পেতে দেওয়া হ'ল। এই দু'টো চটই এই ঘরের একমাত্র শুকনো বস্তু। আমরা মহামান্য অতিথি বলে, ঐ দুটো শুকনো চটে আমাদের রাতে শোবার ব্যবস্থা করা হ'ল। ঘরের মেঝের মাটি পিটিয়ে শক্ত ও সমান করা হলেও, জলে ভিজে চটচটে, কাদা কাদা। চট্ দু'টো খুব বেশী লম্বা না হওয়ায়, আমাদের প্রায় কোমরের কাছ থেকে, চটের বাইরে ভিজে মাটিতে থাকবে। এখানে ঠান্ডাও বেশ ভালই, জায়গার অভাবে স্লীপিং ব্যাগ খোলার উপায় নেই, তার ওপর একনাগাড়ে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়েই যাচ্ছে। আমরা আগুনের পাশে সবাই বসে আছি। আগুন আর আমাদের শোবার চটের মাঝখানে, শিলনোড়ার শিলের মতো পাথরের স্ল্যাবটা রয়েছে। শুনলাম কুমার, হরিশ ও এই ঘরের দু'একজন উল্টোদিকের ছোট ঘরটায় রাত্রে শোবে। বৃষ্টি, গোবর, আর সিতাংশুর ভয়ে, ইচ্ছা থাকলেও পাশের ঘরটার সৌন্দর্য আর দেখতে যাওয়ার সাহস হ'ল না। তবে ওটার অবস্থা যে এর থেকেও শোচনীয়, তা না দেখেও বলে দেওয়া যায়। কারণ আমরা অতিথি, আমাদের খারাপ ঘরে ওরা থাকতে দেবে না।

এবার রান্না করার তোরজোর শুরু হ'ল। গঙ্গা ছাগলের মাংসের আশায় এতক্ষণ অপেক্ষা করেছে। আস্তে আস্তে বেশ অন্ধকার নেমে এল। গঙ্গা আর অপেক্ষা না করে নিজেই ছাগলের মালিক, প্রয়োজন হলে ছাগলের মৃত দেহের উদ্দেশ্যে, ছুরি নিয়ে রওনা হবার জন্য উঠে দাঁড়ালো। আমরাও মনে মনে বিনা ঝুঁকির ও প্রায় বিনা পয়সার মাংসের খিচুড়ি ভোগের আশায় মানসিক প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু বাধ সাধলো ঘরের লোকগুলো। তারা একসাথে প্রায় সকলেই গঙ্গাকে ওখানে এই অন্ধকারে যেতে বাধা দিল। ওরা জানালো যে, "যে সব কুত্তা ছাগল পাহারা দেয়, তারা ওকে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলবে। ওই কুত্তার হাত থেকে বেঁচে গঙ্গা তো দুরের কথা, শেরও ছাগল নিয়ে যেতে পারবে না"। আমি নিজেও ঐ জাতীয় কুকুর অন্যান্য পাহাড়ী পথে দেখেছি। স্থানীয় পাহাড়ী কুকুর, কিন্তু বাঘের মতো চেহারা। এইসব কুকুর পাল পাল ছাগল, ভেড়া পাহারা দেয়। এই সব ছাগল, ভেড়ার পাশ দিয়ে যাবার সময়, ছাগল ভেড়ার মালিক আমাদের সাবধান করে দিয়ে বলেছে—ওদের গায়ে হাত না দিয়ে, পাশ দিয়ে চলে যেতে। তাদেরও বলতে শুনেছি, শেরও ওদের কাছ থেকে ছাগল, ভেড়া তুলে নিয়ে যেতে পারবে না।

রূপকুন্ডের হাতছানি

শেষ পর্যন্ত গঙ্গা আগেই টাং কেটে নিয়ে না আসার জন্য আক্ষেপ করতে করতে, রণে ভঙ্গ দিয়ে বসে পড়লো। সেই পুরানো ফর্মুলায়, ঐ আগুনেই খিচুড়ি রান্না শুরু হ'ল। আমরা আগের মতোই আগুনের ধারে বসে গল্প করছি। এই ঘরের লোকেরা গঙ্গাকে সিগারেট দিল। একটা সিগারেট ওরা দু'-তিনজন মিলে টানতে থাকল।

একটু পরেই খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পড়া গেল। শুয়ে পড়তে বাধ্য হলাম, কারণ ঘরের মালিকদের এর বেশী আলো বা আগুন জ্বালিয়ে বিলাসিতা করার মতো সামর্থ্য নেই। শিলের মতো পাথরের স্ল্যাবটার ঠিক পাশে আমি, আমার পাশে সিতাংশু শুয়েছে। আমরা অতিথি বলে ওরা ক্ষমতার বাইরে হলেও, আগুনে বেশ কিছু শুকনো ডালপালা দিয়ে দিল। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে শুরু করলো। আগুনের তাপে তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে বলে, সিতাংশু ওর ভিজে উলিকটের গেঞ্জিটা আমার বুকের ওপর মেলে দিল। আগুনের তাপে পাথরের স্ল্যাবটাও বেশ গরম হয়ে গেছে। আমার রীতিমতো গরম লাগছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরের সবাই চুপ করে গেল। সিতাংশুও ঘুমিয়ে পড়েছে। পায়ের কাছের খোলা দরজা দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। এখন বাইরে আর বৃষ্টি পড়ছে না। আকাশ ভরা তারার মেলা। আমার আর ঘুম আসে না। যতবার তন্দ্রা মতো আসে, ঘুম ভেঙ্গে যায়। গরুদের উৎপাতে ঘুম আসা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো। এটা পত্ পত্ করে পায়খানা করলো, তো ওটা ছড় ছড় করে পেচ্ছাপ করতে শুরু করলো। তার ওপর মাঝে মাঝই, হাম্বা-আ-আ-আ-আ রব্। সর্বপরি স্যাঁতস্যেঁতে মাটিতে পিসুর উৎপাত ও ঘরের সুগন্ধ আমার ঘুমে ব্যাঘাত সৃষ্টি করলো। আসলে এটা একটা অস্থায়ী গোয়াল ঘর। বহু নীচে এইসব লোকের বাস। ঐসব এলাকা থেকে এরা গরু, মোষ, ছাগল, ভেড়া নিয়ে আসে ঘাস খাওয়াবার জন্য। অনেকের গবাদি পশু একসাথে এখানে নিয়ে আসা হয়। আর এরা পালা করে কিছুদিনের জন্য এখানে এসে থাকে। প্রত্যেকেই কিছু না কিছু গরু মোষের মালিক। একদল আসে, তারা কিছুদিন থেকে ফিরে যায়, অন্য দল আসে। এইভাবে বর্ষার সময় থেকে কয়েক মাস তারা এখানেই গরু, মোষগুলোকে রাখে। ভাবতেও গর্ব হচ্ছে, অতগুলো গরুর সঙ্গে সমান আদরে, জামাই আদরেও বলা যায়, আজ আমরাও এখানে থাকার সুযোগ পেয়েছি। অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে নানা রকম আজগুবি চিন্তা, মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমার ডানপাশে এখনও আগুন জ্বলছে, তবে তার তেজ অনেক কমে গেছে। এইভাবে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা।

খুব জল পিপাসা পাওয়ায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। উঠে বসে দেখি ডানপাশের আগুন কখন নিভে গেছে। পায়ের কাছের খোলা দরজা দিয়ে হুহু করে বরফ শীতল বাতাস ঢুকছে। শরীরটা কিরকম ম্যাজ্ ম্যাজ্ করছে। বোধহয় পাস্তুরাইজড্ হয়ে গেছি। ঢকঢক্ করে বেশ খানিকটা জল খেয়ে শুয়ে পড়লাম। শরীরের মধ্যে কিরকম একটা অস্বস্তি হচ্ছে। মনে হয় জ্বর আসছে। এইভাবে শুয়ে থেকে থেকে, কখন আবার ঘুমিয়ে পড়েছি।

ছোটবেলা থেকে মাঠে, ঘাটে, জলাজঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ফড়িং, প্রজাপতি, মাছ, পশুপাখি, গাছের সাথে সখ্যতা। একটু বড় হয়ে স্কুল, এবং তারপরে কলেজ পালানোর নেশায় এর ব্যাপ্তি আরও বৃদ্ধি পাওয়ায়, অনেক নতুন ও অদ্ভুত সব মানুষের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ ঘটে। পরবর্তীকালে ছত্রিশ বছরের কর্মজীবনে ও ভ্রমণের নেশায় আরও বিচিত্র চরিত্রের মানুষ, বিচিত্র সংস্কার, বিচিত্র জায়গা দেখার ও বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ ঘটে। সুবীর কুমার রায় কর্ম সুত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক অফিসার ছিলেন। নেশা ভ্রমণ ও লেখা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা