সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
রূপকুন্ডের হাতছানি

সকালবেলা সিতাংশুর ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। উঠে দেখি আমার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। কাউকে কিছু জানালাম না। গঙ্গা শুনলেই আজ এখানে থেকে যেতে বলবে। মুখ ধুয়ে, কফি খেয়ে, মালপত্র নিয়ে রাস্তায় নামলাম। কিন্তু সামান্য পথ হেঁটেই আমি বুঝে গেলাম, এই জ্বর নিয়ে, আমার পক্ষে আর হাঁটা সম্ভবপর নয়। অথচ "দেবল" এখান থেকে অনেক কিলোমিটার পথ, এবং সেখানে না ফিরেও আমার কোন উপায় নেই। সময় নেবার জন্য সিতাংশুকে বললাম, খুব খিদে পেয়েছে, কিছু না খেয়ে হাঁটতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ও, হরিশ কুমার ও গঙ্গাকে ডেকে ছাতু মাখতে বললো। ছাতু মাখা হলে, ওরা সকলে পরিমান মতো খেল। আমি এক দলা ছাতুও খেতে পারলাম না। আমার তখন মনে হচ্ছে রাস্তার ওপরেই গায়ে কিছু চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ি। ছাতু না খাওয়ায় সিতাংশু জিজ্ঞাসা করলো, আমি খেলাম না কেন ? ভাল লাগছে না উত্তর শুনে, ও ভীষণ রেগে গেল। আমরা একটু বসে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। আমি দেখতে পাচ্ছি প্রতি মিনিট হাঁটা পথে, আমি ওদের থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ছি। এইভাবে, এই গতিতে হাঁটলে, আমি অসুস্থ শরীর নিয়ে একা পিছনে পড়ে যাব। বাধ্য হয়ে আবার ওদের থামতে বললাম। জল খেলাম। একটু সময় নষ্ট করে আবার হাঁটার চেষ্টা করলাম।

এইভাবে আস্তে আস্তে সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল। আমার এখন আর এক পা ও হাঁটার ক্ষমতা নেই। গায়ে প্রবল জ্বর, নাক মুখ দিয়ে গরম নিশ্বাস পড়ছে। বিশ্রাম পাবার আশায় শরীর এলিয়ে পড়ছে, অথচ দেবলের আগে বিশ্রামের কোন সুযোগ নেই। বাধ্য হয়ে সিতাংশুকে ডেকে আমার অবস্থার কথা বললাম। ও আমার গায়ে হাত দিয়ে, রীতিমতো ভয় পেয়ে গেল। ও গঙ্গাকে ডাকতে গেলে আমি বাধা দিয়ে বললাম, গঙ্গা শুনে কী করবে? শরীর খারাপ শুনলে, গঙ্গা এখানে কোথাও কোন চালাঘরে থেকে যেতে বলবে। এখানে কোন ডাক্তার নেই, আমার শরীরও বেশ খারাপ। কাল রাতে ঠান্ডা গরমে, আমার প্রচন্ড ঠান্ডা লেগে গেছে। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, কাঠগুদাম বা অন্য কোন বড় শহরে ফিরে যাওয়াই ভাল। ও ভয় পেয়ে আমার সঙ্গে সঙ্গে, খুব আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগলো। কিছুটা হেঁটে ও একটা মুসম্বি লেবুর গাছ থেকে ছোট্ট একটা লেবু তুলে আমাকে দিয়ে, লেবুর গন্ধটা শুঁকতে শুঁকতে যেতে পরামর্শ দিল। ও জানালো লেবুর গন্ধে শরীর ভাল লাগবে। ওকে বললাম আমার ঠান্ডা লেগেছে, জ্বর হয়েছে, কিন্তু গা বমি বমি করছে না, যে লেবুর গন্ধ শুঁকলে শরীর ভাল লাগবে। ও এবার আর আমার কথায় কান না দিয়ে, গঙ্গাকে ডাকলো। গঙ্গা সব শুনে আমাদের সাথে ওষুধ আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলো। আমি বললাম হরিশের কাছে যে ব্যাগটা আছে, তাতে সবরকম ওষুধই আছে। গঙ্গা আমাদের শুয়ে বসে বিশ্রাম নিতে বলে বললো, ও হরিশের কাছ থেকে ব্যাগটা নিয়ে আসছে। একটু পরেই তার চিৎকার শুনতে পেলাম। সে চিৎকার করে হরিশকে ডাকছে। আরও বেশ কিছুক্ষণ পরে সে খালি হাতে ফিরে এসে জানালো, হরিশ অনেক এগিয়ে গেছে। ওষুধের ব্যাগ নিয়ে হরিশ এগিয়ে চলে গেছে বলে, সে হরিশের উদ্দেশ্যে গালিগালাজ শুরু করে দিল। দেবলে ফিরে আজ তার একটা ব্যবস্থা করবে, তাও জানাতে ভুললো না। আসলে হরিশের রাগ হয়েছে। গঙ্গা জিজ্ঞাসা করলো আমি হাঁটতে পারবো কিনা। না পারলে ও এখানে কোথাও থাকার ব্যবস্থা করবে। উত্তরে আমি জানালাম যে, আজ যে ভাবেই হোক, দেবলে ফিরে যাবই। গঙ্গা বললো হরিশ থাকলে ওর পিঠের মাল হরিশকে দিয়ে, ও আমায় পিঠে চাপিয়ে নিয়ে যেত। আমি জানালাম তার প্রয়োজন হবে না, তবে তোমরা একটু আস্তে হাঁটো, এগিয়ে যেও না। এর মধ্যে কুমারও গঙ্গার চিৎকার শুনে ফিরে এসে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। আমরা এবার খুব আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলাম। গায়ে প্রবল জ্বর, পেট একদম খালি, গতি ক্রমশঃ কমতে শুরু করলো। গঙ্গা মাঝেমাঝেই উৎসাহ দিয়ে জানাচ্ছে, আমরা প্রায় দেবলের কাছাকাছি এসে গেছি। এইভাবে কখনও থেমে, কখনও বসে, কখনও বা একটু আধশোয়া হয়ে, সন্ধ্যার কিছু আগে দেবলে এসে হাজির হলাম।

রূপকুন্ডের হাতছানি

গঙ্গা ঘর খুলে দিল। আমি শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়েই ঘরের বাইরে গঙ্গার সাথে হরিশের ঝগড়ার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। গঙ্গা হরিশকে বলছে- "তুমি ওষুধের ব্যাগ নিয়ে আগে চলে এলে কেন? রাস্তায় যদি বাবুর কিছু হ'ত, তাহলে কী হ'ত? কে দায়িত্ব নিত"? ঝগড়া, কথা কাটাকাটি চলতেই লাগলো। এর মধ্যে কুমার দু'কাচের গ্লাশ গরম দুধ আর দু'টো বড় বড় বালুসাই মিষ্টি নিয়ে এসে হাজির হ'ল। সে বললো এগুলো তার বাড়িতে জন্মাষ্টমীতে, পূজোর জন্য তৈরী হয়েছে। আমার এসব খেতে ইচ্ছা করছিল না, কিন্তু সে আমাকে ওগুলো খেয়ে নিতে অনুরোধ করলো। আমি উঠে বসে খেয়ে নিয়ে, ব্যাগ খুলে একটা ক্রসিন টেবলেট্ খেয়ে নিলাম। একটু পরেই প্রচুর ঘাম হয়ে জ্বর কমে গেল। মাথার ভিতর একটা প্রচন্ড যন্ত্রণা বোধ করছিলাম। ঐ অবস্থায় শুয়ে শুয়ে, আমরা আমাদের রূপকুন্ড যাওয়ার অভিজ্ঞতা, জায়গাগুলোর সৌন্দর্য, ইত্যাদি নিয়ে নিজেরা আলোচনা করতে শুরু করলাম। গঙ্গা, কুমার ও হরিশ এক ধারে বসে, ও সিতাংশু তার চৌকিতে শুয়ে। আমি অবশ্য একরকম শ্রোতার ভুমিকায় ছিলাম। একটু পরে ওরা চলে গেল। আমরা চুপ করে শুয়ে থেকে অনেকক্ষণ পরে, রাতের খাবার খেতে গেলাম। অনেক দিন পরে খিচুড়ির হাত থেকে মুক্তি পেয়ে, মাংস রুটি খেলাম। ঘরে ফিরে এসে আর একটা ক্রসিন খেয়ে শুয়ে পড়লাম। আজ আর নিদ্রা দেবীর আরাধনা করতে হ'ল না। একটু পরেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়লাম।

ঘুম ভাঙ্গলো বেশ ভোরেই। গায়ে আবার গতকালের মতো জ্বর ও মাথা ব্যথা নিয়ে ঘুম ভাঙ্গলো। সিতাংশুকে বললাম দশটার সময় একটা ক্রসিন খেয়ে নেব। আধ ঘন্টার মধ্যে জ্বর কমে যাবে। সাড়ে দশটায় আমরা গোয়ালদামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবো। আট কিলোমিটার পথ যেতে যদি তিন ঘন্টাও লাগে, তাহলেও দেড়টা-দু'টোর মধ্যে পৌঁছে যাব। তারপরে আবার জ্বর ফিরে এলে, তখন দেখা যাবে।

কথা মতো আমরা তৈরী হয়ে দোকানে খেয়ে দেয়ে, দশটার সময় একটা ক্রসিন চার্জ করে দিলাম। হিসাব মতো সাড়ে দশটা নাগাদ জ্বরও কমলো, আমরাও সময় নষ্ট না করে, গোয়ালদামের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করে দিলাম। গঙ্গারা আমাদের সাথে গোয়ালদাম পর্যন্তই যাবে। আমাদের মালপত্র পৌঁছে দিয়ে, ওরা ওদের গ্রামে ফিরে আসবে। দু'-তিন ঘন্টায় পৌঁছনোর জন্য আমি একটু তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করলাম। কিন্তু মাঝপথেই আবার জ্বর বাড়তে শুরু করলো। রাস্তায় আবার একটা ক্রসিন খেয়ে বসে থাকলাম। কিছুক্ষণ পরে আবার হাঁটা শুরু করলাম। অবশেষে বিকেল বেলা গোয়ালদাম এসে পৌঁছলাম।

আমার অবস্থা এখন শোচনীয়। পিন্ডারী যাবার প্ল্যান, অনেক আগেই দেবলে বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু আমার গায়ে এত জ্বর, চোখ দুটো টকটকে লাল, ভালভাবে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই দেখে, গঙ্গারা আজ রাতটা এখানেই থেকে, কাল ভোরে আমাদের বাসে তুলে দিয়ে নিজেদের গ্রামে ফিরে যাবে ঠিক করলো। আমার ঠান্ডা লেগেছে জানতে পেরে গঙ্গা সিতাংশুকে বুদ্ধি দিল, আমায় যেন একটুও জল খেতে না দেওয়া হয়। সিতাংশু কারো সাথে পরামর্শ করার সুযোগ না পেয়ে, গঙ্গার কথার ওপর আস্থা রাখলো। আমার জল পিপাসায় ছাতি ফেটে যাবার উপক্রম, কিন্তু ও আমাকে এক ফোঁটা জল খেতে দিতে রাজী হ'ল না। শেষে অনেক কাকুতি মিনতির পর, ও এক ঢোক জল দয়া করে দিল। গঙ্গা এবার ওকে নিয়ে ডাক্তার ডাকতে চললো। আমি সিতাংশুকে অনেক ভাবে, এখানকার ডাক্তার ডাকতে বারণ করলাম। এখানে ডাক্তার বলতে কেউ নেই। কিছু কোয়াক ডাক্তার অবশ্য আছে, কিন্তু তারা কিছু হলেই সুঁই দেয়, অর্থাৎ ইঞ্জেকশান দেয়। সব অসুখেই প্রায় একই চিকিৎসা। এতে হিতে বিপরীত হবে। কিন্তু সিতাংশু তখন অসহায় অবস্থায় বোধবুদ্ধি, বিচার বিবেচনা শক্তি হারিয়েছে। "কানু বিনা গীত নাই" এর মতো "গঙ্গা বিনা গতি নাই" ধারণায়, ও গঙ্গাকে নিয়ে ডাক্তার ডাকতে চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পরে ফিরে এল ডাক্তারের দেখা না পেয়ে। যাক্ বাঁচা গেল, আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

ছোটবেলা থেকে মাঠে, ঘাটে, জলাজঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ফড়িং, প্রজাপতি, মাছ, পশুপাখি, গাছের সাথে সখ্যতা। একটু বড় হয়ে স্কুল, এবং তারপরে কলেজ পালানোর নেশায় এর ব্যাপ্তি আরও বৃদ্ধি পাওয়ায়, অনেক নতুন ও অদ্ভুত সব মানুষের সান্নিধ্য লাভের সুযোগ ঘটে। পরবর্তীকালে ছত্রিশ বছরের কর্মজীবনে ও ভ্রমণের নেশায় আরও বিচিত্র চরিত্রের মানুষ, বিচিত্র সংস্কার, বিচিত্র জায়গা দেখার ও বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ ঘটে। সুবীর কুমার রায় কর্ম সুত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক অফিসার ছিলেন। নেশা ভ্রমণ ও লেখা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা