সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
তপুর পৃথিবী

মনু নদীর ব্রীজের ওপর দিয়ে ঝমঝম শব্দ করে সবুজ হলুদ রং মেশানো বিশাল রেলগাড়ীটা দূরন্ত বেগে ছুটে যায় কুলাউড়ার দিকে। মনু নদীর ঘোলা পানি চক্কর খায় । নির্বাক তাকিয়ে দেখে তপু। নদীর পাড়ে বাঁধের গায়ে গুলমোহরের গাছগুলো লাল ফুলে ভরে আছে। কি সুনসান দুপুর। ছায়া ছায়া গাছ গুলোর নীচে বসলেই মায়ের কথা খুব মনে পড়ে তপুর । তখন বুকের ভেতর একদলা কষ্ট ঘুরপাক খেতে থাকে । এক সময় সেই কষ্ট চোখের কোল ঘেঁষে জল হয়ে ঝরে। স্কুল এস-এস-সি পরীক্ষার ছুটি। বেশ কদিন হয়ে গেল ছুটি। ছুটির দিনগুলো কাটতেই চায় না। আর এসময় বাড়িতে নতুন মায়ের কাছেই বেশী থাকতে হয়। তপু কাজে ফাঁকি দেয় না কখনো। কিন্তু তারপরও বাবার কাছে নানান মিথ্যে কথা বলেন নূতন মা। বাবা সারাদিন হাটে বাজারে কাটিয়ে ফিরলেই নূতন মায়ের ঘ্যান ঘ্যান শুরু হয়। তপু এই করেছে, তপু ঐ করেছে। বাবার মেজাজ ভালো থাকলে তেমন কিছু বলেন না। কিন্তু সবদিনতো মেজাজ ভালো থাকে না। কাঁচা ঘুম থেকে তুলে মাঝে মাঝেই চড় থাপ্পর বসিয়ে দেন। তপু প্রথম প্রথম বুঝতে পারতো না কি কারণে তাকে বাবা মারছেন। এখন বুঝে নিয়েছে এ সংসারে যতদিন সে আছে ততদিন তার কপাল থেকে মার-পিট বাদ যাবে না। মার খেলেই মায়ের মুখটাই প্রথমে চোখে ভাসে তপুর । মায়ের মৃত্যুকালে কাছে থাকতে পারেনি তপু। বার্ষিক পরীক্ষার পর মামার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল ও। যাবার দিন বাঁধ পর্যন্ত এগিয়ে এসেছিলেন মা। শেষ মুহুর্তে তপুর কপালে একটি মিষ্টি চুমু খেয়ে বিদায় জানিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন মা। সবুজ শাড়ি পড়া মা'কে অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পেলো তপু। মা কি জানতেন তাঁর প্রিয় তপুকে এই তাঁর শেষ দেখা ? তপু জানতো না মায়ের উষ্ণ কোল আর পাবে না সে। এসব কথা ভাবতে চায় না তপু। তবুও একা থাকলেই কোত্থেকে যে এসব কথা মাথার ভেতর ভিড় জমায় তপু বুঝতে পারেনা।

প্রায় মাথার ওপর উঠে এসেছে সূর্য। বৈশাখ মাসের শেষ। সূর্যের আলোয় বেশ প্রখরতা। গরম হয়ে উঠেছে আশ পাশ। তপু নিশ্চুপ বসে থাকে রাতা গাছের ছায়ায়। আজ রিক্তা দি আসবে সিলেট থেকে। কতোদিন হলো রিক্তাদিকে দেখা হয় না। তপুর জ্যাঠাতো বোন রিক্তাদি। মায়ের মৃত্যুর পর আদর যেটুকু পেয়েছে সব রিক্তাদির। রিক্তাদি কি সুন্দর। যখন হাসে দাঁতগুলো ঝলকে ওঠে। রিক্তাদির পবিত্র হাসি আর উষ্ণ আদর তপুকে অনেক কষ্ট ভুলিয়ে দেয়। গত বছর খুব ভাল রেজাল্ট নিয়ে এস-এস-সি পাশ করেছে রিক্তা দি। ডাক্তার কাকুর ইচ্ছে সিলেটের কোন ভালো কলেজে পড়বে। সিলেট মহিলা কলেজে ভর্তি হয়ে যায় রিক্তাদি। এক সময় ক্লাশ শুরু হয় ওর। ডাক্তার কাকু চালিবন্দর ছাত্রাবাসে রিক্তাদির থাকার ব্যবস্থা করে আসেন। রিক্তাদি ছাত্রাবাসে চলে যাবার পর কি যে খারাপ লেগেছে তপুর তা কাউকেই বুঝানো যাবে না। রিক্তাদি বাড়ি থাকতে ও ছিলো রিক্তাদির সর্বক্ষণের সংগী। তাই খুব কষ্ট হলো তপুর। রিক্তাদি যাবার বেলা অনেক আদর করলো, বললো চিঠি লিখবে। যাবার সময় একটা আস্ত বিশ টাকার সবুজ নোট তপুর হাতে গুঁজে দিয়েছে রিক্তাদি। রিক্তাদি যাবার পর খুব খালি খালি লাগতো তপুর। কাজের ফাঁকে স্কুলে স্যারদের পড়ানোর ফাঁকে আনমনা হয়ে যেতো তপু। কোথায় যে ওর মন চলে যেতো ভেবে পায়না তপু। স্কুল ছুটির পর কতো দিন মনু নদীর তীরের বাঁধ ধরে একা একা হেঁটেছে। আখ ক্ষেতের সবুজ পাতার ফাঁকে যখন সন্ধ্যের অন্ধকার নেমে এসেছে তখনই মনে হয়েছে বাড়ী ফেরার কথা। বাড়ী ফিরে নতুন মায়ের বকুনি খেয়েছে। পেটে ক্ষুধার চোঁচোঁ নিয়েও পড়তে বসেছে। পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে একসময় শুয়ে পড়েছে চটের ওপর। অবিচারের মাত্রা বেড়েছে। নতুন মা'র বকা আর বাবার চড় থাপ্পড় কচি গাল গুলোকে ম্লান করে দিয়েছে।

একটা ঘুঘু ডেকে উঠেছে উদাস সুরে। ঘুঘু পাখিকে বড় আপন মনে হয় তপুর। দুপুর বেলা ওরা যখন দীর্ঘ লয়ে ঘুউ... উ... ঘু..উ..ডেকে ওঠে তখন বুকের ভেতরটা উথাল-পাথাল করে তপুর। পাখিগুলো যেন ডেকে ডেকে বলে- তোর কষ্টের কথা আমরা জানি তপু।মা মরা ছেলেদের এই কষ্টটুকু সহ্য করতেই হয়।দেখিস একদিন তুই অনেক বড় হবি। কে জানে কবে বড় হবে তপু। রিক্তাদি কে শাড়ি পড়লে কি বড় সড়টি লাগে। পাশের বাড়ির মিতুদির বিয়ে হয়ে গেলো। রিক্তাদিকে বলেছিলো তপু ‘ তোমার বিয়ে হবে রিক্তাদি’? লাজুক হেসেছিলো রিক্তাদি। বলেছিলো ‘হয়তো হবে’। অনেক দিন হয়ে গেলো। মা মারা গেলেন। রিক্তাদি এস-এস-সি পাশ করে সিলেটে চলেগেলো। কই কতটুকু বড় হলো তপু। ঘুঘুরা এখনও দুপুর গুলো উদাস ডাকে ভরিয়ে রাখে। দূরের রাস্তা দিয়ে একটা বাস চলে গেলো। রিক্তাদি কখন আসবে? রিক্তাদির কাছ থেকে জেনেছে তপু। রিক্তাদি সিলেট থেকে বাসে আসবে মৌলভীবাজার; তারপর বাস বদল করে কুলাউড়ার বাসে চড়ে এসে নামবে কটারকোনা বাজারের মনু ব্রীজে। সেখান থেকে হেঁটে কিংবা রিক্সায় গ্রামে। ঠিক এই বাঁধ ধরেই রিক্তাদিকে আসতে হবে। দূরের বাঁকটাতে এলেই তপু দেখতে পারবে রিক্তাদিকে।

রিক্তাদি আসছে না কেন? খুব অস্থির লাগে তপুর। নদীতে বেগে ছুটে যাচ্ছে জলস্রোত। দূরের কোন পাহাড় থেকে নেমে এসেছে মনু নদী। তার স্রোতের কি বেগ। বর্ষায় ভয়ংকর হয়ে যায় মনু। ক’ বছর আগে নাকি সারা মৌলভীবাজার শহরকে ভাসিয়ে নিয়েছে মনু। এখনো প্রতিবছর দু’কূল ভাসিয়ে দেয় রাগি মনু। অথচ শীতে কি নিশ্চুপ থাকে মনু। তখন তাকে বড় চুপচাপ শান্ত মেয়েটির মতো মনে হয়। শীতের মনুকে খুব ভালোবাসে তপু।

বাঁধের পাশ ঘেঁষে লাগানো নাম না জানা গাছ গুলোতে হলুদ আব বেগুনী ফুলের সমারোহ। চৈত্রের শেষ থেকে পুরো বৈশাখ ঐ ফুল আলো করে রাখে নদীর পার। ফুল, পাখী, গাছপালার প্রতি দারুন ভালোবাসা তপুর। মানুষের চাইতে তাদেরকে বেশী ভালো মনে হয় তপুর। কারো সাতে পাঁচে নেই গাছ, ফুল আর পাখীরা। কোনদিন ওরা কারো ক্ষতি করে না।ফল , ফুল গন্ধ আর মিষ্টি ডাক দিয়ে সবাইকে আনন্দিত রাখে ওরা।বরং মানুষই বেশি ক্ষতি করে ওদের। গাছ কেটে চুলো জ্বালায়, অযথাই ফুল ছিঁড়ে একাকার করে। ফাঁদ পেতে ঐ সুন্দর পাখিগুলো ধরে মানুষেরা রাক্ষসের মতো খায়ও। ওসব মনে হলে সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে তপুর।

আকাশের দিকে তাকায় তপু। নীল আকাশে সাদা সাদা মেঘ উড়ে যাচ্ছে। অনেকটা শরতের মতো । তপুতো জানে এই বোশেখে যে কোন সময় আকাশের কোনে কালো মেঘ জমাট বেঁধে যেতে পারে। হঠাৎ করেই উড়তে উড়তে চারদিক আঁধার করে ফেলতে পারে। ভয়ংকর শব্দের সাথে বিজলি চমকাতে থাকবে আর শোঁ শোঁ করে ছুটতে থাকবে বাতাস। কাল বৈশাখী নাকি এর নাম।

আঁটি বেধে যাওয়া আমগুলো দেদার নেমে আসে মাটিতে। তপুর খুব মজা লাগে আম কুড়োতে। যদিও বুকের ভিতর বিজলির চমক আর গুড় গুড় মেঘের ডাকের ভয়ও সাপটে থাকে অনেক সময়। আর ক’দিন পরেইআম-কাঠাল- আনারস পেকে যাবে। জৈষ্ঠ যেতে না যেতেই আম শেষ, কাঠাঁল- আনারস আষাঢ় পর্যন্ত থাকে। তারপর আর ফল নেই তেমন । আম কাঁঠালের ফেলে দেয়া বীজ থেকে চারা গজায়। আমের কালচে শিশু চারাগুলো কি যে চমৎকার !

তপু অবাক হয় আষাঢ়ের বর্ষন দেখে। গভীর কালো আকাশ ভেঙ্গে অঝোরে বৃষ্টি নামে। ওদের টিনের চালে ঝমঝম শব্দ ওকে আরও বেশি একা করে দেয়। মা বর্ষায় কাঠাঁলের বীজ, সীম, বাদাম ভেজে দিতেন। কই নতুন মা'তো এমন না। বর্ষার অঝোর বৃষ্টির দিনগুলোতে তপু চুপচাপ শুয়ে কিংবা বসে জানালা দিয়ে বৃষ্টি ঝরা দেখে। গাছের পাতার নাচা-নাচি দেখে। মায়ের ছবিটি চোখের সামনে মেলে ধরে একা একা কথা বলে মায়ের সাথে।

তপুর পৃথিবী

আকাশ থেকে চোখ ফেরায় তপু। দূরে রাস্তার দিকে চোখ রাখে। তাকিয়েই চমকায়। একটা রিক্সা আসছে মনে হয়। উঠে দাঁড়ায় তপু। তাই, নিশ্চয় রিক্তাদি। ভাঙ্গা কালভার্ট-এর কাছে এসে দাঁড়ায় তপু। হ্যাঁ রিক্তাদিই নামে। ছাই রঙের ব্যাগ নামিয়ে রাখে পাশে। বাতাসে ওড়ে রিক্তাদির নীল ওড়না। একটা জোর লাফ দেয় তপু । তারপর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দৌড় লাগায়। অল্পক্ষনেই পৌঁছে যায় রিক্তাদির কাছে। রিক্তাদি পার্স খুঁজে রিকসাওলাকে টাকা দেয় তারপর মিষ্টি হেসে জড়িয়ে ধরে তপুকে। গভীর করে চুমু খায় তপুর কপালে। আনন্দে তপুর দু'চোখ জলে ভরে যায়। কান্না ভেজা গলায় বলে-এতো দেরী হলো কেন? রিক্তাদি ওকে দেখে। একহাতে জড়িয়ে রেখে বলে -

"কাঁদছিস কেন পাগল?"
লজ্জা পায় তপু-
"-না, না, কোথায় কাঁদছি।"

সারা পৃথিবী আকাশ -মাটি-গাছপালা-মনু নদী সব হেসে ওঠে যেন তপুর কথা শুনে। তপুর পৃথিবীতে আজ অনেক আনন্দ।

ভাইবোন হাত ধরাধরি করে বাড়ীর দিকে হাঁটতে থাকে।


ছবিঃ ঈশিতা চন্দ্র

চন্দনকৃষ্ণ পাল অনেকগুলি ছড়া ও কবিতাপত্র সম্পাদনা করেন। ঢাকার এক সরকারী সংস্থায় কর্মরত এই লেখকের একাদিক ছোটদের জন্য বই প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা