সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
গ্রেসকাকু

গ্রেসকাকুর ধবধবে সাদা মুখ এখন টেনশনে লাল। উত্তেজনায় দাড়িগোঁফে আঙ্গুল চালাচ্ছেন বারবার। মঝেমধ্যে দু'চোখ বুঁজে হাত জোড় করে বিড়বিড় করে কীসব মন্ত্র পড়ছেন আর পায়চারি করছেন উদ্ভ্রান্তের মতো।গ্রেসকাকুর হাকুচ কালো একটা ল্যাব্রেডর আছে, তার নাম ক্যাসপার। চেহারায় বাঘের মতো হলেও ক্যাসপার মোটেই রাগী কুকুর নয়, বরং একটু ভিতুই বলা চলে। একটা বেড়াল ফ্যাস করে উঠলেও ল্যাজ গুটিয়ে কুঁই কুঁই করতে থাকে ক্যাসপার। ক্যাসপার প্রভুভক্ত ধরনের কুকুর, এখন এই রুদ্ধশ্বাস সময়েও জিভ বার করে হ্যা হ্যা করতে করতে কালো একটা বিরাট উলের বলের মতো গ্রেসকাকুর পায়ে পায়ে ঘুরছে।

এতক্ষণ আমরাও বসে ছিলাম। কিন্তু খেলার শেষদিকে এসে উত্তেজনার পারদ তুমুল চড়েছে বলে আমরা দাঁড়িয়ে পড়েছি। ভুলু সবুজ সংঘের লাস্ট ডাউন ব্যাস্টম্যান। প্যাড-গ্লাভস পরে মাথায় হেলমেট চাপিয়ে দাঁড়ানো আমার পাশে। হেলমেট খুলে আমার কানের কাছে মুখটা নিয়ে বলল, আ্যই চপ্পল, ওই দ্যাখ গ্রেসকাকু টেনশনে ভুল মন্ত্র বলছেন।

আমার নাম মোটেও চপ্পল নয়, চপল। কিন্তু হতচ্ছাড়া ভুলু কিছুতেই সে নামে ডাকবেনা আমাকে। আমি চোখমুখ তিরিক্ষি করে বললাম, তুই কী করে জানলি ভুল মন্ত্র পড়েছেন?
ভুলু বলল, গ্রেসকাকু 'ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং' মন্ত্র বলছেন। ওটা তো সূর্যপ্রণাম মন্ত্র।ওই মন্ত্র দিয়ে আর যাই হোক না কেন ক্রিকেট ম্যাচ জেতার কথা নয়।কিন্তু গ্রেসকাকু যা বদরাগী লোক, ভুলটা ধরিয়ে দিলে রেগে যাবেন না তো?

আমি নিমতেতো মুখে জুতসই কিছু বলতে যাচ্ছিলাম তার মাঝখানে রাসেল খামোখা রান আউট হয়ে গেল। সহজেই যেখানে একটা সিঙ্গল্স হয় সেই রান নিতে গিয়ে আউট। গদাই লস্করি চালে দৌড়তে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল পিচের মধ্যে। রাসেলের কান্ড দেখে পায়চারি করতে করতে থম ধরে দাঁড়িয়ে পড়লেন গ্রেসকাকু। মুখ দেখে মনে হল হার্ট আ্যটাক হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। কোমরে হাত দিয়ে রোষ কষায়িত চোখে রাসেলের উদ্দেশে বললেন, অপদার্থ একটা!

গ্রেসকাকু যতই তিরস্কার করুন একানব্বই কেজি ওজনের রাসেলকে কোনও যুক্তিতেই 'অপদার্থ' বলা যায় না।ভর ও ভার দুটোই রাসেলের একটু বেশিই পরিমাণে আছে। তাছাড়া রাসেল আমাদের বোলার, ওর ব্যাটের হাত মোটেই ভালো নয়। আমরা যারা টিমের রেগুলার ব্যাটসমান তারাই তো কেউ আজ ভাল খেলতে পারিনি। আমরা তাড়াতাড়ি আউট হয়ে যাওয়াতেই সবুজ সংঘের এই অবস্থা।

জলপাইগুড়ির 'তরুন তুর্কী' আমাদের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী, সাদা বাংলায় যাকে বলে আর্চ রাইভ্যাল। বেশির ভাগ টুর্নামেন্টের ফাইনালে ওদের সঙ্গেই আমাদের দেখা হয়। আজকের মহীতোষ মুখার্জি মেমোরিয়াল টি টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের ফাইনালেও হয়েছে। তরুণ তু্কী মাত্র একশো ছয় রানে অল আউট হয়ে গিয়েছিল। সবাই ভেবেছিল আমরা সহজেই জিতে যাব। কিন্তু হল উল্টো। একশো তুলতে হুড়মুড় করে আমাদের নয় উইকেট পড়ে গেল। শেষ ওভারে আমাদের ছ'রান লাগে জিততে। তরুণ তুর্কীর ছেলেরা নেতিয়ে পড়েছিল একটা সময়, এখন চাগিয়ে উঠেছে সাংঘাতিকভাবে। গ্রেসকাকু আমাদের টিম ম্যানেজার, ওঁর রাগ এবং উত্তেজনা দুটোই হবার কথা।

ভুলু ব্যাট বগলদাবা করে রওনা দিচ্ছিল। গ্রেসকাকু চলে এলেন ভুলুর কাছে। পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, মাথা ঠান্ডা রাখো, নার্ভাস হয়ো না। বাবু অনেকক্ষণ ব্যাট ধরে সেট হয়ে গেছে। স্ট্রাইক পেলেই একটা রান নিয়ে বাবুকে দিয়ে দাও। ভুলু সুবোধ বালকের মতো ঘাড় কাত করে নেমে পড়ল মাঠে। শেষ ওভার করতে আসার কথা তরুণ তুর্কীর পেসার গার্নারের। ওর আসল নাম বংকু। ন্যাড়া মাথা, ছ'ফিট লম্বা, আবলুশ কালো চেহারা, অবিকল ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস বোলার জোয়েল গার্নারের মতো চেহারা বংকুর। প্রচন্ড জোরে বল করার জন্য এই শহরের ছেলেবুড়ো ওকে গার্নার নামেই চেনে।

গার্নারের আসল নাম যেমন বংকু, ঠিক তেমনি গ্রেসকাকুর আসল নামও অন্য। গিরিজাশংকর-টংকর জাতীয় কী একটা খটমট নাম। কিন্তু এখন ভোটের লোকেরা ছাড়া আর কেউ ওঁর পুরো নাম বলতে পারবে না। আসলে উইলিয়াম গিলবার্ট গ্রেস নামে ইংল্যান্ডের একজন ক্রিকেটার ছিলেন। বল করতেন, কিন্তু ব্যাটের হাত ছিল মারাত্মক। প্রায় একশো বছর আগে ভদ্রলোক মারা যান। ডব্লু জি গ্রেস নামে সারা বিশ্ব চেনে ওঁকে।

ঈষৎ কমে আসা চুল, একমুখ ধুসর দাড়িগোঁফ, ধবধবে ফর্সা চেহারা, পিঙ্গল চোখ, গ্রেসকাকুর চেহারার সঙ্গে সত্যিকারের গ্রেসসাহেবের হুবহু মিল। কবে থেকে গ্রেসকাকুর এই নামকরণ হয়েছে সেটা কেউ বলতে পারে না। কিন্তু গ্রেসকাকুকে যে একবার দেখেছে সে জানে এই ক্রিকেটপ্রেমী মানুষটির এর চাইতে উপযুক্ত নাম আর হয় না। গ্রেসকাকুর তিন কূলে কেউ নেই। থাকার মধ্যে পরিচারক একরামচাচা, যাঁর হাতের রান্না খেলে মরা মানুষও বেঁচে উঠবে, আর ওঁর ছায়াসঙ্গী ক্যাসপার।

নিজে কোনওদিন ক্রিকেট খেলেছেন কিনা জানি না কিন্তু গ্রেসকাকু ক্রিকেট অন্ত প্রাণ। একটু বিশদে বললে, ক্রিকেটের প্রবাদপুরুষ ডব্লু জি গ্রেসের একনিষ্ঠ ভক্ত। বাড়িতে প্রমাণ সাইজের একটা ফোটো বাঁধিয়ে রেখেছেন ওই কিংবদন্তী ক্রিকেটারটির। সারাদিন ক্রিকেট নিয়ে থাকেন, ক্রিকেট নিয়ে ভাবেন, ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। গ্রেসকাকু পশু হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন।কিন্তু অবসর নেবার পর এখন আর কুকুর-বেড়াল-গরু-মোষের চিকিৎসা করেন না। বরং রোজ বিকেলে সবুজ সংঘের প্র্যাকটিসে নিয়মিত হাজির থেকে খেলাধুলোয় আমাদের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন।

গ্রেসকাকুর মেজাজ একটু খিটখিটে কিন্তু মন বড়। আমাদের প্রত্যেকদিন প্র্যাকটিসের পর একরামচাচার রান্না করা উমদা খুশবু নিয়ে চিকেন স্ট্যু আর ফ্রুট স্যালাড আসে ওঁর বাড়ি থেকে। সে জিনিস একবার যে না খেয়েছে সে জানে না সে কী হারিয়েছে জীবনে। ফলে আমরা গ্রেসকাকুকে পারতপক্ষে চটাই না। কিন্তু এখন গ্রেসকাকু চটেছেন আমাদের কান্ড দেখে। চটেছেন কথাটার জোর কম, বলা উচিৎ ছিল, 'রেগে ফায়ার হয়ে গিয়েছেন'। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনছি। আজ একশো ছ' রান তুলতে না পারলে গ্রেসকাকু কী করবেন কে জানে!

গার্নারের একটা বৈশিষ্ট আছে। সাইটস্ক্রিন যত দূরেই থাক না কেন, সেই পর্দায় পিঠ ঘষে নিয়ে বল করতে আসে গার্নার। যদিও দিনের বেলা খেলা হচ্ছে তবুও উদ্যোক্তারা মহীতোষ মুখার্জী টি টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট খেলাচ্ছেন সাদা বলে। সে জন্য সাইটস্ক্রিনের রং করা হয়েছে কালো। তাতে একটা সমস্যা তৈরী হয়েছে। সাধারণ সমস্যা নয়, জটিল সমস্যা। তরুণ তুর্কীর জার্সির রং কুচকুচে কালো। এদিকে গার্নারের গায়ের রংও পুরনো দিনের টেলিফোনের মতো।ফলে গার্নার যখন বল করতে আসে তখন ব্যাট্সম্যানের মাথা গুলিয়ে যায়। কোনটা সাইটস্ক্রীন আর কোনটা বোলার আলাদা করতে পারেনা।তার মধ্যে ওরকম বীভৎস গতির বল। আমি আজ আউট হয়েছি ঠিক ওই কারণে। অন্ধকার ফুঁড়ে কখন যে গার্নার এসে বল ডেলিভারি করল, বল যে কোথায় পীচ করল, কখন যে আমার উইকেট ছিটকে পড়ল, আমি কিছুই ঠাহর করতে পারিনি। আমি আউট হয়ে আসার পর যখন কারণটা বললাম, গ্রেসকাকু আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বলেছিলেন, সিলি এক্সকিউজ দিও না চপল।

এবার খেলার শেষ ওভার। ভয়ংকর গার্নার করতে আসছে বল। আমরা রুদ্ধশ্বাসে দাঁড়িয়ে আছি বাইরে।ওভারের প্রথম বল বাবু পাঠালো কভার বাউন্ডারিতে। বাবু সেট হয়ে যাওয়া ব্যাট্সম্যান, তাই ওরা বুদ্ধি করে বাবুর সময়ের ফিল্ডারকে রেখে দিয়েছিল বাউন্ডারি লাইনে।ফিল্ডার বল উইকেট কিপারের হাতে পাঠাল। ফলে এক রান হল।

দ্বিতীয় বল ভুলুর স্ট্রাইক।কিন্তু ভুলু গার্নারের বল চোখে মনে হয় দেখতেই পেলনা।বল সোজা চলে গেল উইকেট কিপারের হাতে। তৃতীয় বলও দ্বিতীয় বলের অ্যাকশান রিপ্লে হল। দুটো বল ভুলু খেলে ফেলল অথচ কোনও রান হলনা। গ্রেসকাকু খসখস করে একটা সাদা কাগজে কিছু লিখে আমাকে বললেন, জলদি যাও, দিয়ে এসো এটা ভুলুকে।

আমি এক হাতে জলের বোতল অন্য হাতে চিরকুট নিয়ে ছুট দিলাম। ভুলু সেই কাগজটা হাতে নিয়ে বলল, চপ্পল, ন্যাশনাল মেডিক্যালের কম্পাউন্ডারকাকুকে ডাকতে পারবি একবার?
আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, কেন?
গ্রেসকাকু কি লিখেছেন কিছুই বুঝতে পাছিনা। মানুষেরই হোক বা পশুর, আমি আজ অবধি একজন ডাক্তারও দেখলাম না যাঁর হাতের লেখা পড়া যায়।
আমি চিরকুটটা এক ঝলক দেখে বললাম, ওই চিরকুটে গ্রেসকাকু নির্দেশ দিয়েছেন এক রান নিয়ে বাবুকে স্ট্রাইক দিতে। উল্টোপাল্টা চালাবার চেষ্টা করে যদি বল মিস করিস আর ম্যাচটা আমরা হারি তাহলে কিন্তু খুনখারাপি হয়ে যাবে।
ভুলু সরলমুখে মাথা নেড়ে বলল, আর উল্টোপাল্টা ব্যাট চালব না। সোজা ব্যাটে খেলে এক রান নিয়ে বাবুকে স্ট্রাইক দেব।
আমি ছুট দিয়ে পালিয়ে এলাম প্যাভিলিয়ানে। গ্রেসকাকু আমার দিকে সপ্র্রশ্ন মুখে তাকালেন। আমি ঘাড় নেড়ে ইশারায় বললাম, সব ঠিক আছে।

কথায় বলে 'প্রমিসেস আর মেন্ট টু বি ব্রোকেন'। ভুলুর ক্ষেত্রেও হল তাই। গার্নারের ওভারের চতুর্থ আর পঞ্চম বল ভুলু সিঙ্গল নেবার চেষ্টাই করল না। আবার অন্ধের মত ব্যাট চালাল। বল ব্যাটের ধারেকাছ দিয়েই গেল না। উইকেটকিপারের হাত থেকে ফেরত গেল গার্নারের কাছে। এখন শেষ বলে আমাদের পাঁচ রান লাগে।

গ্রেসকাকু মাঠের মধ্যেই চোখ উল্টে শুয়ে পড়লেন। আমরা গ্রেসকাকুকে ঘিরে দাঁড়ালাম। পিন্টু খবরের কাগজ দিয়ে হাওয়া করতে লাগল। ক্যাসপার ঘাবড়ে গিয়ে গ্রেসকাকুর দাড়িগোঁফ শুঁকতে লাগল। সম্ভবত তাতে বিরক্ত হয়ে উঠে বসলনে গ্রেসকাকু। পিন্টু রেগে গিয়ে বলল, আজ ভুলু ফিরুক মাঠ থেকে। দেখাচ্ছি ব্যাটাকে। আজ ওর একদিন কি আমাদের একদিন।

গার্নারের শেশ বোলে আমরা জানতাম বাকি চারটে বলে যা হয়েছে সেটাই হবে। আর আমাদের জেতার আশা নেই। ভগবানও সবুজ সঙ্ঘকে আজ জেতাতে পারবেন না। ভুলু সেই একই ভাবে দু'চোখ বুঁজে ব্যাট চালিয়েছিল। কিন্তু এবার ভুলুর ব্যাটের ঠিক মাঝখানে বল লেগেছে। ব্যাটের মাঝখানে বল লাগলে একটা মিঠে শব্দ হয়। সেই আওয়াজটা শুনতে পাওয়া গেল। বল উড়তে উড়তে গিয়ে পড়ল ডিপ মিড উইকেট বাউন্ডারির বাইরে। বিশাল ছক্কা!

নন স্ট্রাইকার এন্ড ঠেকে বাবু এসে জড়িয়ে ধরেছে ভুলুকে। ভুলু ব্যাট ছুঁড়ে ফেলে দিল খুশিতে। আমি, পিন্টু, সিন্টু, রাসেল ছুট দিলাম মাঠে। ভুলুকে কাঁধে তুলে নিয়ে রাসেল চিৎকার করে উঠল খুশিতে।

হই হই করে ভুলুকে নিয়ে প্যাভিলিয়নে ঢুকতেই আমাদের মুখের হাসি শুকিয়ে গেল। গ্রেসকাকু পুরনো দিনের বাংলা ছবির ছবি বিশ্বাসের মতো গম্ভীর মুখ করে দাঁড়ানো। পায়ের কাছে ল্যাজ গুটিয়ে বসে আমাদের দেখছে ক্যাসপার। ভুকুলে দেখে হিমশীতল গলায় গ্রেসকাকু বললে, তুমি আমার নির্দেশ মানলে না কেন?

ভুলু আমতা আমতা করছে। হাওয়া গরম দেখে রাসেল, পিন্টু, সিন্টি, বাবুরা সব কেটে পড়ল এদিকে ওদিকে। আমি ভুলুর পক্ষ নিয়ে বললাম, কিন্তু গ্রেসকাকু, আমরা তো ভুলুর জন্য শেষ অবধি জিতেছি ম্যাচটা। চ্যাম্পিয়নও হয়েছি। এবারের মতো ওকে ক্ষমা করে দিন।

গ্রেসকাকু বললেন, আমি টিমের কোচ। ভুলু আমার লিখির নির্দেশ মানেনি। ওকে ক্ষমা করার প্রশ্নই নেই।

উদ্যোক্তারা মাইকে বার বার আমাদের ডাকছে প্রাইজ নেবার জন্য। আমি ক্যাপ্টেন। কিন্তু গ্রেসকাকু অনুমতি না দিলে যেতে পারছি না। গ্রেসকাকু পাথরের মতো মুখ করে বসে আছেন। এত আঘাত পেয়েছেন সে মনে হচ্ছে কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন। মাথায় হেলমেট, পায়ে প্যাড, হাতে গ্লাভ্‌স্‌- অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছে ভুলু।

টুর্নামেন্ট কমিটির এক কর্তাব্যক্তি এসে আমাকে জোর করে নিয়ে গেলেন মঞ্চে। ছোটখাট এক মন্ত্রী এসেছেন বিশেষ অতিথি হয়ে। তাঁদের হাত থেকে ট্রোফি নিতে গেলাম আমি। বাহান্ন রান করে ম্যান অফ দ্য ম্যাচ পুরষ্কার পেল বাবু। টিমের প্রত্যেককে দেওয়া হল একটা করে সুন্দর মেমেন্টো। ফোটোগ্রাফারের ফ্ল্যাশবাল্‌ব ঝলসে উঠল প্রত্যেকবার। বাবু আমার কানে কানে বলল, আজ লোকাল চ্যানেলের খবরটা মিস করা যাবে না, বুঝলি।

গ্রেসকাকু

মাঠ থেকে প্যাভিলিয়নে ফিরে দেখলাম গ্রেসকাকু বা ভুলু দুজনের কেউই সেখানে নেই।

পিন্টু বলল, কী আশ্চর্য কান্ড, গেল কোথায় দুজনে?
আমরা এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। হঠাৎ বাবু আঙুল উঁচিয়ে বলল, ওই দ্যাখ।

মফস্‌সল শহরে শীত একটু বেশিই পড়ে। এবারও পড়েছে। শেষ বিকেলের হালকা কুয়াশা ফিনফিনে সাদা মশারির মতো বিছিয়ে আছে মাঠের মধ্যে। সূর্য ডুবে গেলেও আবছা একটা গোলাপি আলো রয়ে গেছে এখনও। তার মধ্যেই দেখলাম তিনটে অস্পষ্ট অবয়ব মাঠের মধ্যিখানে।

গ্রেসকাকু আর ভুলু পাশাপাশি দাঁড়ানো। ভুলুর মাথায় হেলমেট। পায়ে প্যাড। হাতে গ্লাভ্‌স্‌ । গ্রেসকাকুর পায়ের কাছে বিরাট একটা কালো বেলুনের মতো গুটিসুটি মেরে বসে আছে ক্যাসপার। গ্রেসকাকু ভুলুকে ধমক দিয়ে বলছেন, ডিফেন্স করতে গিয়ে তোমার প্যাড আর ব্যাটে গ্যাপ থেকে যাচ্ছে। সেই ফাঁক দিয়ে ক্রিকেট বল তো দূর ডবল ডেকার বাস অবধি গলে যাবে। এক হাজার বার এই ডিফেন্স করাটা মকশো করো।

ভুলু কাল্পনিক বোলারের বল খেলার জন্য ব্যাট ক্রিজে ঠুকে ঠুকে স্টান্স নিচ্ছে। বাঁ পা ধপ করে সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে ব্যাট আনছে পায়ের পাশে। আবার ফিরে যাচ্ছে আগের স্টান্সে।

গ্রেসকাকু খেঁকিয়ে উঠে বললেন, তুমি যেটা করছ সেটা টিউব ওয়েল পাম্প করা হচ্ছে। আমি সেটা করতে বলিনি। বলেছি ব্যাটিং-এর শ্যাডো করতে। ডিফেন্স করার সময় মাথা আরও নিচু হবে। কনুই থাকবে বোলারের দিকে। পা আর ব্যাট থাকবে পাশাপাশি।

ভুলু মিনমিন করে বলল, চেষ্টা তো করছি কিন্তু হচ্ছে না কিছুতেই।

পায়ের কাছে কুঁই কুঁই করতে থাকা দানবসদৃশ ক্যাসপারের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে গ্রেসকাকু বল্লেন, আমার গুরু ডব্লু জি গ্রেস যদি তোমার এই শ্যাডো দেখতেন তাহলে তোমাকে কুকুর দিয়ে খাওয়াতেন।

একটুক্ষণ শ্যাডো করে কঁকিয়ে উঠে ভুলু বলল, নাহ কোমর ব্যথা হয়ে গেছে। আর পারছি না।

গ্রেসকাকু বললেন, এই তো হয়ে এসেছে, আর মাত্র সাতশো বিরাশিবার বাকি। তারপর আমাদের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে গ্রেসকাকু কেটে কেটে বললেন, ভুলু টিমের লাস্ট ডাউন ব্যাটস্‌ম্যান। ও যদি এক হাজার বার শ্যাডো করতে পারে তোমাদের উচিত দু'হাজারবার শ্যাডো করা। নাও, শুরু করে দাও।

পিন্টু , সিন্টু, বাবু, রাসেলদের সঙ্গে আমিও সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে কাল্পনিক ব্যাট হাতে নিয়ে ফরোয়ার্ড ডিফেন্স শ্যাডো করতে শুরু করলাম। একটু পরেই টনটন করতে শুরু করল কোমর। পিন্টু গোমড়া মুখে বলল, আর পারছি না। তাছাড়া আমার খুব খিদে পেয়েছে।

আমাদের প্রসন্ন মুখে নিরীক্ষণ করতে করতে গ্রেসকাকু বললেন, একটুক্ষণ খিদেটাকে চেপে রাখো। একরামকে ফোন করে বলে দিয়েছি মাটন কষা আর হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি রান্না করতে। মাঠ থেকে আমার আস্তানা হয়ে খেয়েদেয়ে বাড়ি যাবে সকলে। টুর্নামেন্টের ট্রোফি জেতার সেলিব্রেশনটা ওখানেই হবে।

আমরা শ্যাডো করতে করেই নিজেদের মধ্যে মুখ তাকাতাকি করে নিলাম একবার।তারপর সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলাম, হুররে !


ছবিঃ দীপায়ন সরকার

জলপাইগুড়ির বাসিন্দা মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের স্কুলে পড়ার সময় থেকেই লেখালিখিতে হাতেখড়ি। পেশায় সরকারি চাকুরে মৃগাঙ্ক নিয়মিত বিভিন্ন প্রতিষ্টিত এবং স্বল্প পরিচিত কাগুজে পত্রিকায় এবং ওয়েব ম্যাগাজিনে বড়দের এবং ছোটদের জন্য গল্প এবং ভ্রমণকাহিনী লেখেন। লেখালিখির পাশাপাশি সুযোগ পেলেই ক্রিকেট ব্যাট হাতে মাঠে নেমে পড়েন মৃগাঙ্ক।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা