সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

 

গল্পের এটুকু আমি শুনেছিলাম কুহেলির কাছ থেকে। পেঁচোর বিয়ের পর আমি বলেছিলাম, "এই একফোঁটা মেয়েকে আমি বৌদি বলতে পারব না। নাম ধরে ডাকব।"
"বেশ।" কুহেলি মিচকে হেসে বলেছিল, "তাহলে আমিও তোমাকে তোমার বন্ধু ঐ 'গ' দিয়ে কী যেন বলে, তাই বলে ডাকব।"
"এই না, গবু নয়!" আমি আঁতকে উঠে বলেছিলাম, "আমি সুকান্ত। ওই নামটা শুধু প্‌ – মানে, জ্যোতির্ময়ের এক্সক্লুসিভ।" শেষ অব্দি কুহেলি রাজি হয়ে গিয়েছিল।
তা, সেদিন পেঁচোর ফোনে জরুরী তলব পেয়ে একটু চমকে গিয়েছিলাম। ওরা দুজন কুহেলির মেজোকাকার আমন্ত্রণে খড়্গপুর গিয়েছিল দু-তিন দিনের জন্য। আমাকেও একবার বলেছিল, কিন্তু কাবাব মে হাড্ডি হওয়ার ভয়ে আমি একটা ওজর দেখিয়ে কেটে পড়েছিলাম।
"এক্ষুণি চলে আয়, লোকাল-মেল যা পাস তাই ধরে। এখানে এক গভীর রহস্য তোর জন্য অপেক্ষা করছে।"
"খুলে বলবি তো? আমার এখন অনেক কাজ।" ভাও নেবার চেষ্টা করেছিলাম।
"এলেই জানতে পারবি। হাওড়ায় ট্রেনে উঠে ফোন করে দিস, স্টেশনে আমি থাকব। মাঝের ওভারব্রিজটা ধরে বাঁদিকে বেরোবি, তারপর মোবাইল তো রইলই।"
তা, সত্যিই কোনও পেঁচোমি না করে পেঁচো স্টেশনে আমাকে রিসিভ করেছিল। কাকা গাড়ি পাঠিয়েছিলেন, তাতেই আমি বেলা পড়ার আগে তাঁর খড়্গপুর উপকণ্ঠের বাড়ি 'মায়াপুরী'তে হাজির হলাম। আমাকে চা-জলখাবার খেয়ে একটু সেটল করতে দেওয়ার পর শুরু হল মেজোকাকার 'ট্রেজার হান্ট।'

পেঁচোর গুপ্তধন সন্ধান


"ঐ আলমারির লকারে একটা নীল ব্যাগ আছে। বের করে আমায় দেবে?" কাকা পেঁচোকে বললেন।
পেঁচো উঠে আলমারিটা খুলে তারপর বলল, "লকারটা লক করা। চাবিটা –"
"চাবি নয়, কম্বিনেশন লক। খুলে ফ্যালো।"
"কম্বিনেশনটা –"
"সেটা মনে থাকলে তো বুড়ি বা সুকান্তকেই বলতে পারতাম। তোমাকে বলেছি, কারণ তুমি ঠিক পারবে।"
"কিছু হিন্ট দেবেন না?"
"দিয়েছি তো।" কাকা ধূর্তচোখে তাকিয়ে বললেন, "বেশ, সময় নাও। তোমরা ফেরার আগে সব ক'টা রহস্যের সমাধান করলেই চলবে। যদি চাও তো দু-একদিন বেশিও থেকে যেতে পারো। তবে মনে রেখো, কম্বিনেশনটা দশবারের বেশি ভুল ট্রাই করলে কিন্তু ওটা পাকাপাকি লক হয়ে যাবে। তখন কোম্পানির লোক না ডেকে আর খোলা যাবে না।"
পেঁচো কিছুক্ষণ ফ্যালফেল করে তাকিয়ে রইল। তারপর তার মুখে ফুটে উঠল এক দৃঢ়তার ছাপ। আমি ওর সাথে উঁকি মেরে দেখলাম, এক ছয় অঙ্কের সংখ্যার কম্বিনেশন। আনতাবড়ি চেষ্টা করলে দশবারের মধ্যে লেগে যাওয়ার চান্স নিতান্তই কম। কিন্তু পেঁচো গম্ভীরভাবে কী যেন ভাবছে। একটু পরে ও ধীরে ধীরে ছ'টা সংখ্যা সেট করে বোতামে চাপ দিল। যা ভেবেছি, লক খুলল না। আর একটু ভেবে ও আবার চেষ্টা করল, এবারেও ব্যর্থ।
পেঁচোর মুখ আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, "হিসেবপত্তর করতে হবে মনে হচ্ছে। দেখি আমার পেনটা – এখানেই তো ছিল, পাচ্ছি না কেন!"
"স্যার, ওখানে পাবেন কী করে? আপনি আপনার ব্যাগ নয়, আমার পার্স হাতড়াচ্ছেন!" কুহেলির কথায় পেঁচোর হুঁশ হল। "স-রি", বলে এবার নিজের ব্যাগ থেকে পেন আর কাগজ বের করে কীসব যেন হিসেবে বসল। একটু পর সে হাসিমুখে লকারের কাছে গিয়ে কম্বিনেশন সেট করল আর কী আশ্চর্য, এবার লকার ঠিক খুলে গেল! হাত ঢুকিয়ে পেঁচো বের করে আনল নীল রঙের একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের ব্যাগ।
আমি আর কুহেলি অবাক, কাকার মুখে তারিফের হাসি। বললেন, "আমি আশ্চর্য হলাম যে –"
"আমি আপনার হিন্টটা ধরতে পেরেছি? খুব সোজা। আপনি বললেন আমাকে ক্লু দিয়েছেন। সেটা হচ্ছে ঐ যে বললেন 'তুমি ঠিক পারবে'! তার মানে আপনি এমন একটা সংখ্যা দিয়ে কম্বিনেশনটা সেট করেছেন যা আমার জানা আর বলা বাহুল্য, আপনারও জানা। ছ অঙ্কে প্রথমেই মনে আসে কোনও তারিখের কথা। আমার-আপনার দুজনের জানা বিশিষ্ট তারিখ কী কী হতে পারে? বড়োজোর আমাদের বিয়ের তারিখ বা কুহেলির জন্মদিন। অথবা সবার জানা কোনও তারিখ, যেমন ছাব্বিশে জানুয়ারি, পনেরোই অগস্ট অথবা ধরুন আজকের তারিখ। দশটা সুযোগ আছে। আমি প্রথমে আজকের তারিখ দিয়ে তারপর আমাদের বিয়ের তারিখ দিয়ে চেষ্টা করলাম, মিলল না। তারপর চেষ্টা করলাম কুহেলির জন্মদিন দিয়ে আর সেটাই লেগে গেল।"
"তোমার বিশ্লেষণ অভ্রান্ত। অবশ্য আমি আশাই করেছিলাম তোমার মতো বুদ্ধিমান ছেলে এটুকু ধরে ফেলবে। কিন্তু আমি অবাক ও খুশি হচ্ছি এই দেখে যে তুমি এই সেদিন বিয়ে করে এর মধ্যে স্ত্রীর জন্মদিন মনে রেখেছ।"
পেঁচো বিনীতভাবে "না না, সে আর এমন কী"-গোছের কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু কুহেলি বাধা দিল, "তাই ভেবেছ? ওর ধড়িবাজি তাহলে তুমি ধরতে পারোনি। তখন পেন খোঁজার অছিলায় ও আমার পার্স ঘেঁটে প্যান কার্ডে আমার জন্মতারিখটা দেখে নিল।"
কাকা একদৃষ্টিতে পেঁচোর মুখের দিকে তাকিয়ে। বুঝলাম না তিনি ওর বুদ্ধির তারিফ করছেন, না সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলিতে প্রতিদ্বন্দ্বীকে মাপছেন।

"আচ্ছা কাকা, এবার –"
চ্যালেঞ্জের হাসি হেসে কাকা বললেন, "এবার তো তোমারই হাতে। ব্যাগটা খুলে দ্যাখো না।"
ব্যাগটার মধ্যে সিঙ্গল একটা চাবি। পেঁচো কাকাকে দিতে যাচ্ছিল, উনি বাধা দিয়ে বললেন, "না না, তোমার কাছে রাখো। ওটাই তোমার পরবর্তী রহস্যের চাবিকাঠি।"
"আবারও – কিছুই বলবেন না?" পেঁচো হতাশ হয়ে বলল। কাকা কিছু না বলে মুচকি হেসে যা জানাবার জানিয়ে দিলেন।
অগত্যা পেঁচো এবার সদলবলে বাড়ি টহল দিতে বেরোল। সমস্ত দরজা আর আলমারি পরীক্ষা করে দেখল। তারপর গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে বলল, "না, এর কোনওটারই নয়।"
"কী করে বুঝলি? অন্তত লাগিয়ে তো দেখবি?"
"দরকার হয় না, দেখেই বোঝা যায়। চাবিটা সাত লিভারের কোনও বড় তালার, মানে প্যাডলকের। আর এই আলমারি আর ল্যাচের লকগুলি আধুনিক, তাদের ধরণই অন্য।"
"আচ্ছা, যদি গুপ্তঘর হয়?" আমি উত্তেজিতভাবে বললাম।
"না সুকান্ত, এ বাড়ি তেমন পুরনো নয়। তৈরি হওয়ার সময় থেকেই আমার যাতায়াত। কোনও সেলার বা গুপ্তঘরের কথা কস্মিনকালেও শুনিনি।" কুহেলি বলল।
"তবু গবু যখন বলছে, একবার দেখা যাক।" বলে পেঁচো এবার দেওয়ালে ঝোলানো একটা ছড়ি নিয়ে বিভিন্ন ঘরের দেওয়াল ও মেঝেতে কিছু বাছাই জায়গায় ঠুকে ঠুকে দেখতে লাগল। তারপর মুচকি হেসে বলল, "আগেই বলেছিলাম, গবুচন্দ্র।"
কাকা এতক্ষণ আমাদের কাজকর্ম দেখছিলেন। এবার বললেন, "লাইফ লাইন লাগবে নাকি, জ্যোতির্ময়?"
পেঁচোর মুখ কঠিন হল। বলল, "না, কাকা। আমাদের টিম যথেষ্ট দক্ষ, ঠিক বের করে ফেলবে।" শুনে কাকা মুচকি হেসে আবার তাঁর বেডরুমে ফিরে গেলেন।

কুহেলি এদিকে গম্ভীরমুখে কী যেন ভাবছে আর বিড়বিড় করছে, "সাত লিভারের তালা – সাত লিভারের তালা –" হঠাৎ সে চেঁচিয়ে উঠল, "য়িপ্পি – বাড়ির পেছন দরজায় বাইরে থেকে অমন একটা তালা লাগানো থাকত।"
"চলো, দেখে আসা যাক।" আমাদের ব্রিগেড আবার চনমনে হয়ে রওনা দিল। দরজা খুলে কুহেলি আমাদের পথ দেখিয়ে বাড়ির পেছন দরজায় নিয়ে গেল। সেখানে সত্যিই ঝুলছে জং ধরা এক পেল্লায় তালা। চাবিটা লাগিয়ে ঘোরাতেই কিন্তু সেটা বাপের সুপুত্তুরের মতো খুলে গেল আর আমরা প্রায় একসঙ্গে 'ইয়ে-এ-এ-' করে উঠলাম।
"কিন্তু এতে এগোলটা কী? আমরা তো কোনও নতুন জায়গায় নয়, সেই বাড়ির মধ্যেই এলাম।"
পেঁচোর কথায় আমাদের উৎসাহ কিছুটা ফিউজ হয়ে গেল। কুহেলি অনিশ্চিত ভঙ্গীতে বলল, "তাহলে এবার মেজকাকে জিগ্যেস করা যাক?"
"যেতে পারে।" পেঁচো হতাশ ভঙ্গীতে বলল, "কিন্তু আমি দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছে উনি বলবেন – 'তারপর' তো ওখানেই আছে। খুঁজে নিতে পারবে, নাকি লাইফ লাইন লাগবে?"
"তাহলে?"
পেঁচো আমার প্রশ্নের উত্তর দিল না। শুধু বাতিল জিনিসপত্র, জঞ্জাল আর আগাছায় ভরা বাড়ির পেছন দিকে দাঁড়িয়ে ম্লানমুখে কী যেন ভেবে চলল।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। একটু পর অন্ধকার হয়ে গেলে ওই ঝোপজঙ্গলে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না। কিন্তু মুস্কিল এই যে তালা লাগিয়ে আবার ওদিক দিয়েই বাড়ি ফিরতে হল।
"কী, ক্লু-টার সমাধান হল?" কাকা মিচকি হেসে জিগ্যেস করলেন।
"আধাআধি হয়েছে বলতে পারেন।" পেঁচো সটকে পড়তে চাইছিল, কাকা তাকে আটকালেন, "আরে, তাতে হয়েছেটা কী? অনেক সময় আছে। আমি শিওর তোমরা এই সমস্যাটা কাল সকালের মধ্যেই ভেদ করতে পারবে। কিন্তু শুধু এই নিয়ে মনমরা হয়ে বসে থেকো না। তোমরা তো আমার কাছে বেড়াতে, ভালোভাবে সময় কাটাতে এসেছ। কোথাও বেরোনো যাক, কী বলো?"
"আজ থাক, মেজকা। সুকান্ত একটু আগেই এল, বোধহয় টায়ার্ড। সন্ধ্যাও হয়ে গেছে। আজ স্রেফ আড্ডা মেরে কাটানো যাক, বরং কাল সকালে বেরনো যাবে।" কুহেলি বলল।
"বেশ। আমি ঘোরার প্ল্যানটা ছকে নিচ্ছি। তবে আপাতত একটু চা-টা'র ব্যবস্থা করা যাক।"

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনীয়ার ও মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী অনিরুদ্ধ সেন কলকাতা-মুম্বইয়ের বিভিন্ন সাময়িকপত্র ও ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক। তাঁর লেখা ও অনুবাদ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, এবং সংকলিত বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা