"ছি ছি, দেশটা কোথায় যাচ্ছে! এই জন্যেই কি শহিদরা প্রাণ দিয়েছিলেন!"
আমরা কিছুক্ষণ নিরুত্তর। তারপর পেঁচো ধীরে ধীরে বলল, "হতাশ হবেন না, কাকা। আমরা বিদেশি শক্তির বুটের তলায় যা ছিলাম তার থেকে অনেকটাই এগিয়েছি। আরও অনেক সমস্যা আছে ঠিকই। কিন্তু সেগুলোর মোকাবিলা করতে করতে আমরা ঠিক এগিয়ে যাব।"
"তোমার মতো ইয়ংম্যানেদের মুখে এসব কথা শুনলে সত্যিই আবার বুকে বল পাই। কিন্তু আমার নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে – বেড়াতে এনে তোমাদের এমন বিপদের মুখে ঠেলে দিলাম! রেল শহর খড়্গপুরে রেলকে ঘিরে অজস্র দুর্নীতি আর তাই নিয়ে দল-উপদলে মারামারি চলেই। তবে ওরা সাধারণত পাবলিককে বিরক্ত করে না। আজ যে কী হল!"
"না না, আপনিই বা কী করে বুঝবেন! সত্যিই আমিও ভাবছি, এত গাড়ি থাকতে আমাদেরটাকেই ওরা টার্গেট করল কেন? বিশেষ করে ওরা যখন বলল আপনাকে চেনে।"
"চেনা মানে কত ছোঁড়াই তো এটা-সেটার চাঁদা নিতে আসে, তাদের কি আর আমি মনে রেখেছি! তবে ঐ, মোটা চাঁদা দিই দেখে ওরা হয়তো মনে রেখেছে।"
"আর মেজকা, তোমার গাড়িটাও তো মান্ধাতার আমলের অ্যাম্বাসাডার। ছিনতাইবাজদের লক্ষ হিসেবেও জুৎসই নয়। তাহলে ওরা কেন আমাদের ওপরই চড়াও হল?"
কুহেলির এ প্রশ্নের জবাব পেলাম, যখন আমরা বাড়িতে পৌঁছলাম। কাকা সবে গাড়ি পার্ক করেছেন, গাড়ির বুট খুলে বেরিয়ে এল একটি বছর পঁচিশের ছেলে। হাবেভাবে, বেশভূষায় মনে হয় ভদ্রঘরের। তবে তার চুল এলোমেলো, অবিন্যস্ত জামাকাপড়ে সামান্য রক্তের দাগ।"
"তুমি কে? ওরা তোমায় খুঁজছিল কেন?" কাকা কঠোর দৃষ্টিতে ছেলেটির দিকে চেয়ে বললেন।
"বলছি। কিন্তু আপনি আমায় এত কষ্ট করে বাড়িতে নিয়ে এলেন, এক কাপ চা-ও অফার করবেন না?"
কাকাবাবু ছেলেটির মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবতে ভাবতে বললেন, "বেশ, চলো।"
সফিকুল অনেকক্ষণ এসে গেছে। তাই চায়ের ব্যবস্থা সহজেই হল। ছেলেটি সবে প্রথম চুমুক দিয়ে একটা আরামসূচক 'আঃ' করেছে, কাকা জিগ্যেস করলেন, "তুমি কি ওদের দলের?"
"হ্যাঁ এবং না।" ছেলেটি মুচকি হেসে বলল, "আমি আসলে নিস্পাপ অপরাধী।"
"তেমনও হয় নাকি?"
"সেইজন্যেই তো ওদের সাথে বনল না। সাবধানেই থাকি, আজ হঠাৎ একা পেয়ে গিয়েছিল। প্রাণ বাঁচাতে দেওয়াল টপকে আই-আই-টিতে ঢুকে পড়ি, জানি ওখানে কড়া সিকিউরিটি আছে দেখে ওরা ঢুকতে সাহস করবে না। তারপর আপনাদের গাড়িটা পার্ক করা আছে দেখে তার বুটে ঢুকে যাই। ওরা আমাকে গাড়ির পাশে দেখে ফেলে। কিন্তু ভেবেছিল গাড়ির ভেতরে ঢুকেছি, তাই আপনাদের ওপর হামলা করেছিল। ভাগ্যিস বুট খুলে দেখেনি।"
"দেখলেও, আমরা চোখের সামনে একটা খুন হতে দিতাম না।" পেঁচো বলে উঠল।
ছেলেটির মুখে এবার কৃতজ্ঞতার হাসি। বলল, "ভিডিওটা আমি মিস করেছি। কিন্তু ভেতরে বসেই যেটুকু অডিও কানে এল, তাতে মনে হয় আপনার এই কথাটা ফাঁকা আস্ফালন নয়। যাক, চা'র জন্য ধন্যবাদ। এবার আসি।"
"চলো, তোমাকে আমি গাড়িতে স্টেশন অবধি ছেড়ে দিয়ে আসি। তুমি সোজা কলকাতা চলে যাও।"
"আপনি আবার কষ্ট করে আসবেন? অবশ্য লিফট পেলে একটু সুবিধে হয়। ঠিক আছে, আপনি আমায় বাস স্ট্যান্ডে ছেড়ে দিন।"
ওরা চলে যাওয়ার পরই পেঁচো আর্তনাদ করে উঠল, "ধাতুর ফলকটা – ওটা কোথায় গেল?"
কোথায় গেল? বললাম, "তোকে প্রফেসর সেনগুপ্তের অফিসে দেখলাম প্যান্টের পকেটে রাখতে। তারপর আর মনে পড়ে?"
"না। কিন্তু এখন ওটা আর নেই। পকেট থেকে যাবে কোথায়?"
যাবে কোথায় – সেটাই কাকা ফিরলে পর আমাদের সবার উত্তেজিত আলোচনার বিষয় হল। মোটামুটি সবার ধারণা, ঐ ছেলেগুলোর সঙ্গে ঝাড়পিটের সময় জিনিসটা পকেট থেকে পড়ে গেছে।
"তবে তোমার প্রফেসর সেনগুপ্তেরও কিন্তু জিনিসটার ওপর নজর ছিল।" কিন্তু-কিন্তু করে বলল কুহেলি।
"উনি কি আমার পকেট থেকে তুলে নিয়েছেন?" পেঁচো রাগতস্বরে বলল।
"আহা, তা কেন? হয়তো অফিসে বা ক্যান্টিনে পড়ে গিয়েছিল। উনি পেয়ে রেখে দিয়েছেন। তুমিও যেমন – অত দরকারি জিনিস কেউ ওভাবে রাখে!"
সাথে সাথে প্রফেসর সেনগুপ্তকে ফোন করা হল। না, উনি অমন কিছু পাননি। তবে কথা দিলেন, পরে পেলে তক্ষুণি জানাবেন। যদি দৈবাৎ গাড়ির ভেতর পড়ে থাকে ভেবে সেখানেও খোঁজা হল – নেই।
"তাহলে তো তোমাদের সমস্যা সমাধান এখানেই থমকে গেল।" দুঃখপ্রকাশ করলেন কাকা।
"মোটেই না! চাকতি রহস্যের সমাধান তো আমি করেই ফেলেছি। তবে দুঃখ হচ্ছে অমন একটা পুরনো দিনের স্মৃতিচিহ্ন হারিয়ে গেল!"
"তুমি তৃতীয় রহস্যেরও সমাধান করে ফেলেছ?"
"আজ্ঞে হ্যাঁ, খুব সহজে। চাকতিটাতে বড়ো করে লেখা ছিল '১৯৩১'। আরও কিছু হয়ত লেখা ছিল, যা সময়ের সাথে অস্পষ্ট হয়ে গেছে। তবে সম্ভবত তার দরকার হবে না। দৈবাৎ যদি হয়ও, অসুবিধে নেই। আমি স্মার্টফোনে চাকতিটার ফটো তুলে নিয়েছি। এবার 'ইমেজ এনহান্স' করে বোঝার চেষ্টা করব, আরও কিছু তথ্য ওতে ছিল কিনা।"
"কিন্তু ঐ ১৯৩১ দেখেই তুমি ক্লু পেয়ে গেলে?"
"পাইনি। কিন্তু আপনার সাথে মিউজিয়ামে গিয়ে পেলাম। হিজলি জেল হত্যাকাণ্ডও ঘটে ১৯৩১ সালে। আপনি সেটা নিজমুখে বলেও দিলেন। এই দুটো নিছক সমাপতন হতে পারে না। অর্থাৎ ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বা ঐ মিউজিয়ামের সঙ্গে পরবর্তী সূত্র জড়িত আছে। এবার কি দয়া করে বলবেন সেটা কী?"
পেঁচোর পিঠ চাপড়ে কাকা বললেন, "বাঃ, তৃতীয় গাঁটটাও তাহলে তুমি পেরিয়েছ।"
"আমি নই, আমরা।" পেঁচো সবিনয়ে শুধরে দিল।
"হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমরা। তাহলে বলছি, পরের ধাপটার ক্লু-ও আমি কিছুটা দিয়ে দিয়েছি। ঘরে গিয়ে বসে ভাবো, বাকিটা পেয়ে যাবে।"
"অর্থাৎ আর কিছু ছাড়বেন না।" পেঁচো হতাশ ভঙ্গীতে বলল, "আগেই বলেছিলাম আপনি খুব –"
"ঘোড়েল? হা-হা-হা, ঠিকই বলেছ। তবে আমার বিশ্বাস জন্মেছে, এ গাঁটটাও তুমি সহজে পেরোবে।"