সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
কোপ্তা – কাবাব

কোপ্তা মাসি আর কাবাব মাসি দুই বোন । দুজনেই ইস্কুলের মাষ্টারনি । বিদ্যাবিনোদ বালিকা বিদ্যালয়ে দুজনেই পড়ান । কোপ্তা মাসি অঙ্ক করান আর কাবাব মাসি সেলাই দিদিমনি ।তাদের দুজনেরই অবশ্য দুটি ভালো ভালো নাম আছে – কাজরী ও মঞ্জরী ।তবে সেসব নাম লেখা আছে ইস্কুলের খাতায় । ডাক নামেই তারা বেশি পরিচিত । এমনকি ছাত্রীরাও সামনে ভাল নামে ডাকলেও আড়ালে কোপ্তা দিদিমনি আর কাবাব দিদিমনি নামেই ডাকে । কিন্তু দুজনে বোন হলে কী হবে , দুজনের হাবভাব ,চেহারা একেবারে দুরকম ।কোপ্তা মাসির মোটা থপথপে, বেঁটে চেহারা ,রঙ কালো , মাথায় বড়ি খোঁপা , চোখ গুলো গোল গোল ,গলার আওয়াজ কর্কশ , হেঁড়ে । আবার কাবাব মাসির রোগা ঢ্যাঙা , সিরিঙে চেহারা, ফ্যাটফ্যাটে ফর্সা গায়ের রঙ আর মাথায় গোবর তালের মত খোঁপা ।তাতে গোঁজা থাকে উলের কাঁটা , কুরুশ কাঠি কিংবা কয়েকখানা ছুঁচ । কোপ্তা মাসি বেজায় জাঁদরেল আর ডাকাবুকো । দুনিয়ার কোন কিছুকেই তোয়াক্কা করেননা ।আরশোলা থেকে পুলিশ – কোন কিছুকেই ভয় পান না । কাবাব মাসি আবার উলটো । তার ভূত , অন্ধকার , আরশোলা , ঝড় বিদ্যুৎ ,খালি ঘর কিসে যে ভয় নেই । দুজনের একদিকে যেমন গলায় গলায় ভাব , একসঙ্গে খাবেন , একসঙ্গে থাকবে্ন , এক বিছানায় ঘুমোবেন , একসঙ্গে ইস্কুল যাবে্ন , অন্যদিকে আবার মাথা ঠোকাঠুকি ঝগড়া । মাঝে মাঝে ইস্কুলেও ছাত্রীদের সামনে দুজনের ঝগড়া লেগে যায়।

হয়তো ইস্কুলের দোতলার লম্বা বারান্দার এক প্রান্তের ক্লাস এইটের ঘরে কোপ্তা মাসি অঙ্কের ক্লাস নিচ্ছেন , অন্য প্রান্তে ক্লাস সিক্সের ঘরে কাবাব মাসি সেলাই শেখাচ্ছেন। অঙ্ক করাতে করাতে কোপ্তা মাসি মেয়েদের ওপর এমন হুঙ্কার ছাড়লেন যে গোটা বারান্দার গা ঘেসে প্রত্যেকটা ক্লাসরুমের মেয়েরা চমকে উঠলো আর অন্য প্রান্তের ক্লাস সিক্সের রুমের যে মেয়েটি অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে কাপড়ের ওপর ছুঁচের ফোঁড় তুলছিল , সে এতই চমকে উঠল যে ছুঁচটা প্যাট করে ফুটে গেল তার আঙ্গুলে। দু তিন ফোঁটা রক্তও বেরিয়ে এল । ব্যাস সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল চ্যাঁ ভ্যা , হৈ চৈ। কাবাব মাসি মহা বিরক্ত হয়ে মস্ত এক কাঁচি নিয়ে তেড়ে গেলেন ক্লাস এইটের সামনে – ' হ্যাঁরে কোপ্তা , ভেবেছিস কী? তোর জ্বালায় শান্তিতে কোন কাজ করা যাবেনা ?'চেঁচামেচি শুনে কোপ্তা মাসি এক হাতে চক আর অন্য হাতে ডাস্টার নিয়ে বেরিয়ে এলেন ক্লাস থেকে । এসেই হাঁড়ি ফাটা গলায় হেঁকে উঠলেন –'বলি হয়েছেটা কী ? হ্যাঁরে কাবাব আমি তোর কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি যে তুই অমন তেড়ে এসেছিস ? তাও তো মেয়েদের শেখাস সেলাই , আমার মত যদি অঙ্ক করাতিস তবে বুঝতুম ।'

ব্যাস , লেগে গেল ধুন্ধুমার কাণ্ড । ওদিকে দুই বোনের ঝগড়া বাগযুদ্ধ ছাড়িয়ে পৌঁছেছে হাতাহাতি পর্বে ।ব্যাপার দেখে স্কুলের দারোয়ান হাঁদু ঢং ঢং করে বাজিয়ে দিয়েছে ছুটির ঘন্টা । ততক্ষণে কাবাব মাসি মস্ত বড় কাঁচিটা দিয়ে কোপ্তা মাসির বড়ি খোঁপাটাকে দিয়েছেন উড়িয়ে । আর কাবাব মাসি হাতের ডাস্টার দিয়ে এমন জোরে কোপ্তা মাসির কপালে মেরেছেন যে সেখানে তৎক্ষণাৎ একটি চকচকে আলু গজিয়ে গেছে । যাই হোক শেষ পর্যন্ত ইস্কুলের বড় দিদিমনি হাঁদুকে দিয়ে রিক্সা ডাকিয়ে যুধ্যমান দুই বোনকে চাপিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন ।

পরদিন অবশ্য দেখা গেল দুই বোন একজন খোঁপা হীন মাথায় রুমাল বেঁধে, অন্যজন কপালে নীল কালশিটে সহ গদগদ ভাবে ,হাসি হাসি মুখে ইস্কুলে আসছেন । এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে বলে অন্য দিদিমনিরা আর গা করেননা । এ বিষয়ে তাঁরাও কিছু বলাও ছেড়ে দিয়েছেন ।

ঠাকুরদার আমলের মস্ত ছড়ান ছিটানো বাড়িটায় এঁরা দুই বোনেই থাকেন । এঁরা ছাড়াও এ বাড়িটায় থাকে গোটা পাঁচেক পাড়া খেদানো বেড়াল , দুটো ঘেয়ো নেড়ি কুকুর । যদিও তাদের যে খুব আদরে রাখেন বোনেরা তা নয় । তবে বাড়িতে প্রচুর জায়গা রয়েছে বলেই তারা থেকে যায় । আর আছে এক গুচ্ছ আরশোলা আর টিকটিকি । রান্নাঘরে কৌটো নাড়াচাড়া করতে গেলে মাঝে মধ্যেই আরশোলারা শুঁড় উঁচিয়ে ঘাড়ের ওপর ফড়ফড় করে পড়ে । তাতে কাবাব মাসি চেঁচিয়ে অস্থির হন । কোপ্তা মাসি ধারে কাছে থাকলে ছুটে এসে , মুড়ো ঝ্যাঁটা দিয়ে ঝপাং ঝপাং করে আরশোলা খেদান । আর কাবাব মাসির উদ্দেশ্যে বকাবকির ঝড় তোলেন । -' মর মর , পোড়ারমুখো আরশোলার দল । আর তোকেও বলিহারি যাই কাবাব ,তুই কি কচি মেয়ে যে আরশোলা ঘাড়ে এসে পড়্‌ল, আর তুই চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করছিস ।'কিন্তু এসবের উত্তর কে দেবে , কারণ কাবাব মাসি ততক্ষণে চেঁচামেচির পালা শেষ করে দাঁত ছিরকুটে ভির্মি খেয়েছেন ।

অগত্যা কোপ্তা মাসিকেই বকবক করতে করতে হাতের ঝ্যাঁটা ছুঁড়ে ফেলে স্মেলিং সল্টের শিশি এনে কাবাব মাসির নাকে শোঁকাতে হয় ।

এভাবেই চলে দু বোনের ঘর সংসার । তবে পাড়া প্রতিবেশীরা এদের বেশি ঘাঁটায় না ।কারণ ঝগড়া শুরু করলে দু বোনের কেউই কম যায়না।

আর কোপ্তা মাসিকে তো পাড়া সুদ্ধ লোকে বেশ ভয়ই পায় । কোপ্তা মাসিও বীর দর্পে বুক ঠুকে বেড়ায়-'হুঃ,আমাকে ভয় দেখাবার মত জিনিস এখনও জন্মায়নি।' কিন্তু কথায় বলে 'অতি দর্পে হত লঙ্কা ।' ফলে অঘটন ঘটল একদিন ।

সেদিন ভারি খুশি মনে দুই বোন ইস্কুল থেকে বাড়ি ফিরেছেন । সেদিন তাদের দুজনে বেশ ভাব । ঝগড়াঝাঁটির কোনও সম্ভাবনা নেই । দুজনে বাড়ি ফিরে গরম গরম ভাত এক থালায় ঘি দিয়ে মেখে আরাম করে খেয়েছে্ন । খাওয়ার পর চওড়া বিছানায় ,টানটান করে পাতা চাদরের উপরে শুয়ে দুজনে বেশ গড়াগড়ি দিয়েছেন । দুজনের চোখে একটু ভাতঘুম লেগেও এসেছিল । একজনের ঘড়র ঘড়াৎকরে ভারি নাক ডাকার শব্দ ,অন্যজনের ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ নিঃশ্বাসের শব্দও শোনা গেল । তারপর অবশ্য ঘণ্টাখানেক বাদে দুজনেই ঘুম থেকে উঠে পড়লেন । শীতের বেলা বেশি ঘুমনো ঠিক নয় , গা ম্যাজ ম্যাজ করবে । ঘুম থেকে উঠে কোপ্তা মাসি বললেন – 'দাঁড়া কাবাব একটু কফি করি । তুইও খাবি তো ?'

কাবাব মাসি আড়মোড়া ভেঙে বললেন – ' কর । তবে আমারটায় একটু দুধ চিনি বেশি দিস ।'

কোপ্তা মাসি রান্নাঘরে ঢুকে জলচৌকির ওপর দাঁড়িয়ে একটা উঁচু তাক থেকে দুটো কফি মাগ নামালেন । নামাতে গিয়ে মনে হল কী যেন একটা লাফিয়ে পড়ল । গায়েই পড়ল যেন । কী আবার হবে ; নিশ্চয় আরশোলা । ওঃ, রান্নাঘরের এরা স্থায়ী বাসিন্দা । বিরক্ত হয়ে গায়ের গরম চাদরের ওপরেই হাত দিয়ে ঝেড়ে নিলেন । কে জানে চোখে তো কিছু পড়ল না । সে যাকগে , কফিটা খুব মনোযোগ সহকারে বানালেন কোপ্তা মাসি । তারপর একটা ট্রেতে বড় বড় মাগ দুটো বসিয়ে নিয়ে এসে খাবার ঘরের টেবিলের ওপর রাখলেন ।কাবাব মাসি ততক্ষণে উল কাঁটা , ডিজাইনের বই সব কিছু নিয়ে টেবিলের এক ধারে চেয়ার টেনে বসেছেন । টেবিলের অন্য ধারে কোপ্তা মাসিও চেয়ার টেনে বসলেন প্রচুর অঙ্ক খাতা সহ । দুই বোন গভীর মনোযোগের সঙ্গে যে যার কাজ করছে্ন আর মাঝে মাঝে কফির মাগে চুমুক দিচ্ছেন । দুজনের মুখেই বেশ তৃপ্তির ছাপ । কাবাব মাসি নতুন একটা প্যাটার্ন বুনে তুলবার চেষ্টা করছে্ন । আর কোপ্তা মাসি অঙ্ক খাতা খুলে কখনো 'রাইট' চিহ্ন দিচ্ছে্ন কখনো বা ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে কাটছেন । বেশ সুন্দর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ।

হঠাৎ কোপ্তা মাসি কেমন খচমচ করে উঠলেন । কাবাব মাসি চোখ তুলে বললেন –'কী হল ?'
'কী জানি । আমার ঘাড়ের কাছে কী যেন নড়ল ?'
কাবাব মাসি আঁতকে উঠে বললেন –' সে কী ?'
কোপ্তা মাসি গম্ভীর ভাবে বললেন –' চুপ কর । মনে হয় কিছু নয় ।'

কোপ্তা – কাবাব

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ । দুই বোন যে যার কাজে মনোযোগী । কিন্তু আবার কোপ্তা মাসি খচমচিয়ে উঠলেন । কাবাব মাসি এবারে বললেন –' তুই চাদরটা খুলে দেখনা ।' কোপ্তা মাসি চাদরটা সরিয়ে ঘাড়ের কাছে হাত দিয়ে কিছু একটা শক্ত করে ধরলেন । তারপর হিষ্টিরিয়া রোগীর মত গাঁক গাঁক করে আর্ত চিৎকার ।

'আরে হলটা কী ?'— বলতে বলতে কাবাব মাসি উলের কাঁটা থেকে চোখ তোলেন । তাকিয়ে দেখে্ন এক অভাবিত কাণ্ড । কোপ্তা মাসির মোটা দেহটা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন । ডান হাতটা তুলে মুঠো করে ধরে আছে এক কালো কুচকুচে , হৃষ্টপুষ্ট , গা ঘিনঘিনে টিকটিকি । আর সেই সঙ্গে তীব্র আ –আ ডাক ছেড়ে প্রাণপণে চেঁচিয়ে যাচ্ছে্ন কোপ্তামাসি ।

কাবাব মাসি প্রথমে হতভম্ব । কারণ কোপ্তা মাসিকে জীবনে প্রথম কোন কিছুকে ভয় পেতে দেখলেন । প্রথমে ভাবলেন তিনিও গলা মিলিয়ে খানিকটা চেঁচিয়ে নেবেন । কিন্তু কেন জানিনা ঐ 'আ আ' শব্দের সঙ্গে গলা না মিলিয়ে তিনি শক্ত ভাবে বললেন –'চেঁচাস না কোপ্তা ,ওটা ছুড়ে ফেলে দে ।' কোপ্তা মাসির চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি বাংলা কথাও বুঝতে পারছেন না । গোটা শরীরটাকে শক্ত করে হাতের মুঠোয় ওই সরীসৃপটাকে ধরে চিৎকার করা ছাড়া তিনি যেন আর কিছু জানেননা । কাবাব মাসি আর গলা তুলে বললেন –'থাম ,থাম তুই , একদম চেঁচাবি না ।ছুঁড়ে ফেল , ছুঁড়ে ফেল ।'

উত্তরে একটাই আওয়াজ – আ –আ –আ ।
--' উঃ কোপ্তা ,এভাবে চিল্লালে লোকে কী ভাববে ? ভাববে বাড়িতে ডাকাত পড়েছে । তোকে ধরে মারছে ।'
-- 'আ –আ –আ ।'

এবারে কাবাব মাসি ঠাস করে সজোরে এক চড় বসিয়ে দেন কোপ্তা মাসির গালে। সঙ্গে সঙ্গে হাতের মুঠো আলগা হয়ে চিপকে থাকা নিঘিন্নে প্রাণীটা ছিটকে গিয়ে থ্যাপ করে লাগে উল্টো দিকের দেওয়ালে। কোপ্তা মাসির ততক্ষণে চোখ উলটে গেছে ,সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে । কাবাব মাসি এই প্রথম খুঁজে বেড়াচ্ছে্ন স্মেলিং সল্টের শিশিটা । কারণ ওটার খোঁজ একমাত্র কোপ্তা মাসিই জানেন । দিনরাত কাবাব মাসিকেই তো শোঁকাবার দরকার হয়।

 

ছবিঃ নভনীল দে

সাথী সেনগুপ্ত কলকাতার একটি প্রসিদ্ধ শিক্ষায়তনের সাথে যুক্ত। মানুষ গড়ার কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছোটদের জন্য লিখতে ভালবাসেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা