সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
যন্ত্রের জঙ্গলে

বাবলা স্কুল থেকে ফিরে লাটাই - ঘুড়ি হাতে দৌড় দিল দক্ষিণের মাঠে । অমনি কালুয়াও ওকে অনুসরণ করতে থাকল । সবুজ আলবাঁধ ধরে এগিয়ে হোগলা জঙ্গলের পাশ দিয়ে, বড় ঝিলের পাড় টপকে অবশেষে ওরা মাঠে পৌঁছল । মাঠ তখন জম জমাট । ছোট বড় সবাই খেলায় মত্ত । চিৎকার চেঁচামেচিতে মাঠ ভরে আছে । বাবলা মাঠের ওপারে গিয়ে ঘুড়ি লাটাই গোছাতে শুরু করে । তারপর হাত তুলে কালুয়াকে কী যেন বলল শোনা যাচ্ছে না । তবুও কালুয়া বোঝার ভান করে লেজ নেড়ে বলল - "আমি এখানে বসে আছি - ভউ - উ ।" বাবলা তখন ঘুড়ি ওড়াতে মেতে গেল ।

পশ্চিমে বিরাট কালো জলের ঝিল পেরিয়ে সাদা কাশ ফুলে ঢাকা রেললাইন । আর মাথার উপর টানটান পিলারে বাঁধা তারগুলো গাছ-ঘাছালি, ঘর-বাড়ি ও আকাশকে আলাদা করে ধরে রেখেছে । তক্ষুণি ভিনদেশী কোন এক লালচে রং-এর ট্রেন তীর বেগে 'ঘ্যাট - ঘ্যাট' - 'ভোঁ - ভোঁ' শব্দ করে দৌড়ে গেল দক্ষিণের কোন এক অজানা দেশে । পুবে তাল নারকেলে ঘেরা ধুসর রং-এর বাবলাদের গ্রাম । আর উত্তর থেকে দক্ষিণে মাঝের মাঠ বরাবর সারিসারি চিমনি ওঠা কারখানা । চিমনিগুলো ধূসর - কালো ধোঁয়া উগরে দিয়ে ওদিকের আকাশটাকে ধোঁয়ায় ধোঁয়াময় করে রেখেছে । সঙ্গে বাতাসে পোড়া পোড়া বিদ্ঘুটে গন্ধ বয়ে আনে এদিকটায় ।

কালুয়া মাঠের এই প্রান্তে বসে চারদিকটা আনমনে সব দেখছিল আর কত শত ভাবনা ভেবেই চলেছে একে একে । ও জানে এই মাঠ ছাড়িয়ে উত্তরের ওই কারখানার জঙ্গলে কোথায় যেন ওদের ধূসর - কমলা রং-এর টালির ছাউনি মাটির বাড়ি ছিল । সামনে একটা কলা বাগানে ঘেরা পুকুর ছিল । কলমী আর হিঙচে শাকে ঢাকা পাড়ে হাল্কা বাদামী - ধূসর কুঁজো বকটা বসে থাকতো একমনে । কখন একটা চুনো পুঁটি ভেসে উঠবে অমনি বকটা ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠুকরে ওটাকে পেটে চালান করবে । বাবলা তখন আরো ছোট ছিল । খুব দুষ্টু ছিল । একদিন বাবলা চ্যাপ্টা টালির টুকরো জলে ছুঁড়ে ব্যাঙ নাচন করতে থাকল । টুকরোটা ঘুরে ঘুরে জলে লাফাতে লাফাতে উল্টো পাড়ের দিকে ধেয়ে গেল । আর কুঁজো বকটার ধ্যান ভঙ্গ হল । 'ট্যারর - ট্যারর' শব্দ করে পুবের আকাশে পাড়ি দিল । কালুয়াও অমনি বাবলাকে উৎসাহিত করতে দু'পা তুলে লাফিয়ে - "ভৌ - ভৌ" করে আওয়াজ করল । অমনি বাবলা এসে কালুয়ার পিঠে চড়ে বসে কান দুটো টেনে আদর করতে থাকল । কালুয়া আদরের সুরে আবার ডেকে উঠল - "ভো - ভোউ - ভৌ ..."  কোথায় যেন হারিয়ে গেল ওদের সেই বাড়িটা । ওরা চলে গেল পুবের গ্রামে । আর হারিয়ে যাওয়া বাড়ির জায়গায় এখন বুঝি সার সার কারখানার জঙ্গল ! কালুয়ার খুব ইচ্ছে করে সেই জায়গাটা দেখতে । এখন কেমন চেহারা কে জানে ! আনমনে কখন যেন কালুয়া মাঠ ছেড়ে উত্তরের কারখানাগুলোর দিকে এগতে থাকে ।

চারদিকে উঁচু উঁচু কংক্রিটের ঘেরা পাঁচিল । এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত উঁচু উঁচু অ্যাসবেস্টাসে ঢাকা কারখানার সারি । আর আকাশ ছোঁয়া বড় বড় লম্বা চিমনি । কালো পিচের রাস্তায় ঢাউস ট্রাক আসছে আবার কোনটা ফিরে যাচ্ছে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে । এখানে চারিদিক ধোঁয়ার কুয়াশায় ঢাকা । এই কুয়াশার মধ্যে কখন যে এই যন্ত্র দানবগুলো ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়বে, সেই ভয়ে কালুয়া সরে দাঁড়ায় রাস্তার ধারে । তক্ষুণি একটা ট্যাঙ্কার লাফিয়ে দাপিয়ে 'ঘ্যাড়র - ঘ্যাড়র', 'ঘ্যাটর - ঘ্যাটর', 'ঘটাং - ঘটাং' হাজারো কান ঝালাপালা শব্দ করতে করতে পাশ দিয়ে চলে যায় । এখানে এখন নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে ভীষণ । দৌড়ে এগোতে থাকে সে । যদি একটু স্বস্তি বোধ করা যায় । কিন্তু কোথায় কী, একই অবস্থা সব জায়গায় । সামনে একটা বাঁক নিতেই দেখা গেল বড় লোহার গেট । এগিয়ে গিয়ে দেখা গেল গেটের বাঁদিকে ছোট্ট ঘুপচি ঘরে দরজা হাট করে খোলা । কালুয়া নিশব্দে দরজা দিয়ে উঁকি দিল । ভেতরে তখন যেন দক্ষ জজ্ঞ চলছে । উঁচু মতো লোহার মাচায় রাখা বিশাল কালো ট্যাঙ্ক থেকে গন্‌ গনে লালচে তরল গড়িয়ে পড়ছে নিচের চোঙের মাতো একটা বড় মেশিনে । তার নিচে কতগুলো ঢাউস মেশিন ক্যাঁচ ম্যাচ শব্দ করে ওঠা নামা করছে আর সার সার সরু সরু গন্‌গনে লাল লহার রড বেরিয়ে আসছে , তারপর সামনের জলের চৌবাচ্চায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে । সঙ্গে সঙ্গে সাদা ধোঁয়ার মধ্যে 'চোঁ - চোঁ' শব্দ ভরে যাচ্ছে চারদিক । হটাৎ "হেই - হুট্‌", "দূর - হ - বের - হ", "বের - হ, বের - হ" বলে একটা লোক তেড়ে এলো । অগত্যা কালুয়া দৌড় দিল আরো উত্তরে ।

এদিকটায় একটু ফাঁকা  ফাঁকা । সামনে বড়সড় খোলা চত্বর । কালুয়া ভাবলো এখানে একটু জিরিয়ে নেবে । সামনে পা ফেলতে গিয়েও থেমে গেল । চারদিকে হলদেটে থক্‌ থকে আস্তরণে ভরে আছে । ভীষণ ঝাঁঝালো গন্ধে মাথা ধরে যায় । নাক ঝাঁ ঝাঁ করছে । আর একমূহুর্ত এখানে থাকা যাবে না । আবার দৌড় ।

 রাস্তার ধার ঘেঁষে উটে গেছে উঁচু দেওয়াল । এখানে এখন যেন একটু নিঃশব্দ মতো । একটু নিশ্চিন্ত হওয়া যায় । একটু এগিয়ে যেতেই দেখা যায় দেওয়ালটা এখান থেকে ঘুরে গেছে আরো উত্তরের দিকে । সামনে একটা উঁচু ঢিবি মতো সিমেন্টের চাতাল । কালুয়া ক্লান্ত হয়ে পায়ে ধীর‌ ওখানে ঊঠে গেল । চারদিক দেখে নিল আশে পাশে কেউ নেই । নিশ্চিন্ত হয়ে গুছিয়ে শুয়ে পড়ল । তারপর চোখ বন্ধ করে ভাবছে কী ধন্ধে পড়ল যে, এবার যাবে কোথায় ! বাড়ি ফিরবে কী করে !  ফেরার রাস্তাও খুঁজে পাচ্ছে না । চারদিকে শুধু যন্ত্র দানবের দঙ্গল সার দিয়ে যেন ওকে ঘিরে ধরেছে । বাড়ির কথা মনে পড়ছে । বাবলার কথাও মনে পড়ছে । কান্না কান্না পাচ্ছে । কী যে করবে ভেবে পাচ্ছে না । তক্ষুণি ভূমিকম্পের মতো মাটি কাঁপিয়ে পাতাল ভেদ করে ভীষণ তীব্র শব্দ - 'ঘ্যাড়র - র - র - ধুম্‌' । কালুয়া ভ্যবাচাকা খেয়ে চাতালের মাটি ছাড়িয়ে লাফিয়ে উঠল । তারপর ভয়ে থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে আছড়ে পড়ল আবার চাতালে । হাত পা কাঁপছে । ভয়ে বুকের ধুকপুক শব্দও যেন শোনা যাচ্ছে । এবার বার বার দেওয়ালের ওপার থেকে শব্দটা হতেই থাকল । পায়ের তলার মাটি কেঁপেই চলেছে । আর এখানে  থাকা যায় না । সুতরাং এখানে আর নয় । কালুয়া চাতাল থেকে এক লাফে নেমে এসে আবার দৌড় দিল ।

তখন বিকেল গড়িয়ে কখন যেন সন্ধ্যে নেমেছে । চারদিকে ধোঁয়ার আস্তরণের মধ্যে হলদেটে আলোর দাপাদাপি শুধু । হঠাৎ যেন খাবারের গন্ধ ভেসে আসছে ! কালুয়া নাক উঁচিয়ে হাওয়া শুঁকতে থাকলো । হ্যাঁ ঠিক, বিস্কুটের গন্ধ ভেসে আসছে । খিদেটা আরো বেড়ে গেল । তবে সামনের কারখানাটা নিশ্চয় বিস্কুটের কারখানা হবে । ভেতরে ঢুকতে পারলে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু খাবার পাওয়া যাবে । ফেলে দেওয়া, নয়তো ভাঙ্গা - গুঁড়ো বিস্কুট নিশ্চয় কোথাও না কোথাও পাওয়া যাবে । পায়ে পায়ে কালুয়া সামনের দিকে এগিয়ে গেল । একটা বড়সড় ফ্যাকাসে লোহার গেট দেখা গেল । যেই না সে গেটের সামনে দাঁড়িয়েছে ওটা খুলে গেল । অমনি বিশাল আকৃতির একটা ট্রাক হেলে দুলে এগিয়ে আসছে ওর দিকে ! এই সুযোগ । লাফ্‌ দিয়ে গেটের পাশের ফাঁক দিয়ে সাবধানে ঢুকে পড়ল । ডানদিকে অফিস ঘর । তার পাশ দিয়ে সরু রাস্তা চলে গেছে কারখানার আরো ভিতরে । বিশাল আকৃতির একটা ইটের দেওয়াল ও সবুজ প্লাষ্টিকের ছাউনি ঘেরা লম্বা ঘর । ভেতরে হরেক রকমের যন্ত্রের দাপাদাপি শব্দ ভেসে আসছে । ডাইনে বাঁয়ে জঞ্জালের স্তুপ । একটু এগোতেই দেখা গেল রাস্তার উপরে কালো রং-এর পচা পচা ঝাঁঝালো তরল চুঁইয়ে ছড়িয়ে পড়ছে । কোথায় বিস্কুট ! কোথায় খাবার ! এতো একেবারে নরক গুলজার । সামনে যাওয়ার রাস্তাও বন্ধ । এখান কী করা যায় । কালুয়া পেছন ফিরেছে, চেয়ে দেখে নিল উর্দি পরা লাঠি হাতে এক দরোয়ান দাঁড়িয়ে । নিমেষে গেটের দিকে দৌড় দিল কালুয়া । পেছনে লোকটা তেড়ে আসছে দানবের মতো । বন্ধ গেটের কাছে এসে কাঁদো কাঁদো ভাবে অনুরোধ করে কালুয়া --- "কুঁই - কুঁই - কক্ষনো আসবো না এখানে - ভুল হয়ে গেছে । গেটটা খুলে দাও - কুঁই - কুঁই ..." অফিস ঘর থেকে কেউ যেন বলল - "হেই শিগ্‌গির এটাকে বের কর । " অমনি গেটটা একা একা খুলে গেল । ততক্ষণে পেছনের সেই দরোয়ানটা লাঠি দিয়ে কালুয়ার উপর আঘাত করতে যাচ্ছে- তার আগেই এক লাফে ওখান থেকে বেরিয়ে এলো কালুয়া ।

এদিকটায় চাপা চাপা আধো অন্ধকার । চারদিক শুনশান । সোঁদা সোঁদা গন্ধ । পুরানো বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা অন্ধকারে  ঝিমোছে । মর্চে পড়া ভাঙ্গা লোহার গেট দিয়ে ঢুকে পড়ে কালুয়া । লোহা লক্কড়ের ঢাঁই । ঝিঁ ঝিঁ - র ডাক । কী ভুতুড়ে জায়গারে বাবা ! এই বুঝি ওই ঢাঁই করা লোহা - লক্কড়ের জঞ্জাল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘাড় মটকাবে হয়তো কোন ভুত - পেত্নী ! গা ছম্‌ ছম্‌ করছে, তবুও ভালো ওই দরোয়ানে মার খাওয়ার থেকে ভালো । নিরাপদ আশ্রয় । গেটের পাশের ফাঁকা ঘরটাতে উঁকি দিয়ে দেখা গেল কিছু  বাক্স প্যাঁটরা আর ছেঁড়া চট দলা পাকিয়ে পড়ে আছে এক কোণে । চারদিক ভালো করে দেখে নিয়ে বাতাসে গন্ধ শুঁকে সে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ । আশে পাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না । নিশব্দে ঘরে ঢুকে আবার বেরিয়ে এসে চারদিকটা দেখে নেয় । কেউ কোত্থাও নেই । নিশব্দে আবার ভেতরে ঢুকে ওই দলাপাকানো চটগুলোর উপর শুয়ে পড়ল কালুয়া । বাইরে তখন যন্ত্র জঙ্গলে তীব্র আলোড়নের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ।

মানুষগুলো কী স্বার্থপর ! নিজেদের ভোগ - বিলাসিতার, স্বচ্ছন্দের জন্য এই সব যন্ত্র দানব দিয়ে যন্ত্র জঙ্গল বানায় আর এর বলি হয় নিরীহ গাছ - গাছালি, পশু - পাখি, কীট - পতঙ্গ । এদের কী দোষ ! প্রকৃতিও এদের কাছে হার মেনেছে । অসহায় । কালুয়াও বড্ড অসহায় বোধ করছে । ওর সেই বাড়ি, পুকুর, সবুজ মাঠ সব কোথায় যেন হারিয়ে গেছে, আর কক্ষনো ফিরে পাওয়া যাবে না । এই যন্ত্রদানবগুলো সব গিলে ফেলেছে । বাড়ির কথা মনে পড়তেই বাবলার জন্য মন খারাপ করছে ভীষণ । খিদেও পাচ্ছে । কান্না পাচ্ছে ওর । তাহলে কী ও হারিয়ে যাবে এই যন্ত্রের জঙ্গলে !

যন্ত্রের জঙ্গলে

ঘুম ভেঙ্গে গেল লোকটার পায়ের শব্দে । ভাঙ্গা কারখানায় যদি কিছু লোহা - লক্কড় বাইরে পাচার করা যায় - এই আশায় ঢুকেছে লোকটা । অবশেষে বেরিয়ে যাওয়ার আগে গেটের পাশের ঘরে ঢুকে পড়ল । কালুয়া এতক্ষণ নীরবে সব দেখছিল । এবার লোকটা যদি এগিয়ে এসে দমা দম লাঠি পেটা করে ! তাই সময় নষ্ট করা উচিৎ হবে না । লোকটাকে চমকে দিয়ে হুড়মুড়িয়ে দৌড়ে গেটের বাইরে চলে আসে ।

উঁচু রং উঠে যাওয়া বালি সিমেন্ট খসে যাওয়া কারখানার দেওয়াল থেকে ত্রিপল ঢাকা, সামনে কাত করা বাঁশে বাঁধা চায়ের দোকান । দু-একজন লোকের আনাগোনা । দুপুর গড়িয়ে তখন বিকেল । খিদেয় পেট চোঁ - চোঁ করছে কালুয়ার । কাল থেকে কিছুই খাওয়ার জোটেনি । ও ভাবল দোকানের সামনে যাওয়া যাক । যদি কেউ দয়া করে এক আধ খানা বিস্কুট ছুঁড়ে দেয় । তাই বা কম কীসের ।

এগিয়েছে কী, অমনি চুল ওঠা এক চোখ কানা লালচে খেঁকী দাঁত খিঁচিয়ে "গ-র-র-গর" শব্দ করে কালুয়ার দিকে তেড়ে এলো । কালুয়াও কম যায় না । বীরত্ব দেখাতে চার পা মাটিতে শক্ত করে চেপে বড় বড় চোখ করে খেঁকীটার দিকে নিরবে চেয়ে রইল । কিছুটা এগিয়ে খেঁকীটা এবার থামলো । কালুয়াকে দেখে ভয়ও পেল কিন্তু পরক্ষণেই "ঘেউ - ঘেউ" করে বারে বারে ডেকে পাড়া উজাড় করল - "ওরে ভুলু, লালু, নেতা, নেড়ি,গেঁড়ি তোরা কে কোথায় আছিস দৌড়ে আয় । দেখে যা কোথা থেকে আর একটা জুটেছে আমাদের এলাকায় । আমাদের খাবারে বসাবে ভাগ - গ - গর - র - ঘেউ - উ - ঘেউ ।"

অমনি অলি গলি থেকে এক ঝাঁক নেড়ি, খেঁকী সব পিল পিল করে দৌড়ে এলো চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে । কী চেহারার ছিরি ! কোনটার লেজ খসা, কোনটার কান কাটা, কোনটার চুল ওঠা, কোনটা ভাজা ভাজা, রোগা, হাড় জির জিরে । কারখানার বিষাক্ত পরিবেশে থেকে, না খেতে পেয়ে এই দুর্দশা । এবার ওরা ঝাঁক বেঁধে দাঁত খিঁচিয়ে বিকট চিৎকার করে কালুয়াকে আক্রমণ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল ।

 কালুয়া নিরুপায় । ওরা এতজন আর ও একা । বাধ্য হয়ে পিছপা হতে হল । যেই না কালুয়া পিছন ফিরেছে অমনি ওরা আরো দ্রুত ধেয়ে এলো । কালুয়াও দৌড়াতে শুরু করে । ওরা আরো দ্রুত দৈড়ে আসছে ! একবার যদি কালুয়াকে ধরতে পারে তবে ওকে কামড়ে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে হয়তো । কালুয়া প্রাণ হাতে নিয়ে আরো জোরে দৌড়াচ্ছে । পেছনে ওরা বিকট চিৎকার করে মাৎ করছে । কলকারখানার শব্দও ছাপিয়ে যাচ্ছে চারদিক । কালুয়া হাঁসফাঁস করে তীর বেগে দৌড়াচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে । হঠাৎ সামনে চোখ যায়, এখানে রাস্তা শেষ ! সামনে উঁচু পাঁচিল । কী করা যায় । ওরা ধেয়ে আসছে পেছনে । আর কাছে - আরো কাছে এগিয়ে আসছে । সেই লালচে খেঁকীটা একটা বড় লাফ্ দিয়ে "ঘ্যাড়র - ঘ্যাড়র" শব্দ করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে কালুয়ার উপর ! কালুয়া তখন দিক্‌বিদিক্‌ জ্ঞান শূন্য হয়ে - "যা থাকে কপালে" বলে যতটা সম্ভব বল সঞ্চয় করে লাফ দিল পাঁচিলের উপর । আঁচড়ে কামড়ে পাঁচিলের মাথায় উঠে আবার একটা লম্বা ঝাঁপ ।

 কালুয়া চোখ খুলে দেখে ঝিলের জলে হাবুডুবু খাচ্ছে । এখানে কারখানাগুলোর শেষ প্রান্ত । তারপর এই ঝিল আর ঝিলের ওপারে বিরাট চওড়া ব্যস্ত বড় রাস্তা, তার নাম বোম্বে রোড । হাজার হাজার গাড়ির আনাগোনা । মনে  আশার সঞ্চার হল ।  ওই বড় রাস্তার ওপারেই তো কালুয়ার গ্রাম ! প্রাণপণে জল সাঁতারে উলটো দিকের পাড়ে এগোতে থাকে কালুয়া । হটাৎ চোখ যায় সামনের কারখানার চিমনির দিকে । ওর কালচে ধূসর ধোঁয়া ফ্যাকাসে আকাশটা চিরে বোম্বে রোড ছাড়িয়ে আরো দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে যেখানে, ওখানে একটা হলুদ ঘুড়ি চক্কর দিচ্ছে ! আরো ভালো করে সে দেখতে পেল একে একে অনেকগুলো রং বেরং - এর ঘুড়ি উড়ে বেড়াচ্ছে । নিশ্চিন্ত হওয়া গেল । ওপারে মাঠে বাবলা ওর বন্ধুদের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে নিশ্চই । আরো জোরে সাঁতার দিতে থাকলো কালুয়া । আনন্দে মন লাফিয়ে উঠল ।

 মাঠ তখন ভরপুর খেলায় মত্ত । সবাই এদিক ওদিক দৌড় ঝাঁপ করছে কিন্তু বাবলাকে তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না । তবে কি ও আজ খেলতে আসেনি ? মনটা খারাপ হয়ে গেল । কালুয়া আনমনে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে থাকল । সামনে উঁচু ঢিবির মতো জায়গা যেখানে কতগুলো খেজুর গাছ হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে, ওদিকে চোখ যায় । একটা গাছের নিচে কতগুলো ঘুড়ি ও লাটাই পড়ে আছে । কালুয়া ওদিকে এগিয়ে যেতেই দেখে ঢিবির ওপারে বাবলা বন্ধুদের সঙ্গে দুটো খুঁটিতে সুতো টান টান করে বেঁধে মাঞ্জা দিচ্ছে । কালুয়া আবদারের সুরে বাবলাকে ডাকে - "ভৌ - ভৌ - বাবলা !" বাবলা আনমনে একবার ফিরে তাকায় কালুয়ার দিকে । অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ । তারপর মাঞ্জা ফেলে দৌড়ে আসে কালুয়ার কাছে । বাবলা কালুয়ার মাথায় আদরের চাপড় মেরে জিজ্ঞেস করে - "কোথায় ছিলি কাল থেকে ? তোর কোন পাত্তাই নেই ! " অমনি কালুয়া লেজ নাড়তে নাড়তে আদরে গদ গদ হয়ে বাবলার বুকের উপর দু'পা তুলে ওর গালে চেটে দিয়ে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে - "কুঁই - কুঁই - ওই - যন্ত্রের জঙ্গলে ! "
 
 ছবিঃ পার্থ মুখার্জি

কাগজে-কলমে গ্রাফিক ডিজাইনার। কিন্তু সে কাজ ছাড়াও ইনি নানা কাজ করেন - মাঝেমধ্যে ইচ্ছামতীর জন্য ছবি আঁকেন, মাঝেমধ্যে ভাল ভাল গল্প লেখেন, আর প্রয়োজন হলেই চাঁদের বুড়িকে নানারকমের সাদাকালো-একঘেয়ে-বিরক্তিকর কাজকর্ম (যেগুলি একটা ব-অ-ড় ওয়েবসাইট চালাতে গেলে করতেই হয়)-সেইসব করতে সাহায্য করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা