সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

পুপাই, তুতাই দুই ভাইবোন। ‌পুপাইয়ের বয়স তেরো। আর তুতাই আট। তারা থাকে আমেরিকায়। তাদের আমেরিকার বাড়িতে বাবা, মা আছেন, খানকয়েক ঘর আছে, সামনে, পিছনে একচিলতে জমি আছে যাতে নির্বিবাদে বন্ধুবান্ধব নিয়ে খেলাধুলা করা যায়, ঘরের মধ্যে মাছি, পোকা - তাও মাঝে মাঝে দেখা যায়। বাড়ির পিছনে রোগা, মোটা, লম্বা, বেঁটে নানারকমের গাছ আছে। জন্, মেরী, পিয়া, ডাগ্, জোনাথন্, জেসিকা, এলা, বেলা বন্ধুরাও প্রায়ঃশই আসে খেলাধুলা করার জন্য। এতসব পাওয়া আর থাকা স্বত্ত্বেও পুপাই, তুতাইয়ের মনে ভারী দুঃখ। তারা বন্ধুদের বাড়ি যায়। তাদের বন্ধুদের প্রায় সব বাড়িতেই কুকুর, বিড়াল, সাপ, গিরগিটি, ব্যাঙ নিদেনপক্ষে আ্যাকোরিয়ামে মাছ আছে। কিন্তু তাদের বাড়িতে কোনও পোষ্যই নেই। ওদের দুই ভাইবোনের  খুব শখ একটা কুকুর পোষার। কিন্তু কুকুর ঘরে আনার কোনও উপায় নেই। মা বলে দিয়েছেন কুকুর এলেই মার হাজার কাজের ওপরে আরোও লক্ষ কাজ যোগ হবে। তাই মাঝেমাঝেই ফ্যাঁচফোঁচ করতে করতে দুই ভাইবোন কাঁদে। গুচ্ছ গুচ্ছ টিস্যু দিয়ে চোখ মোছে আর খুব করুণ চোখে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে ঠাকুর যেন মার মন বদলে দেন। বাবা পোষ্য আনার ব্যাপারে গররাজী। কিন্তু মা পুরোপুরি নাকচ। মা বলেছেন ঘরে কুকুর, বিড়াল, সাপ, ব্যাঙ, ইত্যাদি আনা নৈব নৈব চ। দুটি সন্তানের দায়িত্ব নিয়েই তিনি হিমশিম খাচ্ছেন। নতুন কোনোও পোষ্য এনে তিনি আর হয়রানি হতে পারবেন না। এ ব্যাপারে মা একদম অচল, অনড়, অবিচল। আর সত্যিই তো! মা যদি বেঁকে বসেন তবে রান্নাঘর বন্ধ হয়ে যাবে আর তাতে বাড়ির সবাই যে সমূহ বিপদে পড়বে সে নিয়ে বাড়ির কারোরই কোনও দ্বিধা নেই মনে। অগত্যা বাড়িতে বাবার বাক্স বাক্স টিস্যুর আমদানি, পুপাই, তুতাইয়ের ফ্যাঁচফোঁচ কান্না, ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা আর মার পুরোপুরি এব্যাপারে ঔদাসিন্য এভাবেই যখন চলছিল দিনগুলি, ঠিক তখনই একদিন পুপাই, তুতাইয়ের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়লো। অবশেষে ভগবান বোধহয় তাদের অবিরত প্রার্থনায় মুখ তুলে চাইলেন।

মার বান্ধবী ধিতাং মাসি খুব পশুপাখি ভালোবাসেন। ধিতাং মাসির বাড়িতে দশটা কুকুর, পাঁচটা বিড়াল, পনেরোটা খরগোশ, পাঁচটা ইঁদুর আর কুড়িটা ব্যাঙ। ধিতাং মাসিকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয় সব পোষ্যসংখ্যাই পাঁচের গুণিতক কেন ধিতাং মাসি বলেন খাবার সময়, রাত্রিতে শোওয়ার সময় বা সকালে তাঁর দৈনন্দিন নৃত্যচর্চার সময় কারোর অনুপস্থিতি খুব তাড়াতাড়ি বোঝা যায়। হিসেবে খুব সুবিধে হয় তাঁর; এতে অনেকটা সময়ই বেঁচে যায় তাঁর। ধিতাং মাসি নাকি ছোট থেকেই খুব ধিতাং, ধিতাং করে নাচতে ভালোবাসতেন। এখনোও নাকি তা অব্যাহত। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই তাঁর কুকুর, বিড়াল, খরগোশ নিয়ে নিয়মিত নৃত্যচর্চা করেন। ইঁদুরগুলি ভারী অলস। খাঁচা থেকে ছাড়া পেলেই নাকি কোথ্থাও নড়বে না। একজায়গায় বসে শুধু কুটকুট করে কাগজ কুটিকুটি করবে। আর ব্যাঙগুলো বেশী চঞ্চল। ছাড়া পেলেই লাফাতে লাফাতে কোথায় চলে যায়, ধিতাং মাসির খুঁজে পেতে মহা সমস্যা হয়। তাই তাদের নৃত্যচর্চা থেকে বিরত রাখা হয়। পাঁচের গুণিতকে পোষ্যসংখ্যা না হলে কি যে হতো সেটা ভাবলে ধিতাং মাসি শিউরে ওঠেন। তাঁর আদরের অনেক পোষ্যই হারিয়ে যেতো। পুপাই, তুতাই এসব শুনে ধিতাং মাসির বুদ্ধির তারিফ না করে আর পারে না।

সেই ধিতাং মাসিই ফেসবুকে একদিন একটা স্ট্যাটাস দিলেন যে একটি কুকুরছানার আশ্রয় দরকার। আপাততঃ কুকুরটিকে তিনি বাড়ি নিয়ে এসেছেন । কুকুরটি একটি প্রাণী রাখার শেল্টারে ছিল। এইসব শেল্টারে সব অবাঞ্ছিত প্রাণীদের দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আনা হয় দত্তক নেওয়ার জন্য। যেসব পশুপাখিকে লোকজন দত্তক নেয় না, তাদের যে কি অবস্থা হয় সেটা ধিতাং মাসি ভাবতেও ভয় পান। এই নতুন কুকুরছানাটি প্রায় একমাস যাবৎ শেল্টারে আছে। শেল্টারের লোকজন বলেছে তারা আর একে আশ্রয় দিতে রাজী নয়। এই সারমেয় সন্তানটি সারাক্ষণ তিড়িং বিড়িং করে লাফায় বলে কেউ তাকে বাড়ি নিতে চায় না। কুকুরটিকে কেউ বাড়ি না নিয়ে গেলে তার কি হবে, তা কেউ বলতে পারে না। শেল্টার তাকে সারাজীবন আশ্রয় দেবে না। ধিতাং মাসির খুব মমতা। তাই ধিতাং মাসি ওকে তুলে এনে আপাততঃ ওঁর বাড়িতেই রেখেছেন। কিন্তু ধিতাং মাসিও ওকে রাখতে চান না। শেল্টারে মাত্র একটাই কুকুর ছিল তখন। কমপক্ষে পাঁচটা কুকুর না হলে ধিতাং মাসিই বা বাড়িতে রাখেন কি করে! পাঁচের গুণিতক নয় বলে ধিতাং মাসির হিসেবনিকেশেও গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছে। অগত্যা ধিতাং মাসির ফেসবুকে স্ট্যাটাস পোষ্টিং। কেউ যদি তাঁর পোষ্টিং দেখে উৎসাহিত হয়! ধিতাং মাসির যে খুব বুদ্ধি! কাজও হলো এতে। সাদা গা, কানের পাশে, লেজের ডগায় আর বাঁ চোখের পাশে খয়েরী ছোপের কুকুরছানার ছবি দেখে মার ভারী মায়া হলো। কুকুরটাকে কেউ না নিলে কী হবে? যদিও মা একদমই বাড়িতে পোষ্য আনার বিপক্ষে তাও মার খুব দুঃখ হলো। তিনি ছবিটা পুপাই, তুতাইকে দেখানো মাত্রই তারা তো আনন্দে আটখানা। বাবাও ছবি দেখে পছন্দ করলেন। মা বললেন কুকুরছানাকে আনতে পারেন একটাই শর্তে; কুকুরকে মা খেতে দিলেও তাকে হাঁটানো, শোয়ানো ইত্যাদির ভার তিনি নিতে পারবেন না। তুতাই, পুপাই তাতেই খুব রাজী।
 
ধিতাং মাসির পরামর্শ অনুসারে কুকুরের বিছানা, তার একটা বেশ বড়োসড়ো খাঁচা, গোটা সাতেক বাক্স ভর্ত্তি খাবারদাবার, ছটা খেলনা, চিবানোর জন্য এক ডজন হাড়, খাবারদাবাড়ের বাসনকোসন ইত্যাদি কেনা হলো। ঠিক হলো ধিতাং মাসি পরদিন সকাল সাড়ে সাতটায় সারমেয় সন্তানটিকে নিয়ে আসবেন। পুপাই, তুতাই খুবই উদগ্রীব। আটটা বাজলো, ন'টা বাজলো ধিতাং মাসির তখনোও কোনওই পাত্তা নেই। ঠিক যখন ঘড়িতে সকাল দশটা বেজে পাঁচ মিনিট, ঠিক তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো। পুপাই, তুতাই ছুটে দরজা খুলতেই একটা কুকুরছানা ঝাঁপিয়ে পড়লো তুতাইয়ের গায়ে। দুই পায়ে দাঁড়িয়ে উঠে তুতাইয়ের মুখ চেটে দিল। ধিতাং মাসি বললেন কুকুরছানাটি নাকি বাড়িতে খুবই তিড়িং, বিড়িং করছিল আর বাড়ির সব জিনিষ পরখ করে দেখছিল। ধিতাং মাসি ওর মুখের ভিতর থেকে ঠিক পাঁচটা পেন আর পেনসিলের দশটা ছোট টুকরো বের করেছেন আর সেইজন্যই এতো দেরী! তারপর ধিতাং মাসি কুকুরছানাটির দিকে তাকিয়ে কপট ধমক দিয়ে বললেন, "সিট্ সিট্ বসো বসো!" সে শুধু জিভ বের করে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো তারপর তিড়িং করে এক লাফে মার সামনে গিয়ে ল্যাজ নাড়তে লাগলো। মা চশমাটাকে নাকের ডগায় এনে, এই ছোট্ট প্রাণীটিকে খানিকক্ষণ পরখ করে গম্ভীর হয়ে বললেন, "কিসব নোংরা ঘেঁটে এসেছে, কে জানে! সরাও এ কে আমার কাছ থেকে। " সেই শুনে সে আরোও জোরে জোরে ল্যাজ নাড়তে থাকলো। মা যতো বিরক্ত হয়ে বলেন, "একে সরাও আমার কাছ থেকে" ততোই সে দ্বিগুণ জোরে ল্যাজ নাড়ে আর তিড়িং, বিড়িং করে লাফাতে থাকে। মা চশমার ফাঁক দিয়ে খানিকটা দেখে বললেন, "এ তো কোনওই সহবৎ শেখেনি। সারাক্ষণ তিড়িং, বিড়িং করে লাফাচ্ছে। ওর নাম তাহলে থাক তিড়িং।" পুপাই, তুতাইয়ের খুব কেতাদুরস্ত একটা নাম দেওয়ার ইচ্ছে ছিল। মার দেওয়া নামটা অপছন্দ হলেও মার বিরক্তি উদ্রেক না করাই ভালো ভেবে চুপ করে রইলো। পরবর্ত্তী কিছু সময় তিড়িং মুখ নীচু করে, পিছনটা খানিকটা উঁচু করে ল্যাজ নাড়তে থাকে আর কখনোও ঝাঁপিয়ে পড়ে পুপাই, তুতাইয়ের জামা ধরে টানতে থাকে, জুতো থেকে মোজা বের করে বা টেবিলের পায়া চিবাতে ব্যস্ত থাকে। ধিতাং মাসির বাড়ি ঠিক একশো পঞ্চান্ন মাইল দূরে। মা বললেন, "অতদূর থেকে এসেছে। নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে।" এই বলে মা প্যাকেট থেকে খাবার বের করে চামচে দিয়ে মেপে তিড়িংয়ের জন্য সদ্যকেনা বাটিতে খেতে দিলেন। তিড়িং খাবারের সামনে গিয়ে গন্ধ শুঁকে, ল্যাজ নাড়তে থাকে ক্রমাগত। কিন্তু খাবার সে ছুঁয়েও দেখে না। মা তিড়িং এর দিকে তাকিয়ে অতিশয় বিরক্তিতে বললেন, "তোমাদের সব আদিখ্যেতা! এখন সামলাও। যত্তোসব অনাসৃষ্টি! মহারানীর তো খাবার পছন্দ হলো না। এখন কি করবে?" তিড়িংকে বাড়িতে আনার উদ্যোগটা যে মাই নিয়েছিলেন, সেটা মা ভুলেই গেলেন।

তিড়িং বেশ কিছুক্ষণ ল্যাজ নেড়ে, তিড়িং বিড়িং করে লাফালাফি করে অবশেষে বোধহয় খুব ক্লান্ত হয়েই একবার বাবা, আরেকবার মার দিকে আড়চোখে তাকিয়েই একলাফে সোফায় উঠে বসলো। বাবার আবার খুব পরিষ্কার পরিষ্কার বাতিক। বাবা অত্যন্ত রেগে, জোর গলায় ধমক দিয়ে তিড়িং এর জন্য সদ্যকেনা বিছানায় ওকে নামিয়ে দিলেন। তিড়িং কিছুক্ষণ কুতকুত করে তাকিয়ে থাকলো। তারপর সামনের পাদুটো জোড়া করে তার ওপর থুতনি রেখে একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়লো। দেখে বাবার ভারী মায়া হলো। বললেন, "আহা! কেষ্টর জীব। ক্লান্ত খুব। ঘুমাক এখন।" তারপর একটু পর্যবেক্ষণ করে তিড়িং ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি পুপাই, তুতাইকে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে বলে নিজে অফিসের কাজে মগ্ন হলেন। আর যাহোক সারাদিন ধরে তো কুকুরপর্ব চলতে পারে না। তুতাই, পুপাইয়ের গ্রীষ্মের ছুটি থাকলেও হোমওয়ার্ক আছে, ওঁর নিজেরও অফিসের বাস্তবিকই প্রচুর কাজ আছে। ই-মেল পড়া, ই-মেল লেখা, ফোনে কথা বলা – হাজারো কাজ তাঁর। ধিতাং মাসিও কুকুর, মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দেখে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন আর মাও রান্নাঘরে গেলেন খাওয়ারের যোগাড় করতে। মা আর ধিতাং মাসি দুজনেই আবার সামাজিকভাবে খুব সক্রিয়। তাই কাজের আগে ফেসবুকে তিড়িং এর ছবি পোষ্ট করে মা স্ট্যাটাস আপডেট্ দিতে ভুললেন না,  'তিড়িং: সারমেয় সন্তান। বাড়ির নতুন সংযোজন।' ধিতাং মাসিও তিড়িংয়ের ছবির নীচে স্টাটাস আপডেট দিলেন, 'দত্তক প্রদান সম্পূ্ণ। আর সে লভ্য নয়।'

মা কতোক্ষণ রান্নাঘরে ছিলেন মনে নেই, বেশ কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে দেখেন তিড়িং খুব সুবোধ বালিকার মতো সোফায় বসে চোখ গোলগোল করে টিভি দেখছে আর পুপাই, তুতাইয়ের বাবা তিড়িং এর বিছানায় বসে, কোলে কম্প্যুটার, কানে ফোন নিয়ে কনফারেন্স কলে খুবই ব্যস্ত। মার মেজাজ এমনিতেই খারাপ হয়ে আছে। কারণ ফেসবুকে তিড়িং এর ছবি দেখে ইন্ডিয়াতে পুপাই, তুতাইয়ের মামা, যিনি ছোটবেলা থেকেই নাকি পালকের মতো হাল্কা, সেই পালকমামা বলেছেন, "কীরে? শেষমেষ নেড়ীকুকুর পুষ্যি নিলি?" পালকমামা পালকের মতো বলে খুব ছোট থেকেই দিদার আদেশে শুধু বিলেতী জিনিস ব্যবহার করেন। বিলেতি চাল, বিলেতি রুটি, এমনকি বিলেতি মাছও পার্শেল করে বাড়িতে চালান হয়। পালকমামার নিজের একটা বিলেতি কুকুর আর বিলেতি গিরগিটি আছে। যেকোনও অবিলেতি জিনিস পালকমামার ভারী অপছন্দ। নেড়ীকুকুর, দেশী বিড়াল, দেশী ছুঁচো, দেশী ইঁদুর, দেশী ব্যাঙ এসব পালকমামার দুই চক্ষের বিষ। সেই পালকমামার এহেন মন্তব্যে মা খুবই বিচলিত। তার ওপরে যোগ হয়েছে পুপাই, তুতাইয়ের ইন্ডিয়ার বিনবিন মাসি। বিনবিন মাসির আবার সবদিকেতেই খুব কড়া নজর। বিনবিন মাসি নাকি মাছির মতো সবজায়গায় বিনবিন করেন আর সবকিছু দেখেশুনে যা রায় দেন তা প্রায়শঃই সঠিক হয়। সেইজন্য বাড়ির যে কোনও গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শের দরকার হলে বিনবিন মাসিকে ডাকা হয়। বিনবিন মাসি বিনবিন করে সবকিছু সরেজমিনে তদন্ত করে যা মতামত বা উপদেশ দেন বাড়িতে সবাই তাই মেনে চলে। তিড়িং এর ঝোলা ঝোলা কান দেখে সেই বিনবিন মাসির মন্তব্য, "ঠিক জানিস তুই, সারমেয় সন্তান? ছাগল নয়তো?" বিনবিন মাসি যদি বলেন ছাগলছানা তাহলে মা না বিশ্বাস করে থাকেন কি করে? মা জানেন যে তিড়িং সারমেয় সন্তান; কক্ষনোই ছাগলছানা নয়। কিন্তু দ্বন্দ তো একটু এসেই যায়! এসব পড়ে মার মেজাজটা দরকচা মেরে গেছে। রীতিমতো বিলেতি কুকুরকে যদি নেড়ীকুকুর বা নিতান্তই ছাগলছানা বলে তাহলে স্ট্যাটাসটা কোথায় থাকে? এখন তিড়িংকে আরামে সোফায় বসে টিভি দেখতে দেখে মা অসম্ভব বিরক্ত হয়ে বললেন, "খাওয়াদাওয়া নেই। শুধু কুঁড়েদের মতো টিভি দেখা! চলো হাঁটতে যাবে। তাতে শরীর ভালো থাকবে, খিদেও পাবে।" মার কথাবার্তায় তিড়িং কী বুঝলো কে জানে! তুরতুর করে সোফা থেকে নেমে মার সঙ্গে গলায় কলার বেঁধে বেড়াতে বেড়ালো।

পাড়ায় বেরিয়ে মা দেখেন তিড়িং খরগোশ, কাঠবিড়ালী, পাখি আর অন্য কুকুরছানা দেখলেই দুটো পায়ের মাঝে ল্যাজ ঢুকিয়ে মিনমিন করছে। পথে যতো পচা কাঠ, গাছের বাকল দেখছে, সবই গলাধঃকরণ করছে। এসব অব্দি তাও ঠিক ছিল, কিন্তু মা যখন দেখলেন তিড়িং পথের পাশের ঘাস পাতাও খেতে শুরু করেছে, তখন মার সত্যিই সন্দেহ হতে শুরু করলো। বিনবিন মাসির সিদ্ধান্ত সচরাচর ভুল হয় না। ধিতাং মাসি ভুল করে সত্যি সত্যিই ছাগলছানা দিয়ে যায়নি তো? নয়তো কুকুরের খাবার ছুঁয়েও দেখলো না! আর এখন ঘাস, পাতা চিবাচ্ছে। চিন্তাটা মাথায় আসার পর থেকে আর কিছুতেই যাচ্ছে না। আয়তনেও ছাগলের মতো, কানদুটোও কেমন ঝোলা ঝোলা, গলার আওয়াজটাও তেমন জোরদার নয় – শিঙটাই যাহোক নেই। মা জানেন বাচ্চা ছাগলের শিঙ থাকে না; পরে গজায়। আর তাছাড়া কিছু প্রজাতির ছাগল প্রকৃতিজাত কারণেই শিঙহীন। চিন্তাটা মাথায় আসার পর থেকেই বেশ চেপে ধরেছে। খুব চিন্তিতমুখে মা যখন বাড়ি ফিরলেন, তখন পুপাই, তুতাইয়ের পড়াশোনা শেষ। বাবারও কাজ প্রায় শেষ। মা তিড়িংকে ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত ভেবে আবারোও খাবার দিলেন। কিন্তু তিড়িং মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে কেবলিই ল্যাজ নাড়তে থাকে; খাবার সে ছুঁয়েও দেখেনা। তুতাই, পুপাই এসব দেখে কিছু খাবার মাটিতে ফেলে সটান চেটে খেলো; যদি তিড়িং একটু শেখে! কিন্তু তিড়িং কেবলিই ল্যাজ নাড়ে; খায় না কিছুই। মার মনে হলো চোখে একটু কৌতুকও কী! তিড়িং কিছুই খাচ্ছে না দেখে মা মহাবিপদে পড়লেন। হঠাৎই কি মনে হতে মা বাইরে গিয়ে কিছু ঘাসপাতা ছিঁড়ে এনে ওকে দিলেন। যেইমাত্র তিড়িং ঘাসপাতা দেখলো, লাফিয়ে এসে সব ঘাসপাতা নিমেষে খেয়ে মার গায়ে নাক ঠেকিয়ে টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে জিভ বের করে চাটতে থাকে মার হাত। তারপরই সে যেটা করলো তাতে মা পুরো তাজ্জব বনে গেলেন। সামনে পুপাই, তুতাইয়ের পড়াশোনার বইপত্রের সঙ্গে বারোটা পেনসিল আর সাতটা পেন ছিল। তিড়িং উঠে হঠাৎই সেখান থেকে এক এক করে মুখে কামড়ে ঠিক দশটা পেনসিল আর পাঁচটা পেন এনে মার সামনে জড়ো করলো। মা ভাবলেন চোখের আর মনের ভুল কি? যাচাই করার জন্য পেন, পেনসিল সব একত্রে মিশিয়ে দিলেন। তিড়িং আবার ঠিক দশটা পেনসিল আর পাঁচটা পেন এনে জড়ো করলো মার সামনে। এসব দেখেশুনে পুপাই, তুতাইয়েরও চোখ গোলগোল। শোরগোল শুনে বাবাও উঠে এসেছেন। যাচাই করার অভিপ্রায়ে বাবাও এবারে সব মিশিয়ে দিলেন একত্রে। আবারও তিড়িংয়ের পাঁচের গুণিতকে পেন, পেনসিল সংগ্রহণ। ধিতাং মাসির বাড়ি একরাত্রি থেকেই তিড়িং যে অঙ্ক শিখে গেছে এ নিয়ে পুপাই, তুতাই বা বাড়ির কারোরই আর কোনও দ্বিমত রইলো না। পুপাই, তুতাই আবারও ধিতাং মাসির বুদ্ধিমত্তার তারিফ না করে পারলো না। বাবাও যারপনারই আনন্দিত। এখন থেকে ওঁর অফিসের হিসেবনিকেষে তিড়িংয়ের সাহায্য নেওয়া যেতেই পারে। সত্যজিতবাবুর অসমঞ্জের কুকুর যদি ফিচেল হাসি হাসতে পারে তাহলে তিড়িং তাদের গণিতজ্ঞ হতেই পারে! এতে আর অস্বাভাবিকতার কি আছে? মা মনে মনে ভাবলেন, কুকুরছানা না হলেও পন্ডিত ছাগল তো! কিন্তু ছাগলছানার ব্যাপারটা প্রকাশ না করে মা ফেসবুকে তিড়িং এর একটা ছবি পোষ্ট করে ক্যাপশন্ দিলেন,"আমাদের পন্ডিত তিড়িং।" তিড়িং যে সারমেয় সন্তান নয় - আদতে ছাগলছানা, সেটা মা গোপনই রাখলেন। স্ট্যাটাস্ বলে একটা ব্যাপার আছে তো! আর তাছাড়া, ছাগলও যে পন্ডিত হয় সেটা কেউ বিশ্বাস করবে কি? 

ছবিঃ শিল্পী ঘোষ

ঊর্ম্মি ঘোষদস্তিদার (দত্তগুপ্ত) অঙ্ক নিয়ে পড়াশোনা করে এখন ব্রুকলিন্, নিউইয়র্কের একটা কলেজে অঙ্ক পড়ান এবং অঙ্ক নিয়ে গবেষণা করেন। তাঁর কাজের অবসরে সময় পেলে অথবা সাব্ওয়ে বা বাসে করে কাজে যাওয়ার পথে তিনি লিখতে বা আকঁতে ভালোবাসেন। তাঁর স্বামী অভিজিত আর দুই ছেলেমেয়ে – সায়ম্ আর ইমনকে নিয়ে তিনি আমেরিকার নিউজার্সিতে থাকেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা