সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
(১)

গত দিন পনেরো ধরেই রাতুল এই বুড়ো দাদুটাকে দেখছে। রোজ বিকেলে তার পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে খেলার সময় দাদুটা মাঠের ধারে বসে থাকে আর তাদের ক্রিকেট খেলা দেখে। অবশ্য সে তো অনেক সময় অনেকেই বসে থাকে। তাদের খেলা দেখে, কেউ কেউ আবার গাছের ছায়ায় ঘুমিয়েও নেয়!

দাদুটাকে সে আবার দেখেছে তার স্কুলের সামনের রাস্তায়। এই তো সেদিন, স্কুলের ছুটির সময়ে স্কুলের মেন গেটের উল্টোদিকে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসেছিল বুড়ো লোকটা।

লোকটা যাকে বলে একদম থুত্থুড়ে বুড়ো। গায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে, সারা মুখ জুড়ে বালিরেখা, মাথায় ধপধপে সাদা কয়েকগাছি চুল, চোখে একটা আদ্যিকালের মোটা ফ্রেমের চশমা, সেটার কাঁচটা আবার ঘোলাটে, তার মধ্যে দিয়ে দেখতে পাওয়া বুড়ো লোকটার জন্য খুবই কঠিন কাজ। পরনের জামাটাও খুব নতুন নয়। হাতে একটা লাঠি নিয়ে তাতে ভর দিয়ে পা টেনে টেনে ঘুরে বেরায় লোকটা। তবে শুধু রাতুলের দিকে নয়, ওর স্কুল বা খেলার অন্য বন্ধুদের দিকেও তাকিয়ে থাকতে দেখেছে লোকটাকে। দেখে অনেক সময় মনে হয় লোকটা বোধহয় ঐ বাচ্চাদের ভীড়ে কাউকে খোঁজার চেষ্টা করছে।

রাতুলের এখন ক্লাস ওয়ান, স্কুলে এই সপ্তাহ থেকে গরমের ছুটি পড়েছে। এই গরমের মধ্যে বেশীরভাগ সময়ই বাড়িতে বসেই ঠাকুরমার ঝুলি আর নন্টে-ফন্টে পড়া চলছে। তবে বিকেল হলে একবার তার মাঠে যাওয়া চাইই। আর রাতুলের বাবাও বলে রেখেছেন, যতই বই পড় না কেন দিনের মধ্যে অন্তত দুটি ঘণ্টা মাঠে গিয়ে দৌড়দৌড়ি না করলে রাতুল এই অল্প বয়সেই আনফিট হয়ে পড়বে।

রাতুলের রোজ বিকেলে খেলতে যেতে ভালোই লাগে। আর এখন তো ছুটি বলে চারটে বাজতে না বাজতেই মায়াদিকে বলে মাঠে পৌঁছে যায় সে। তবে এখন যা গরম পড়েছে, তখনও রোদ পড়ে না অনেক দিন। বাকি বন্ধুরা না আসা অবধি একাই মাঠের ধারে বসে থাকে রাতুল।

আজকেও মাঠে গিয়ে রাতুল দেখল যে, তার বন্ধুরা কেউ আসেনি। তবে মাঠের একদম উল্টোদিকে ধারে সেই বুড়ো দাদুটা বসে আছে। রাতুল এদিকেই একটু ছায়ায় বসে ক্যাম্বিস বলটা নিয়ে লোফালুফি করছিল। হঠাৎ দেখল মাঠের ওধারে দাদুটা উঠে দাঁড়িয়েছে, হাত নেড়ে তাকেই ডাকছে।

রাতুল প্রথমে সাড়া দিচ্ছিল না, তারপর উঠে আস্তে আস্তে দাদুটার দিকে এগিয়ে গেল। কদিন ধরেই দাদুটাকে দেখে তার নিজেরও ইচ্ছে করছিল লোকটার সঙ্গে কথা বলতে। বলা তো যায় না, লোকটা হয়তো ম্যাজিশিয়ান, কিংবা হয়তো গুপ্তধনের সন্ধান জানে! আর লোকটার হাতে শুধু একটা লাঠি। সঙ্গে কোন ঝোলা থাকলে তবু নাহয় লোকটাকে ছেলেধরা বলে ভাবত রাতুল।

রাতুল সামনে গিয়ে দাঁড়াতে বুড়ো লোকটা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, "তোমার বন্ধুরা আজকে আসবে না খোকা?"

রাতুল আর কী বলবে, একবার পেছন ফিরে দেখল। তার কোন বন্ধুকেই মাঠের আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না। লোকটা আবার বলল, "আমার সঙ্গে খেলবে খোকা? আমার বাড়িতে? ঐ যে... কাছেই" বলে লোকটা তার সরু হাতটা তুলে কোনরকমে ডানদিকের একটা বাড়ির দিকে দেখাল। রাতুল ঐ বাড়িটা আগে কখনো খেয়াল করেনি। মাঠের ঐদিকটায় অনেক গুলো পুরনো ইঁট বের করা বাড়িগুলোর মধ্যেই যেন এই বাড়িটা লুকিয়ে ছিল। এই বাড়িটাও কম পুরনো নয়! রাতুল দেখতে পেল, দোতলার বারান্দার কাঠের রেলিং জায়গায় জায়গায় ভাঙা, দেওয়াল পলেস্তরা খসা, দরজা-জানলার রং ফ্যাকাসে। দেখে মনেও হচ্ছে না যে, ঐ বাড়িতে কেউ থাকে।

লোকটা আবার মুখ খুলল, ফোকলা দাঁতের ফাঁক দিয়ে হেসে বলল, "আমার কাছে অনেক ভালো ভালো পুরনো দিনের খেলনা আর পুতুল আছে। তুমি দেখবে খোকাবাবু?"
বন্ধুরা এখনো আসছে না, আর বাড়িটা মাঠের পাশেই। রাতুল রাজী হয় গেল। এই তো দশ মিনিট দেখেই চলে আসবে না হয়। ততক্ষণে নিশ্চয়ই রাজু আর গণশা ব্যাট নিয়ে চলে আসবে। তাও একবার জিজ্ঞেস করল সে, "তোমার সব খেলনা দেখাবে আমাকে?"

"দেখাব তো বটেই খেলতেও দেব দাদুভাই..." লোকটা লাঠিতে ভর দিয়ে টুকটুক করে হাঁটতে লাগল ওই পুরনো বাড়িটার দিকে। তার পেছনে পেছনে রাতুল। অনেক কষ্ট করে নিজের শরীরটাকে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল ঐ বৃদ্ধ। দেখলেই মনে হয় খুবই দুর্বল, জীবনীশক্তি একদম শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে।

রাতুল আর বুড়ো লোকটা এসে দাঁড়াল লোকটার বাড়ির সামনে। নিজের শতছিন্ন জামার পকেট থেকে একটা ছোট্ট চাবি বের করে কোনরকমে দরজার তালাটা খুলল লোকটা। রাতুলের দিকে ঘুরে বলল, "এসো খোকা, আমার সঙ্গে এসো।"

বাড়িটা বেশী বড় নয়। সামনের ঘরটা ভীষণ অন্ধকার। রাতুল কিছু বুঝতেই পারছিল না কোথায় পা দেবে। লোকটা ওর অস্বস্তি বুঝে হেসে বলল, "এই ঘরটা ভালো না, ভেতরের ঘরে চল। আমার সঙ্গে সঙ্গে এসো।" হোঁচট খেতে খেতে ওই ঘরটা পার করে এল রাতুল আর বুড়ো লোকটা।

কোনরকমে সামনের ঘরটা পার হয়ে একটা দরজা দিয়ে বেরোতেই একটা উঠোনের মত জায়গা। সেখানে তখন বিকেলের পড়ন্ত আলো এসে পড়েছে। উঠোনের সামনে লম্বা বারান্দা, সঙ্গে পাশাপাশি তিনটে ঘর। সে ঘরগুলোর দরজা বন্ধ, দেখে মনেই হয়না সেগুলোতে দীর্ঘদিন কোন মানুষের পা পড়েছে বলে। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শেষের ঘরটায় গিয়ে ঢুকল বুড়ো লোকটা, সঙ্গে রাতুল। ঘরে ঢুকেই হাতড়ে হাতড়ে বাঁদিকের দেওয়ালের সুইচবোর্ড থেকে একটা উজ্জ্বল টিউবলাইট জ্বেলে দিল লোকটা।

রাতুল অবাক হয়ে দেখল যে, সেটা মস্ত বড় একটা ঘর। ঘরের একধারে একটা পুরনো খাট, লোকটা বোধহয় এখানেই শোয়। ঘরের বাকি পুরোটাই ফাঁকা। শুধু এক কোণে একটা আদ্যিকালের মস্ত বড় কাঠের আলমারি ছাড়া ঘরে আর কিচ্ছু নেই।

"আমরা এখানেই খেলব" লোকটা ফিসফিস করে বলল। রাতুল অবাক হয়ে বলল, "কী দিয়ে খেলব? কোথায় তোমার খেলনা আর পুতুল?"

লোকটার মুখে আবার একটা হাসি ফুটে উঠলো, "ওই যে আলমারিটা, ওটার মধ্যেই আমার সব খেলনা। তুমি এসো আমার সঙ্গে।"

লোকটা আবার পা টেনে টেনে সেই আলমারিটার সামনে এসে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে রাতুলও। পুরনো দিনের কাঠের আলমারি, দুই পাল্লার ওপরেই কাঠ খোদাই করে নানারকমের নকশা! লোকটা টানতেই আলমারির পাল্লাটা খুলে গেল। রাতুল অবাক হয়ে দেখল আলমারির সব কটা তাক জুড়ে শুধু একের পর এক খেলনা। নতুন-পুরনো, দেশী-বিদেশী কত রকমের যে খেলনা তার ইয়ত্তা নেই। বুড়ো লোকটা খুসখুসে গলায় বলল, "এই সব খেলনা তোমার, এগুলো বের করে নাও।"

রাতুল অবাক হয়ে বলল, "এই সব খেলনা আমার? ঐ পুতুলগুলোও আমার? আর ঐ ট্রেনটা?" আলমারির মাঝের তাকের পুরোটাই নানারকমের পুতুলে ভর্তি। সেখানে ছেলে-মেয়ে, সাহেব-মেম সবই আছে।  

লোকটা মাথা নেড়ে বলল, "এগুলো সব তোমার খোকাবাবু।"

রাতুল মুগ্ধতা ভরা দৃষ্টিতে আলমারির ভেতরটা দেখছিল। বুড়োর কথাটা শুনেই সব খেলনা এক এক করে বের করে আনতে লাগল। কী নেই সেখানে, খেলনা বন্দুক, খেলনা উড়োজাহাজ, খেলনা কাপ-ডিশ, আর সেই দারুণ দেখতে পুতুলগুলো।

একটা একটা করে সব কটা পুতুল নামিয়ে ঘরের এক কোণে সাজিয়ে ফেলল রাতুল। চট করে গুনে ফেলল পুতুলগুলো, মোট তেইশটা আছে। আর কী দারুণ দেখতে তাদের। মনে হয় যেন জীবন্ত। যেন এখুনি তাদের চোখের পাতা পড়বে, ঠোঁট নড়বে।

কতক্ষণ সময় কেটে গেছে রাতুলের সেটা খেয়াল নেই। এমনকি ওই বুড়ো লোকটা কী করছে সেটাও আর দেখছিল না সে। তার পুরো মন জুড়ে আছে এই খেলনাগুলো, খেলনা গাড়ীগুলো চালিয়ে দিচ্ছে ঘরের এদিক থেকে ওদিক। আবার একটা খেলনা গীটার ছিল, সেটা তুলে কয়েক টান মারল সে। তারপর পুতুলগুলো নিয়ে পর পর দর্শকদের মত সাজিয়ে রাখল রাতুল। এবার সে এদের গীটার বাজিয়ে শোনাবে।

"পুতুলগুলো ভালো লাগছে খোকাবাবু?" বুড়ো লোকটা আবার ফিরে এসেছে। সে তার ঐ ঘোলাটে চশমার ফাঁক দিয়ে রাতুলকে দেখছিল, "রোজ খেলবে ওদের সঙ্গে? ওদের বন্ধু হবে? বেশ ওদের সঙ্গে থাকবে? সবসময়? সারাক্ষণ? চিরকাল?" খ্যাসখ্যাসে গলায় টেনে টেনে বলে যাচ্ছিল লোকটা। সঙ্গে ওর ঐ দুটো দুর্বল হাতের হাড়সর্বস্ব দশটা আঙুল কি নড়ছে? সাপের ফণার মত উঠছে নামছে কি ওই আঙুলগুলো? ওই হাতে কি জাদু আছে? লোকটা কি সত্যিই ম্যাজিশিয়ান?

রাতুল আর তাকিয়ে থাকতে পারছে না। খুব ঘুম পাচ্ছে তার, চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আর খেলতে পারছে না। কিন্তু একটু আগেই তো ঘুম থেকে উঠেছে সে। তারপর মাকে অফিসে ফোন করে মায়াদির বানানো এক গ্লাস ফলের রস খেয়ে মাঠে খেলতে গেছিল সে। কিন্তু এখন সে কোথায়? আর তো চোখ খুলে রাখা যাচ্ছে না। তার সামনের পুতুলগুলো... এই আছে, এই নেই। কোথায় গেল? এত অন্ধকার কেন? না না... এই তো আছে। তেইশটা পুতুলই তো তারই দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের চোখে কোন ভাষা নেই... না, তারা আর তাকিয়ে নেই। রাতুলের চোখের পাতা ভারী হয়ে গেছে। তার চোখ এখন বন্ধ।

(২)

পৃথিবী থেকে প্রায় বাইশশো আলোকবর্ষ দূরে মহাশূন্যের বুকে ছুটে চলেছিল এক মহাকাশযান। পৃথিবীতে এক পুরনো ভাঙাচোরা বাড়ির চেহারা নিয়েছিল যে মহাকাশযান! মহাকাশযানটার ভেতরের প্রাণীটি আস্তে আস্তে উঠে বসল। এই লোকটাকে আমরা চিনি। কিন্তু তাকে আর বুড়ো লোক বলা চলে না। তার চামড়ায় আর ভাঁজ নেই, কপালে বলিরেখা নেই। চশমাটা খুলে ফেলে দিল সে। সে চশমার আর তার প্রয়োজন নেই। তার যৌবনের কিছুটা অংশ ফিরে পেয়েছে সে। আর একবার।

সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল সে। তার সামনে সারা ঘরে খেলনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। একে একে সব খেলনাগুলোকে আলমারিতে তুলে রাখতে লাগল সে। সেই খেলনা বন্দুক, সেই খেলনা উড়োজাহাজ, সেই খেলনা কাপ-ডিশ... সব একে একে রেখে দিল আলমারির মধ্যে। তারপর আলমারির ঠিক মাঝের তাকে একটা একটা করে সব কটা পুতুল গুনে তুলে রাখল লোকটা। ঠিক চব্বিশটা পুতুল!

ছবিঃ মহাশ্বেতা রায়

প্রধানত পাঠক, যেকোন বই এবং ব্লগ দেখলেই সেটির পেছনে কিছুটা সময় দিতে ইচ্ছে করে। লেখালেখি অনেক দিন থেকেই তবে মন দিয়ে লেখা গত চার-পাঁচ বছরে। নিজের ব্লগ ছাড়াও অন্যান্য ওয়েবজিন ও বিভিন্ন ক্রিকেট সংক্রান্ত ওয়েবসাইটেও কিছু লেখা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা