সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
এক

আজ ষষ্ঠী । প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে  ঢাক ঢোলের সংযোগে চলছে মা দুর্গার আরাধনা। ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েরা নতুন জামাকাপড় পরে বাবা মায়ের হাত ধরে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছে। চারিদিকে আলোর ঝকমারিতে মুগ্ধ হচ্ছে। এই কচিকাঁচাদের দলে আরেকটা বাচ্চাও আছে। সেও ঠাকুর দেখছে, লোকজন দেখছে, আলোর সাজ দেখছে আর অবাক হচ্ছে। পার্থক্য একটাই, তার পরনে নেই নতুন জামা, হাতে নেই আইসক্রিম বা চিপসের প্যাকেট, তার বদলে আছে একটা কাঁসর আর কাঠি। সাত বছরের ভোম্বল প্রথমবার কলকাতায় এসেছে তার বাবার সঙ্গে, তবে পুজো দেখতে নয়, ঢাকি বাবার সঙ্গে কাজ করতে। আরও কিছুটা অর্থের সংস্থানের আশা নিয়ে ৷

 রমেন ঢাকি অর্থাৎ ভোম্বলের বাবার বাসস্থান বাঁকুড়া জেলার ছোট্ট একটা গ্রামে, নাম খুরপী। বউ আর তিন বাচ্চা নিয়ে রমেন ঢাকির পরিবার। প্রতিদিন পাঁচটা পেট চালাতে রমেন আর তার বউ কমলার হিমশিম অবস্থা। সেই সঙ্গে দু দুটো মেয়ের বিয়ের চিন্তা। রমেনের যা আয় তাতে সংসার চালানো দুষ্কর, বিয়ে দেওয়া তো আরও কঠিন। এদিকে গ্রামের লোকে কথা শোনাতে ছাড়ে না। বাবার চিন্তার কথা সাত বছরের ছেলেটাও বুঝতে পারে। সেই জন্যই তো বাবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার কলকাতায় আসা ৷

দুই

এই ঘটনার সূচনা ভাদ্রের শেষে, যখন বর্ষা সূর্যিমামাকে কাজের ভার দিয়ে সবে ছুটি নিয়েছে। আকাশে প্রখর রোদ দেখে রমেন ঢাকি তার ঢাক বের করেছে। এই রোদেই খোল শুকিয়ে তরতাজা করে তুলতে হবে। পুজোর আর বেশি বাকি নেই, সামনেই বিশ্বকর্মা পুজো। তার পরেই বেরিয়ে পড়তে হবে বায়না ধরতে। এইবার ভালো বায়না ধরতে না পারলে পরের বছর বড় মেয়ের বিয়ে দেওয়া যাবে না। বড় মেয়ে রমা, ষোলো পেরিয়ে সতেরোতে পা দিয়েছে। পরের বছরের মধ্যে কিছু একটা ব্যবস্থা না করলে গ্রামের লোক টিকতে দেবে না। যদি এক ঘরে করে দেয়? রমেনের ভয় হয়। সে যখন এইসব ভাবনায় বিভোর তখন তার অগোচরে পাশে এসে দাঁড়ায় ভোম্বল ৷
"বাবা, তোমাকে একটা কথা বলব?"
 "কী বলবি??"
"এবারে আমাকে তোমার সঙ্গে নেবে?"
"কোথায় নেবো??"
"তুমি তো শহরে যাবে পুজোয়। আমায় সঙ্গে নেবে?"
রমেন অবাক হয়। কী বলছে এই ছেলে!
ভোম্বল আবার বলল  - "আমি ভালো কাঁসর বাজাতে পারি। আগের বার ষষ্ঠীতলায় টানা অনেক খন কাঁসর বাজিয়েছি আমি। ও বাবা, ও বাবা, আমাকে সঙ্গে নাও না।"
রমেন সব শুনে বলে –"দূর বোকা ছেলে, ষষ্ঠীতলায় কাঁসর বাজানো আর শহরের পূজোয় বাজানো কী এক হল?? কর্তারা বায়না করে নিয়ে যাবে। ভালো করে বাজাতে না পারলে পয়সা দেবে কেন?"
"আমি পারব বাবা।"
 একথা বলেই সে ছুটে ঘরে চলে যায়, আর পর মূহুর্তে একটা কাঁসর আর লাঠি নিয়ে এসে এক নাগারে বাজাতে থাকে। বাজাতে বাজাতে বলে ওঠে - "সেদিন ঘোষ কাকিমা দিদির বিয়ে হচ্ছে না বলে কত কথা শোনাল দিদিকে, দিদি ঘরে এসে খুব কাঁদছিল। দিদিকে দেখে আমারও কান্না পাচ্ছিল। আমি অনেক টাকা জোগাড় করব বাবা কাঁসর বাজিয়ে, দিদির বিয়ে দেব। দেখো বাবা।"  কথা গুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ল সাত বছরের ছেলেটা।
                   
সেই ঘটনার পর রমেন আর আপত্তি করে নি। ভোম্বল কে নিয়ে এসেছে কলকাতায়। তবে একটা কথা ভারি অবাক করে ছিল সেদিন,অতটুকু ছেলেও তার বাবার কষ্ট, দিদির কষ্ট বুঝতে পারে। রমেন কী পারত নিজের ছোট বেলায় তার নিজের বাবার কষ্ট বুঝতে? পুরনো কথা মনে করতে পারে না রমেন।

তিন

এবার আসা যাক পুজোর প্যান্ডেলে। ভোম্বল রোজ দেখে অনেক অনেক লোক ঠাকুর দেখতে আসে, কত সুন্দর সুন্দর পোশাক। তার গায়ে একটা পুরনো জামা। বাড়ি থেকে মাত্র দুটো জামা এনেছে। রোজ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে  রোজ রোজ পড়তে পড়তে ঘামের একটা গন্ধ বেরোচ্ছে ৷ সেই জন্যই বোধহয় তার কাছে কেউ ঘেঁষছে না। ভোম্বলেরও ইচ্ছে করে একটা নতুন জামার, কিন্তু তার বাবার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। একটানা কাঁসর বাজাতে বাজাতে হাতটা ব্যাথা করে, কষ্ট হয়। কিন্তু সে থামেনা। আজ অষ্টমী ছিল। সন্ধী পূজোয় অনেকখন কাঁসরের দড়ি ধরে থাকায়, বাঁ হাতের আঙুলটা ফেটেছে, ব্যাথা করছে। আঙুলটার কী করা যায় ভোম্বল যখন ভাবছে তখন পাশ থেকে একটা স্বর ভেসে এল - "এই নাও প্রসাদ।"
ভোম্বল তাকিয়ে দেখে , প্রায় তারই বয়সী একটা ছেলে একটি কাগজের থালায় কিছু ফল আর বাতাসা নিয়ে তার দিকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। ভোম্বল ছেলেটার হাত থেকে থালাটা নিয়ে নেয়,কিছু বলে না ৷ ছেলেটি ভোম্বলের হাতের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে - "তোমার হাতটা তো কেটে গেছে ।"
ভোম্বল বলে - "ও কিছু হবে না"
"না না, কাটা জায়গা এভাবে খোলা রাখতে নেই, দাঁড়াও আমার কাছে ব্যান্ড এইড আছে। এই বলে সে নিজের পকেট থেকে একটা কাগজের মতো জিনিস তার হাতে লাগিয়ে দিল। এই জিনিসটা আগে কখনো ব্যবহার করে নি সে। মা তো কোথাও কেটে গেলে হলুদ লাগিয়ে দেয়।
ভোম্বল হেসে বলল -" থাঙ্কু " , এই শব্দটা তার বন্ধু হারু কলকাতায় আসার আগে শিখিয়ে দিয়েছে। হারু বলেছে, কেউ কিছু দিলে এই ইংরেজি শব্দটা বলতে হয় ৷
ছেলেটা হেসে বলল - "ওটা থাঙ্কু নয়, থ্যাঙ্ক ইউ"।
ভোম্বল লজ্জায় মাথা নিচু করে নেয়। হারু এতবার করে শেখানোর পর ভুল বললো সে। ছেলেটি বলে চলে, আমার নাম টুবাই। তোমার নাম কী? "
"আমার নাম ভোম্বল "
 "খুরপি "
 "সেটা কোথায়? নাম শুনিনি "
 "তুমি একা অতদূর থেকে এসেছ??"
 "না না, বাবার সাথে এসেছি।"
"তুমি তো তখন কাঁসর বাজাচ্ছিলে দেখলাম।"
"হ্যাঁ, আমার বাবা ঢাকি, আর আমি কাঁসর বাজাই ৷"
ভোম্বল বলে – "তোমায় একটা জিনিস দেবো, খাবে??"
"কী জিনিস??"
ভোম্বল তার পাশে রাখা ঝোলা থেকে একটা ডিপে বের করলো, যাতে কিছু নাড়ু রয়েছে। সে জানায় এগুলো তার মায়ের হাতের তৈরি করা।
ভোম্বল বলে – "তুমি আমার উপকার করলে, তাই ভাবলাম তোমায় দি।"
"কী ভালো খেতে। আরেকটা নি??"
ভোম্বল ডিবে বাড়িয়ে দিলো। নাড়ু খেয়ে টুবাই বললো – "আর এখানে থাকা যাবে না। অনেকক্ষণ হলো এসেছি, মা আমাকে দেখতে না পেলে চিন্তা করবে। আজ আসি, কাল আবার দেখা হবে।"

চার

আজ মহানবমী, লোকের ভিড় আজ আরও বেশি। ভোম্বল অপেক্ষা করছে টুবাই এর জন্যে, কিন্তু তার দেখা নেই। সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হতে চললো তাও সে এলো না।  কাল টুবাইকে সামনের ওই সাদা বাড়িতে ঢুকতে দেখেছিল সে। একবার বাড়িটা দেখলো, কাউকেই দেখতে পেলো না। ভোম্বলের মনটা খারাপ হয়ে যায়। নবমী পেরিয়ে দশমী এলো, আজ মা দুর্গার ভাসান। আজ সকালেও টুবাই এর দেখা নেই। ভোম্বল দেখলো বাড়িটা থেকে একজন লোক বেরোচ্ছে। ভোম্বল সাহস করে তার কাছে গিয়ে টুবাই এর কথা জিজ্ঞেস করতে ভদ্রলোক ভোম্বলকে দেখে নিয়ে প্রশ্ন করলো – "খোকনকে তুমি কী করে চিনলে??"

 ভোম্বল ভয় পেলো, ঢোক গিলে বললো – "আসলে সেদিন আমাকে প্রসাদ দিতে এসেছিল, তারপর থেকে আর দেখতে পেলাম না, তাই আর কী..." ভোম্বল আর কী বলবে বুঝতে পারলো না।
 
ভদ্রলোক বললেন – "টুবাই এর কাল থেকে শরীর খারাপ, বাড়িতে শুয়ে আছে। ভদ্রলোক চলে গেলেন। কিন্তু শরীর খারাপ কথাটা শুনে ভোম্বল ভয় পেলো। তাহলে কী তার দেওয়া খাবার খেয়ে অসুস্থ হল টুবাই। এক নিমেষে মনটা তেতো হয়ে গেলো তার। টুবাই তার উপকার করলো তার বদলে ভোম্বল তার ক্ষতি করলো?

এখন সন্ধ্যে, মা দুর্গা যাওয়ার জন্য তৈরি, প্যাণ্ডেলের সাজ অর্ধেক খুলে নেওয়া হয়েছে। চারিদিকে সবাই ঢাকের তালে নাচতে ব্যস্ত, কিন্তু ভোম্বলের মন সেই এক কথা ভেবে চলেছে। রমেন এসে ডাকে, তাকে আবার কাঁসর বাজাতে যেতে হবে, তার একটুও যেতে ইচ্ছা করছে না। এমন সময়ে হঠাৎ সে টুবাইকে দেখতে পেলো। টুবাই তার কাছেই আসছে।  তাকে দেখে ভোম্বল বলে উঠলো, -" আমার জন্যে তোমার শরীর খারাপ হলো, আমার ভুল হয়ে গেছে, তোমাকে সেদিন খাবার দেওয়াটা ঠিক হয়নি।"

টুবাই হেসে বলে –" তোমার খাবার খেয়ে আমার কিচ্ছু হয়নি। ঠান্ডা আইসক্রিম খেয়ে জ্বর এসেছিল। এখন একদম ঠিক আছি। আমি তো বরং এতো ভালো নাড়ু আগে কখনো খাইনি।"

 টুবাই একটা প্যাকেট তার হাতে দিয়ে বললো এটা তোমার উপহার। ভোম্বল অবাক , "উপহার কিসের জন্যে? "
টুবাই বললো – "তুমি আমায় নাড়ু দিলে তাই আমিও তোমার জন্য এটা আনলাম। "
ভোম্বল প্যাকেট খুলে দেখলো তাতে নতুন একটা জামা আর প্যান্ট রয়েছে। উপহার দেখে আনন্দে তার মন ভোরে উঠলো। এরকম নতুন জামা পড়ার ইচ্ছা ছিল তার। টুবাই কে বললো – "থ্যাঙ্ক ইউ "
টুবাই হেসে বললো – "পরের বছর আবার আসবে তো?"
"আসব, প্রতি বছর আসব।"

রমেন ঢাকীর চোখের সামনে সমস্ত ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে গিয়ে আজ একটা সম্পর্ক তৈরি হল, যার নাম বন্ধুত্ব।

ছবিঃ মঞ্জিমা মল্লিক

সুনিষ্ঠা প্রাণিবিদ্যায় স্নাতক এবং পরিবেশ বিদ্যায় স্নাতকোত্তর । শখ বই পড়া এবং গল্প লেখা । প্রধানত সমাজ ভিত্তিক এবং ছোটদের জন্য লিখতে পছন্দ করেন । বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে ।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা