সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

বরফ ঢাকা পাহাড় পর্বত এর ওপর দিয়ে উড়তে উড়তে একদিন তারা সবুজ দেশটির দেখা পেয়ে যায়। পুরনো যারা তাদের চেহারায় স্বস্তির চিহ্ন। আর যারা নতুন, যারা কখনই এ রকম সবুজ মোড়ানো কার্পেট ওর মতো এলাকা দেখেনি, তারা আনন্দে উচ্ছল হয়ে ওঠে। একে অপরের পাখনায় ঠোকর দেয়। বলে, ইস কী সুন্দর! এতো সুন্দর কিছু হয়।

উড়তে উড়তেই একসময় দলনেতা বার্ড রবিন তাদের জানান ওরা এ বছর যেখানে দিন যাপন কববেন তার কাছাকাছি এসে গেছেন। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখে ওরা সবুজ কার্পেট এর মাঝে বিশাল এক রূপালী বৃত্ত। ধীরে ধীরে বার্ড রবিন এর দল মাটির কাছাকাছি নেমে আসে। নতুন প্রজন্মের তরুন পাখিরা বুঝে আকাশ থেকে দেখা রূপালী বৃত্তটা আসলে বিশাল একটা জলাশয়।

দীর্ঘ দিন ওড়ার সমাপ্তি পাখি দলের। নতুনরা পানিতে নেমে যায়। হুটোপুটি করে। ছোট ছোট মাছ ঠোঁটে তুলে নেয় কেউ কেউ। সাইবেরিয়ার চাইতে কতো উষ্ণ এখানকার পানি। খাবারেও আলাদা স্বাদ। অনেকক্ষন হৈ-হল্লার পর সবাই তীরে উঠে আসে। নতুনরাও যোগ দেয়।
বার্ড রবিন এই দলে সবচেয়ে বয়স্ক। তাই সবাই নেতৃত্ব তার হাতে সমর্র্পন করেছে। বার্ড রবিনের মুখ থম থমে। তিনি যখন সিরিয়াস কিছু বলেন তখন তার মুখে হাসি থাকে না। সবাই তখন বুঝে রবিন জরুরী কোন কাজের কথা বলছেন।
তরুনরা চুপ হয়ে বসতেই বার্ড রবিন গলা খাকারী দেন। তারপর বলেন, 'বাছারা তোমরা, এই প্রথম এসেছো এই মুলুকে। এখানের সবুজ গাছ পালা আর উষ্ণ পানি যেমন সত্যি তেমনি বেশ কয়েক ধরনের বিপদও এখানে চুপটি করে বসে আছে। তাই সবাইকে এখানে সাবধান থাকতে হবে। আমরা অন্ধকার সময়টুকু কাটাবো এখান থেকে কিছু দূরে এক জঙ্গল এলাকায়। ঠিক কতো দিন এখানে থাকবো তা নির্ধারন করবো অবস্থার ওপর। এ জলাশয় ছাড়াও এই এলাকায় আরো জলাশয় আছে। দরকার হলে আমরা অন্য জলাশয়েও যেতে পারি। বার্ড রবিন একটু থামেন। 'নতুনদের এখান কার বিপদ আপদ সম্পর্কে একটু বলেন'। বললেন মধ্য বয়স্ক বার্ড ম্যাক। রবিন এর মৃত্যুর পর ম্যাকই হবেন দলনেতা। এখন তিনি রবিন এর সাহয্যকারী হিসাবে কাজ করে থাকেন।
'হ্যাঁ এটা খুবই জরুরী। আমি সংক্ষেপে কিছু বিপদের কথা বলছি। এখানে আমাদের প্রধান শত্রু দুপেয়ে একধরনের প্রানী। নাম মানুষ। এরা ভয়ংকর। হ্যাঁ এদের মধ্যে ভালোও আছে। কিন্তু দেখে চেনার কোন উপায় নেই। অতএব, এদের কাছ থেকে সব সময় দূরে থাকতে হবে। এদের সামনে পড়া যাবে না কখনই। এরা নানান কারসাজি করে থাকে। আর কোন কারসাজিতে ধরা পড়লে মনে রেখো বাছারা বেঁচে থাকতে দেয় না ওরা।
নতুনরা ভয় পায়। একে অপরের দিকে তাকায়। বার্ড রবিন আবার শুরু করেন। 'আর নানান কার সাজির কয়েকটা তোমাদের বলি। এরা মাঝে মাঝে লাঠির মতো একটা জিনিস দিয়ে আগুন ছুঁড়ে মারে। আর ঐ আগুন ভয়ংকর শব্দ করে শরীরে এসে লাগে। মনে রেখো ঐ আগুনের টুকরো গায়ে লাগলে বাঁচার কোন উপায় নেই। আরও আছে এক ভয়ংকর জিনিস সেটার খপ্পরে পড়লে তৎক্ষনাৎ মারা যাবে না ঠিকই তরে ফিরে আসার কোন উপায় নেই। ঐ জিনিসটি তোমাদের পা জড়িয়ে রাখবে। কখনই তা ছিড়ে আসতে পারবে না তোমরা।
ঐ পা জড়ালো ফাঁদে এক সাথে অনেকেই জড়িয়ে পড়তে পারো। অতএব সাবধান। খবরদার যেখানে সেখানে না জেনে না শুনে নেমে পড়ো না। পুরনো যারা তাদের কথার বাইরে যেয়োনা কখনও। তাহলে নিজের বিপদ তো ডেকে আনবেই অন্যদেরও বিপদে জড়াবে।
তরুন পাখিদের মন খারাপ হয়ে যায়। দুপেয়েদের কথা চিন্তা করে ওরা। দুপেয়েরা এমন কেন? ওরা, পাখিরা তো দুপেয়েদের কোন ক্ষতি করে না। তাহলে দুপেয়ে তাদের বিপদে ফেলে কেন ? নিজেরা এই প্রশ্নের কোন জবাব খুঁজে পায় না। মন খারাপ নিয়ে কিছুক্ষণ দল বেধে বাতাসে ভেসে বেড়ায় ওরা। বিকেল পড়ে আসে। সূর্যটা লাল রঙের বিশাল একটা থালা হয়ে জলাশয়ের এক প্রান্তে ডুব দেয়। বার্ড রবিন সবাইকে নিয়ে জঙ্গলের দিকে উড়তে থাকেন। পাখিদের কাকলীতে ভরে ওঠে সাদাটে আকাশ।
চোখের পলকে কেটে গেলো দুতিনটে মাস। তরুন পাখিরা অবাক হবার আগেই একটার পর একটা ঘটনা ঘটে গেলো তাদের চোখের সামনে । তারা এসেই দেখেছিল সবুজ কার্পেট বিছানো মাঠে। দিনে দিনে সেই সবুজ সোনালী হয়ে হয়ে গেলো। আর তখনই ওরা দেখলো দুপেয়ে মানুষদের। বিভিন্ন আকারের মানুষেরা নেমে এলো সেই সোনালী কার্পেট এর ওপর। তার পর কাটতে থাকলো কার্পেটের শরীর। একটু একটু করে বিশাল কার্পেটটা শেষ হয়ে গেলো। মাত্র কদিনের মধ্যে পড়ে থাকলো ন্যাড়া মাঠ।
একদিন সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গলে পাখিরা দেখলো চোখের সামনে সাদা পর্দা দুলছে। পুরনোরা এ ব্যাপারটা জানলেও নতুনরা ভয় পেয়ে গেলো। বার্ড রবিন তাদের ভয় ভাঙ্গালেন। বললেন সূর্য ওঠলেই দেখবি ঐ চাদর আর থাকবে না। আমাদের এখানে টুকরো টুকরো পানি পড়ে আর এখানে পড়ে কণা কণা গুড়ো গুড়ো। সত্যি সত্যি কিছুক্ষন পর কেটে যেতে থাকলো সেই চাদর। নতুন ধরনের মজা পেয়ে আনন্দে মেতে উঠলো নতুন পাখিরা।
এর মধ্যে ভয় পাবার মতো কোন ঘটনা ঘটেনি। পাখিরা দিব্যি দিনভর ভেসে বেড়ায় আকাশ আর পানিতে। ছোট মাছের ঝাঁক থেকে ছো মেরে মেরে একটা দুটো মাছ ধরে খায়। আনন্দে, হুল্লোড়ে কাটে দিন। নতুন অপরিচিত কতো পাখির দল। অনেকগুলো শীতের দেশ থেকে এসেছে। একের সাথে অপরের পরিচয় হয়ে যায়। দুষ্টুমী, খুনসুটি করে একে অপরের সাথে। বিকেলের আলো যখন কমলা রং ছড়িয়ে বিশাল জলাশয়ের পশ্চিম প্রান্তে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে তখনই পাখি আকাশের রং দেখতে দেখতে পাহাড়ে ফিরে যায়। ওদের ফিরে যাওয়ার শব্দে, কলকাকলীতে দুপেয়েরা উপরে তাকিয়ে দেখে। বেশ মজা পায় পাখির দল। দুপেয়েরা উড়তে জানেনা। উড়তে জানলে হয়তো সমস্যাই হতো পাখিদের জন্য। বার্ড রবিন এর কথা মতো ভয়ংকর প্রানী ঐ দুপেয়েরা। উড়তে জানলে হয়তো ওরা তাদের ধরে ধরে খেতো। ভাবলেই ভীত হয়ে পড়ে পাখির দল।
পাহাড়ের গাছপালার মধ্যে ফিরে আসতে আসতেই অন্ধকার আর ঠান্ডা নেমে আসে পাহাড় অঞ্চলে। ঐ পাহাড়ের ভেতর দিয়ে একটা রাস্তাবলে গেছে পশ্চিম থেকে পূর্বে। মাঝে মাঝেই বিদঘুটে শব্দ করে বাক্সের মতো জিনিস গড়িয়ে চলে যায়। ওগুলোর পেট বোঝাই থাকে দুপেয়ে প্রানীতে। অনেকদিন পাখিরা লক্ষ করেছে ঐ পাহাড়ের ভেতরেও বাক্স গুলো মাঝে মাঝে থেমে পড়ে। আর ওটার পেটের ভেতর খেকে দুএকটা দুপেয়ে নেমে জঙ্গলে ফাঁকে ফাঁকে হারিয়ে যায়। তাই পাখিরা ঐ রাস্তা থেকে দূরে থাকে।
রাতে ঝিঁ ঝিঁ-র কলতান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ে পাখির দল। মাঝে মাঝে গভীর রাতে 'হুক্কা হুয়া' 'হুক্কা হুয়া' শুনে পাখীদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। বার্ড রবিন বলেছেন ও গুলো চার পেয়ে প্রানী। ওদের ও পাখা নেই তবে দুপেয়ে দের চাইতে ও গুলো ভালো। তবে বাগে পেলে পাখিদের ধরে ফেলতেও পারে।
রাতের অন্ধকার এক সময় কেটে যায়। ধীরে ধীরে আলো ফোটে ওঠে। কমলা রঙের সূর্য কুয়াশা সরিয়ে গাছের ফাঁক দিয়ে আলো ছুড়ে দেয়। পাখিরা আবার ঝাঁক বেধে জলাশয়ের দিকে উড়াল দেয়। এভাবেই দিন কাটে।
এক সকালে জলাশয়ে এসই থমকায় পাখির দল। দুপেয়ে কজন মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জলাশয়ের কাছাকাছি। তারা জলে ভাসা কালো রঙের এক ধরনের জিনিসে চড়ে ইতিউতি ঘুরছে। পাখিরা সবধান হয়। ওদের চাইতে কিছু দূরে নামে ওরা। বার্ড রবিন আর ম্যাক এর মন খারাপ। তারা কোন বিষয়ে দু'শ্চিন্তা করছেন। দুপুর পর্যন্ত আনন্দে মেতে ওঠে অন্যান্য দিনের মতো। বিকেলের দিকেই দুর্ঘটনা ঘটে। বেশ কটা পাখি ডুব সাতার কাটতে কাটতে দুপেয়ের কাছাকাছি চলে যায়। তখনই পর পর কটি 'গুড়ুম' আওয়াজ হয়। পাখিদের মধ্যে ছুটোছুটি পড়ে যায়। ভয়ার্ত শব্দে ভরে যায় জলাশয়। পলক ফেলতে না ফেলতেই ছয় সাতটি নতুন পাখি ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে মুখ থুবড়ে পড়ে। দুপেয়েরা উল্লাসে নেচে ওঠে। বার্ড রবিন অন্যান্যদের নিয়ে আকাশে উড়েন।

একটু আগে ভাগেই জঙ্গলে ফিরে আসে পাখির দল। আজ সবাই নিরব, নিথর। ভয় চেপে আছে তরুণ পাখিদের বুকের গভীরে। বার্ড রবিনের ভবিষ্যৎবাণী লেগে গেলো। নিজেদের বোকামী আর দুপেয়েদের বুঝি কিছুটা বিশ্বাসই করে ফেলেছিলো পাখিরা। ফল হলো কজনকে চির জীবনের জন্য থেকে যেতে হলো এখানে।
বার্ড রবিন সিদ্ধান্ত নেন। ভোরে এই এলাকা ছেড়ে নতুন এলাকায় চলে যাবেন। ফেরার ও সময় হয়ে এসেছে। আর কটা দিন অন্য কোথাও কাটানো দরকার দুপেয়েরা লোভী হয়ে উঠবে এখন। প্রতিদিন আগুন ছুড়ে মারবে কিংবা পা জড়ানো ফাঁদ পাতবে পানিতে। এখানের আর নয়।
ভোরের আলো ফুটি ফুটি করছে। আজ কুয়াশা নেই। বার্ড রবিন পাখিদের নিয়ে নীরবে আকাশে ওড়েন। প্রায় চার মাসের স্মৃতিমাখা জঙ্গল আর জলাশয় ছেড়ে যাচ্ছে পাখি দল। যে দিন এখানে এসে ওরা পৌছে ছিলো সেদিন তারা আরো সাত জন বেশী ছিলো। আজ সাত জনকে রেখেই বিদায় নিতে হচ্ছে। হারানো পাখির জন্য অন্যান্য পাখিদের বুকের ভেতর একরাশ কষ্ট জমে থাকে।
বার্ড রবিনের পিছু পিছু নীরবে উড়তে থাকে পাখি দল। উওর দিকে, নতুন জলাশয়ের খোঁজে।

ছবিঃ তৃষিতা মিত্র

চন্দনকৃষ্ণ পাল অনেকগুলি ছড়া ও কবিতাপত্র সম্পাদনা করেন। ঢাকার এক সরকারী সংস্থায় কর্মরত এই লেখকের একাদিক ছোটদের জন্য বই প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা