সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
এক

বয়সকালে সিধু এ তল্লাটে চোরেদের রাজা ছিল। গোবিন্দপুর ও আশেপাশের সাতখানা গ্রামের গেরস্তেরা সিধুর নাম শুনলে আঁতকে উঠে দোরে আগল দিত। সিধুর অবশ্য তাতে কিছু আসত  যেতনা। মাখনের মধ্যে ছুরির মতই তার ভারী সিঁদকাঠি গেরস্তের  ঘরের দেয়ালে নিঃশব্দে গর্ত করে ফেলত। যে কোন বিলিতি সিন্দুকের তালা সে নিমেষে খুলে ফেলত। পরের দিন সকালে উঠে বাড়ির লোক য়খন মাথায় হাত দিয়ে বসেছে, সিধু ততক্ষণে চুরির জিনিষ জায়গামত জমা দিয়ে বাড়িতে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে
গোবিন্দপুরের দারোগা ছিলেন অনন্তবাবু। অনেক চেষ্টা করেও তিনি সিধুকে ধরতে পারেননি। সিধুর বাড়ি এমনকি আশেপাশের এলাকা তন্নতন্ন করে খুঁজেও চোরাই মালের ছিটেফোঁটাও কখনও খুঁজে পাওয়া য়ায়নি।

সিধুর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এলাকার গন্যমান্য লোকেরা শেষে একজোট হয়ে  সদরে নালিশ করলেন। তার জেরে অনন্তদারোগাকে আসামে বদলি হয়ে য়েতে হল,  তার জায়গায় এলেন সূর্য্যদারোগা। তিনি সাতঘাটের জল খাওয়া ঘাঘু লোক, পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখে বুঝে গেলেন সিধুকে জব্দ করতে না পারলে কিছুদিনের মধ্যে তাঁরও অনন্তবাবুর দশা হবে। তিনি কোনও ঝুঁকি না নিয়ে কিছু সাক্ষীসাবুদ যোগাড় করে মিথ্যে ডাকাতির মামলায় জড়িয়ে সিধুকে সদরে চালান করে দিলেন। গ্রামের লোক হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

জেলে ঢুকে সিধু বুঝল সে প্যাঁচে পড়েছে। তার কেস সরকারি উকিল অনেকদিন ঝুলিয়ে রাখলেন। অবশেষে বহুদিন পরে রায় বেরিয়ে তার জেল মাত্র দু বছরের হল বটে কিন্তু সে জেল থেকে বেরতে না বেরতে সূর্য্যদারোগা নতুন কেস ঠুকে দিলেন। সিধু আবার পুলিশের হেফাজতে চলে গেল। অবশেষে প্রায় বছর দশেক পরে সে পাকাপাকি ছাড়া পেয়ে গ্রামে ফিরল। কিন্তু সিধু আর সে সিধু ছিল না। চোর হলেও সে ছিল বরাবরের সুখী মানুষ, পুলিশের মার আর জেলের খাবার খেয়ে তার শরীর ও মন দুইই ভেঙ্গে গেছিল।
বাড়ি ফিরে কিছুদিন সে চুপচাপ বসে রইল তারপর একদিন পুরান সিঁধকাঠিটি হাতে তুলতে গিয়ে দেখল হাত কাঁপছে। সিধু বুঝে গেল এ হাতে আর সিন্দুক খোলার ম্যাজিক দেখান যাবে না। 

সিধুর অবশ্য খাওয়া পরার অভাব ছিল না। চুরির টাকা সে নিরাপদে খাটিয়ে রেখেছিল, একা মানুষের দিব্যি চলে য়েত। কিন্তু চুরি তার কাছে ছিল শিল্পকর্মের মত,  জাত শিল্পী তার কাজ ছাড়া বাঁচেনা।সিধু কিছুদিন মনের দুঃখে গুমরে গুমরে রইল। তারপর একদিন মাত্র কয়েকদিনের জ্বরে ভুগে পট করে উপরে চলে গেল।

খবর পেয়ে সূর্য্যদারোগা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। কাঁহাতক আর মিথ্যা সাক্ষী যোগাড় করা য়ায়? 

দুই

সূর্য্যদারোগার স্বস্তি অবশ্য বেশী দিন টিঁকলনা। কিছুদিনের মধ্যেই গোবিন্দপুরে নতুন চোরের আবির্ভাবে চারিদিকে হৈচৈ পড়ে গেল।সিধুর মতই এর  পাকা হাতের কাজ।  আশেপাশের গ্রামের সম্পন্ন গৃহস্থদের বাড়ির সিন্দুক থেকে রাতারাতি টাকাপয়সা গয়নাগাঁটি দামী বাসনপত্র সব উধাও হয়ে য়েতে লাগল।

সূর্য্যদারোগা প্রমাদ গনলেন। তাঁর রিটায়ার করতে আর বেশীদিন নেই,  ভেবেছিলেন শেষবয়সে প্রোমোশনটা পেলে সদরে গিয়ে  ক'টা দিন আরামে কাটাবেন। হঠাৎ এ কী উৎপাত শুরু হল?

তিনি আশেপাশের সবকটি গ্রাম থেকে যত দাগী চোর ছিল সবাইকে থানায় তুলে আনলেন। সবাই একবাক্যে বলল সিধুর অবস্থা দেখে তারা অনেকদিন আগেই সিঁধকাঠি ফেলে দিয়ে অন্য ধান্দা ধরেছে। 

সূর্য্যদারোগা সবকটি বাজারে চর পাঠালেন। তারা এসে খবর দিল চুরির মাল বাজারেও  আসেনি।

মরিয়া সূর্য্যদারোগা শেষে ফাঁদ পাতলেন। গোবিন্দপুরেরই নায়েবমশায়ের মেয়ের বিয়ে, তাঁর কথামত নায়েবমশাই বিয়ের কদিন আগেই সদরের স্যাকরার থেকে বিয়ের গয়না নিয়ে এসে বাড়ির সিন্দুকে রাখলেন। সূর্য্যদারোগা সুকৌশলে লোকের মুখে সে কথা ছড়িয়েও দিলেন।তারপর রাত হলে রিভলভার কোমরে গুঁজে সিন্দুকের পাশে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে রইলেন।

রাত দুটো নাগাদ  একটু ঝিমুনি এসেছিল হঠাৎ  খুটখুট শব্দে চটকা ভেঙ্গে গেল। সাবধানে পর্দার  ফাঁকে চোখ রেখে সূর্য্যদারোগার  বুকে রক্ত চলকে উঠল।  সিন্দুকের ডালা খোলা, লম্বা ঢ্যাঙা একটা লোক ঝুঁকে পড়ে সিন্দুক থেকে গয়না তুলে থলিতে পুরছে।
তিনি রিভলভার বাগিয়ে নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে থাকলেন।  লোকটা গয়নাগাঁটি ভরে নিয়ে সিন্দুকের ডালা বন্ধ করল, তারপর -কী আশ্চর্য্য - তাঁর দিকেই এগিয়ে এসে পর্দা সরিয়ে একগাল হেসে বলল,  পেন্নাম হই কত্তা।

সূর্য্যদারোগার হাতে রিভলভার থরথর করে কেঁপে উঠল।  এ  কে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে?

সিধু আবার হেসে বলল,  ভাবতেছিলাম, আজ আপনার সঙ্গে দেখা হবে।  তা কত্তা এই ভূত-জন্ম বড় সুখের।  কষ্ট করে আর দেয়ালে সিঁধ কাটতে হয় না।  সিন্দুকটা অবশ্য খুলি,  পুরান বিদ্যেটা ঝালিয়ে রাখি। তা পেন্নাম কত্তা।

সূর্য্যদারোগার বিস্ফারিত দৃষ্টির  সামনে সিধু গয়নার থলে হাতে দেওয়ালের মধ্য দিয়ে মিলিয়ে গেল।

পরের দিন সকালে একটু সুস্থ হয়ে দপ্তরে এসেই সূর্য্যদারোগা বদলির দরখাস্ত পাঠালেন। সিধুর এই নতুন অবতারের সঙ্গে এঁটে ওঠা তাঁর কম্মো নয়।

ছবিঃ পার্থ মুখার্জি

More articles from this author

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা