সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

আজ সকাল থেকেই বাতাসে কেমন একটা ছুটি ছুটি গন্ধ। জল ঢালার কাজ শেষ করে মেঘগুলো হাল্কা মনে ভেসে বেড়াচ্ছে। আকাশটা কী-ই-ই নীল। সেই নীলের আভায় নিচের পৃথিবীও ঝলমল করছে। এখানে ওখানে কাশের বন সব্বাইকে জানান দিচ্ছে পুজো এসে গিয়েছে। কাশবনের মধ্যে দিয়ে একটা সরু পায়ে-চলা রাস্তা। সেখান দিয়ে মুন্নি আসছিল তিড়িং তিড়িং করে নাচতে নাচতে। আজ তার মনে খুব আনন্দ। সে যে ক্লাসে আঁকার পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে। দিদিমণিরা জিজ্ঞেস করছিলেন কিভাবে সে এতো সুন্দর দৃশ্যটা এঁকে ফেলল। মুন্নির দিদিমণির কথা মনে হতেই সে হেসে ফেলল। আঁকতে এতো কষ্ট নাকি! এসব ছবি তো তার বুকের মধ্যেই ধরা থাকে। এই নীল আকাশ, সবুজ গাছগুলো, ভেজা কাক – সবাই যে তার বন্ধু। কেউ তো আর জানেনা, যে সে তার বন্ধুদের ছবিই আঁকে, ভালোবাসে তাদের ছবি আঁকতে।

কাশবন থেকে বেড়িয়ে মুন্নি দেখল একটা বেড়ালছানা মিঁউ মিঁউ করে কাঁদছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে তার মনে হল বাচ্চাটা বোধহয় তার মাকে হারিয়ে ফেলেছে। সে বাচ্চাটাকে হাতে তুলে নিল। একটু আদর আর হাতের উষ্ণতা পেয়ে বিড়ালছানাটা আবার বলে উঠল, মিঁউ। মুন্নি তাকে নিজের স্কুলব্যাগে ভরে ফেলল। মুন্নি এক সদ্যকিশোরী, কিন্তু এইসব মনুষ্যেতর প্রাণীর জন্য তার অনুভূতি বড়দের থেকেও বেশি। বাড়ি ফিরে সে মা’র কাছে ছানাটার জন্য একটু দুধ চাইল। তার মনে হল ওর খিদে পেয়েছে। মুন্নিদের অবস্থা খুব ভালো নয়, কিন্তু একমাত্র মেয়ে বলে মা তার সব আবদারই সাধ্যমত রাখার চেষ্টা করেন। মুন্নি ভেবেছিল, মা খুব বকবেন। কিন্তু মা কিছুই না বলে তার কথাটা রেখে যে খানিকটা দুধ দিয়ে দিলেন, সেজন্য মাকে জড়িয়ে ধরে সে মার গালে সশব্দে চুমু এঁকে দিল।

মাসি এসেছিলেন সন্ধ্যেবেলা মার সঙ্গে গল্প করতে। গলায় কাপড়ের পাড় বাঁধা ছোট্ট বিড়ালছানাটাকে মিঁউ মিঁউ করতে দেখে বললেন, “ম্যাগো, এটাকে আবার কোত্থেকে তুলে আনলি?” মাসি বিড়াল একদম সহ্য করতে পারেননা। মা একটু হেসে জবাব দিলেন, “মুন্নি থাকতে এসব উৎপাত আসবার জন্য কারণ দরকার হয় নাকি?” এমন সময় মুন্নি ঘরে ঢুকল। মাসি তাকে দেখে বললেন, “মুন্নিরে, শেষে বাঘের মাসিকে ঘরে আনলি?” সে জানে মাসির বিড়ালের প্রতি বিরাগের কথা। সে কোনো মন্তব্য না করে ঘরে ঢুকে গেল। তবে একটা কথা জেনে তার খুব মজা লাগল যে বিড়াল হল বাঘের মাসি। বাঃবা, বাঘ! রাতে শুতে যাবার সময় বিড়ালছানাটাকে আদর করে কৌতুকের সুরে বলল, “নমস্কার, বাঘের মাসির ছেলে!” – তারপর ঘুমিয়ে পড়ল। সেই রাতে মুন্নি একটা স্বপ্ন দেখল। অচেনা বনের পথে সে একা চলেছে। সঙ্গী শুধু বিড়ালটা, এখন আর যেন ঠিক ছানা নেই, বড় হয়ে গেছে। এমন সময় হালুম শব্দে সে চমকে উঠল। পাশের জঙ্গল থেকে বেড়িয়ে এল ইয়াব্বড় গোঁফওলা এক কেঁদো বাঘ। পথ আগলে সে বলল, “মাসতুতো ভাই, কোথায় চলেছো? সঙ্গে ওটি কে?” বাঘের জিভ থেকে দু’ফোঁটা জল টপ করে ঝরে পড়ল। “মানুষ মানুষ গন্ধ লাগছে যে!” বাঘটা জিভটা সড়াৎ করে একবার গোঁফের উপর বুলিয়ে নিল। বিড়ালটি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “না না, ও খুব ভালো মেয়ে। আমার বন্ধুর সঙ্গে তোমার এ কি ব্যবহার, কি ভাবনার ছিরি, দাদাভাই?” চোখ পাকিয়ে সেও গোঁফ ফুলিয়ে উঠল। বাঘ বলল, “তুমি কি জানো, ওরা কত খারাপ, কত নিষ্ঠুর? আমরাও হিংসা করে খাই, কিন্তু সে শুধু পেট ভরাবার জন্য। পেট ভরে গেলে আর কাউকে মারি না। আর মানুষ? অকারণে প্রাণীহত্যায় ওদের বড় আনন্দ।” বাঘের কথা শেষ না হতেই বিড়াল ঝামড়ে উঠল, “আমায় ছোট পেয়ে যা খুশী তাই বুঝাচ্ছো? কে কি করে আমি জানি না, আমার বন্ধুকে কিছু করলে আমি কিন্তু মাকে বলে দেব আর তোমার এমন হাল করব না...” মুন্নি তো ভয়ে কাঁপছিল। বিড়াল তাকে নিয়ে বীরদর্পে চলতে শুরু করল।

এমনিতে মুন্নির গাছপালা খুবই ভাল লাগে। তাই একটু বাদেই সে ভয় ভুলে গেলো। তার গলা দিয়ে গুনগুন করে গান বেড়িয়ে এল। কিন্তু তার কপাল মন্দ। বলা নেই কওয়া নেই, পথ জুড়ে দাঁড়াল এক মস্ত দাঁতাল হাতি। পুঁচকে বেড়াল কথা বলবে কি, ভয়ে মিঁউ বলাই ভুলে গেল। মোটা গলায় হাতি বলল, “এ বনে কি করছিস রে? দেবো নাকি পা দিয়ে চেপ্টে?” এবার কিন্তু মুন্নি ভয় পেল না। সে চিড়িয়াখানায় খোলা জায়গায় হাতি দেখেছিল। আদরও করেছিল। সে একটু এগিয়ে এসে হাতিটার শুঁড়ের ওপর হাত বুলিয়ে বলল, “হাতিদাদা ভালো আছো?” হাতিটা একটু থতমত খেয়ে গেল। সে ভেবেছিল মুন্নিকে সে খুব ধমকে দেবে, কারণ সে জানত মানুষ তার জাতভাইদের ফাঁদ পেতে ধরে। তখন ওরা যে কত কষ্ট পায় সেটা মানুষ কখনও বোঝে না। লোকালয়ে নিয়ে গিয়ে তাদের দিয়ে সবরকম কঠিন পরিশ্রমের কাজ করায়। ঠিক মত খেতে দেয় না। হাতিটার সবচেয়ে রাগ হয় যখন সে দেখে যে সেই পোষা হাতিদের দিয়ে মানুষ বুনো হাতি ধরতে পাঠায়। তাই আজ সে ভেবেছিল এই মানুষছানাটাকে শুঁড়ে তুলে লোফালুফি করে এমন শিক্ষা দেবে... কিন্তু মুন্নির আদর পেয়ে সে এসব কিছুই করতে পারল না, তার খুব লজ্জা হল। মুন্নি বলল, “আমরা তোমাদের এখানে এসেছি সবার সাথে ভাব জমাতে। হাতিদাদা, তুমি কি একটু সাহায্য করবে?” “নিশ্চয়, নিশ্চয়,” বলে হাতি শুঁড় দিয়ে তাদেরকে পিঠে বসিয়ে নিল। তারপর একটা খোলা জায়গায় এসে শুঁড় তুলে ভীষণ আওয়াজ করে সবাইকে ডাকল। হাতিটা ছিল বনের রাজা। তাই তার ডাকে যে যেখানে ছিল, তাড়াতাড়ি হাজির হল।

এক জায়গায় এতো জন্তু দেখে মুন্নি ফূর্তিতে হাততালি দিয়ে উঠল। হাতির পিঠে উঁচুতে বসে তার আর ভয় ছিল না। সে সবাইকে হাত জোড় করে নমস্কার জানাল। বলল, “আমি তোমাদের বন্ধু হতে এসেছি।” এক হনুমান এগিয়ে এসে বলল, “তোমরা মানুষরা বন কেটে উজাড় করে দিচ্ছ। আমাদের খাবার নেই, থাকার জায়গা নেই। লোকালয়ে গেলে জোটে খালি পিটুনি। কেন আমরা তোমাদের বন্ধু হব?” একটা জিরাফ আর বুনো ঘোড়া একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, “এবার আমরা একসঙ্গে মানুষকে আক্রমণ করব। দেখি কার জোর বেশি।” মুন্নি কেঁপে উঠল। সত্যিই তো, সমস্ত জন্তু জানোয়ার যদি একসঙ্গে মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তবে তো হয়ে গেল। সে তাদের স্কুলের বড়দিমণির মত হাত তুলে গলা ঝেড়ে বলল, “বন্ধুরা, আমাদের ওখানে অনেকে আছেন, যারা তোমাদের জন্য ভাবেন, চেষ্টা করেন কিছু করতে। আমি তাঁদেরকে বলব এই কথা। নিশ্চয় একটা ব্যবস্থা হবে। তোমরা ভয় পেয়োনা।” জন্তুরা ঘন ঘন মাথা নেড়ে, ফোঁস ফোঁস করে কেউ সন্তোষ, কেউ বা অসন্তোষ জানাল। শেষে হাতি বলল, “এই বন্ধুটির কথায় খানিকটা ভরসা করা যাক। সত্যি কথা বলতে কি, একে অন্যকে খতম করে বেঁচে থাকা যায় না। মানুষ আর জন্তু – এই দুই-এ মিলেই তো পৃথিবী সুন্দর। এখানে সকলেরই বাঁচবার অধিকার আছে। আমি জানি আমাদের শক্তি অনেক বেশি, কারণ আমরা সংঘবদ্ধ । তাই আমরাই নাহয় মানুষকে আরেকটা সুযোগ দিলাম।” এবার সকলে হৈ হৈ করে হাতিকে সমর্থন করল।

বনের পথে মুন্নি আর তার ছোট্ট সাথী ফিরে চলেছে। হঠাৎ মুন্নিকে কেউ এক ধাক্কা দিল আর জায়গাটা আলোয় ভরে উঠল। সেই আলোয় হাতি সমেত সমস্ত জন্তুরা ফ্যাকাশে হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। চোখ মেলে মুন্নি দেখল সকাল হয়ে গেছে। মা পর্দা সরিয়ে দেওয়াতে সূর্যের আলো তার চোখে এসে পড়েছে। ধড়মড় করে উঠে সে বুঝল সে স্বপ্ন দেখছিল। দারুণ তো স্বপ্নটা, সে ভাবল, কিন্তু ভীষণ সত্যিও বটে। সামনেই তাদের স্কুলের বার্ষিক উৎসব। সে তার ছবির বিষয় পেয়ে গেছে। বন্য প্রাণীদের এই আবেদনই সে তুলে ধরবে সব বিশিষ্ট অভ্যাগতদের সামনে।

শুক্তি দত্ত ভালবেসে প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। রূপকথা, প্রাচীন সাহিত্য, দেশবিদেশের লোকসাহিত্য, গল্পকথা পড়তে ভালবাসেন। সেগুলো নিয়ে আলোচনা বা শিশুদের সেই গল্প শোনাতেও ভালবাসেন। প্রধানতঃ শিশুমনস্তত্ত্ব ও তাদের শিক্ষাসংক্রান্ত কাজে দীর্ঘকাল কাটিয়েছেন। সেটা শুধু পড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; তিনি শিশু সাহিত্য, লোকসাহিত্য প্রভৃতিকে তাদের মূল্যবোধ বিকাশে কাজে লাগাতে চান।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা