সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

(৬)

বাইরে বৃষ্টিটা আরেকটু কালো হয়ে নামল যেন। শব্দটা জানলার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকছিল। কিন্তু সেই শব্দ কোন ভাবেই রাতুলকে নড়াতে পারছিল না। তার দুটো চোখ কখন থেকে সেই এক জায়গায় বসে আছে। তার নড়চড় নেই। একটা কাঁচের বাক্স, টলটল করছে নীল জল, আর তার মধ্যে লাল রঙের ছোট্ট একটা প্রানি।

যেদিন বাবা জেলিকে এনেছিল, সেদিন বাবার সাথে আরও একজন কাকু এসেছিল। অনেক কিছু কাজ করেছিল যেমন অ্যাকোয়ারিয়ামটাকে সাজানো, লাইট লাগানো। জেলি ওই কাকু টার হাত থেকে টপ করে ডাইভ মেরে জলে নেমেছিল। জেলি সেই একই রকম দেখতে লাগে যেদিন থেকে তাকে আনা হয়েছিল। আচ্ছা জেলি কি বড় হচ্ছে না? নাকি রাতুলের ছোট্ট ছোট্ট চোখে সেটা ধরা পড়ছে না।

জেলি না থাকলে ওই কাঁচের বাক্সটা খালিই থাকবে। জেলি না থাকলে রাতুল তার কথা বলার সঙ্গীটাও হারাবে। তাহলে কাকে বলবে সে দেবলিনার কথা, তার স্কুলএর দুষ্টু বন্ধুদের কথা, মা-এর বন্ধুটার কথা। মাঝখানে একটা ফাঁক তৈরি হচ্ছিল। আস্তে আস্তে রাতুলের চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে আসছিল। গালের উপর ঠাণ্ডা শীতল জলের ছোঁয়া লাগছিল। রাতুল আস্তে করে চোখ মুছে নীল আলোর দিকে এগিয়ে গেল।

“তুই আমার চিন্তা করিস না”
রাতুলের একটা হাত তখনও চোখ থেকে জলের শেষ বিন্দুটাকে সরাতে ব্যস্ত। সে এখন দুটো পা ভাজ করে কাঁচ বাক্সটার সামনে বসেছে। তার দুটো হাত তখন কাঁচের উপর আদর করছে।
“তুই ওখানে অনেক বন্ধু পাবি, ওটা অনেক বড় জায়গা। তোকে এই ছোট্ট জায়গায় আর থাকতে হবে না”।
জেলি তখন নিস্পলক দৃষ্টিটে রাতুলের দিকে তাকিয়ে। ও, মাছের তো চোখের পাতা হয় না। তাই তাদের দৃষ্টি নিস্পলক হয় স্বাভাবিক ভাবেই। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছিল জেলি রাতুলের প্রত্যেকটা কথার অর্থ খুঁজে পাচ্ছে।
রাতে ঘুমের ঝাঁপটা একটু দেরিতেই এল। শুয়ে শুয়ে একটা চিন্তাই মাথার এপাশ ওপাশ টহলদারি করছিল। কি করে জেলিকে ওই পুকুরে ছেড়ে আসা যায়? এই ভাবনাতে ডুবেই ঘুমের দেশে কখন হারিয়ে গেছিল রাতুল বুঝতে পারেনি।

প্রত্যেক দিনের মতো মায়ের ডাকাডাকিতে চোখ খুলল রাতুলের। বাড়িতে ততক্ষণে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। বাবার ডাকাডাকি, মায়ের দৌড়াদৌড়ি, গীতা পিসির রান্নাঘরে হাতা-খুন্তি নিয়ে নাচানাচি। কিন্তু যখন এই আওয়াজ গুলো সরল, তখন রাতের চিন্তাটা তার মাথাটা জুড়ে বসল।
হঠাৎ মা ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকল,
“বাবাই তাড়াতাড়ি ব্রাশ করে নাও, আমি ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছি”।

ব্যাগ, হ্যাঁ ব্যাগটাই তো। এটাই তো হতে পারে। ব্যাগে ভরে জেলিকে নিয়ে গেলে কেমন হয়? কেউ দেখতে পারবে না তাহলে। ব্রাশ করতে করতে রাতুল দেখে নিচ্ছিল ঘরের ঠিক কোথায় একটা ছোট্ট প্লাস্টিক আর রাবার ব্যান্ড পাওয়া যাবে। এবার শুধু জেলিকে ভরার পালা।

(৭)

নীল ব্যাগটা দুলছে। এদিক থেকে ওদিক রাতুলের পীঠে। ভেতরে জেলিও। এই প্রথমবার জেলি অ্যাকোয়ারিয়াম থেকে বাইরে এসেছে। রাতুল ইচ্ছে করে ব্যাগের অর্ধেকটা খুলে রেখেছে যাতে বাইরের টুকরো টাকরা ছিটে জেলির চোখেও পড়ে। এখান দিয়ে পুকুরটা অর্ধেক দেখা যাচ্ছে। রাতুল এবার একটু জো্রেই হাঁটা শুরু করল, দেরি হলে বাসটা হাতছাড়া হতে পারে। মায়ের সাথে জেদ করে, জোর করে চোখের জল বের করে একা বেরিয়েছে এই বলে যে আজ সে শুভমের বাড়ি হয়ে শুভমের সাথে বাস ধরবে। এতক্ষণে সে শুভমের বাড়ি ছাড়িয়েও চলে এসেছে। রাতুল এবার পুকুরের ঘেরাটোপের ভেতর দাড়িয়ে ছোট্ট বাঁশের খুঁটিটার উপর ভর দিয়ে। আর এক হাতে নিজের পীঠের ব্যাগটা ধরে। এবার ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে দুহাতের মাঝখানে জড়িয়ে ধরল। টুক করে ব্যাগের অন্ধকার ভেতরটাও চোখ বুলিয়ে নিল। কি হবে যদি যদি জেলির একটাই বন্ধু থাকে? কি হয়েছে ওকে ওই ছোট্ট জায়গায় থাকতে হবে? আমি ওর সাথে সব সময় থাকব। কোন সময় ঝগড়া করব না। ব্যাগের খোলা চেনটায় হাত গেল রাতুলের। ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ব্যাগের চেনটা বন্ধ হল।

(৮)

কল দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে। সাদা বেসিনে সাদা জল মিশে যাচ্ছে। ছোট্ট ছেলেটার মুখের ঠোঁটের উপরটুকুই দেখা যাচ্ছে সুসজ্জিত আয়নাতে। ব্রাশটা তার মুখে একই জায়গায় আটকে আছে। তার উজ্জ্বল চোখ দুটো আয়নায় যেন খুঁজে বেরাচ্ছে।
“মহুয়া, প্রদীপের নাম্বারটা কোথায়?”
“কে প্রদীপ?”
“আরে মাছের লোকটা গো, এতদিন হয়ে গেল। ওকে একবার ডেকে অ্যাকোয়ারিয়ামটা পরিষ্কার করিয়ে নি”।
কথাগুলো রাতুলের কানে ঝনঝন করে বেজে উঠল। মুখ ধুতে গিয়ে তাড়াহুড়োর চোটে দুবার ব্রাশটা বেসিনেও পড়ে গেল।
পাপা অ্যাকোয়ারিয়াম পরিষ্কার করাবে? আর যখন খুঁজে পাবে যে সেখানে জেলি নেই তখন কি উত্তর দেবে রাতুল? প্রায় দৌড়ে আলোকিত কামরায় প্রবেশ করল সে। খালি নীল অ্যাকোয়ারিয়ামটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে খাটের কোণে জায়গা করে নিল ছোট্ট শরীরটা। ভয়ে তার পেটের ভেতর চিনচিনে ব্যাথাটা আরও পাকিয়ে পাকিয়ে উপরে উঠতে শুরু করছিল। ভয়ে সে চাদরটাকে আরেকটু জোরে কষে ধরল। আর তখনই এক পূর্ণবয়স্ক মানুষের প্রবেশ। সে টেবিলে রাখা কাগজের স্তূপের মধ্যে কিছু হাতড়াচ্ছিল।
“পাপাই জেলি নেই”
তখনও তার হাত আটকায়নি।
“পাপা আমি জেলিকে ছেড়ে দিয়ে এসেছি”
সেই পূর্ণবয়স্ক শরীরটা এবার পুরো ৯০ ডিগ্রি ঘুরে গেল।
“কি-ই-ই-ই-ই...কোথায়?”
এই চমকানো আওয়াজটা রাতুলকেও যেন একটু চমকে দিল। তার মুখে কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল।
“পাপা জেলি এখানে একা, একা-একাই থাকে, কোন ফ্রেন্ড নেই। তাই পাপা আমি জেলিকে ওর ফ্রেন্ড দের কাছে ছেড়ে এসেছি, পুকুরে”।
রাতুলের বাবার মুখে অবাক ও বিস্ময়ের এক আলোছায়াময় চিত্র অঙ্কিত হচ্ছিল। কিন্তু সেটা রাতুল দেখতে পাচ্ছিল না। সে তখন লাল চাদরে সাদা ফুল গুনছিল। তার চোখের জলের ভারে গলাটাও নুইয়ে পড়েছে। রাতুল অনুভব করল তার পাশে বিছানার জায়গাটা কিছুটা বসে গেছে। একটা হাত এসে তার মাথায় আলতো করে ছোঁয়া রাখল। রাতুল এবার মুখ তুলেছে। ঝাপসা ঝাপসা দেখছে সব কিছু। ঘরের সাদা লাইটটা আরও জোড়াল মনে হচ্ছে।
“পাপা কি খুব রেগে আছে?”
রাতুল একবার চোখটা বন্ধ করে খোলার চেষ্টা করল। এবার একটু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
পাপার একটু ঠোঁটে হাসি লেগে আছে। পাপার হাতটা বার বার মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছিল। বেশ আরামই লাগছিল রাতুলের।
“রাতুল.........”
ক্ষণিকের জন্য মনে হল বাবার রাগ এবার ফুলে ফেপে উঠবে। রাতুলের বিছানার আরেকটা কোণায় সরে যেতে ইচ্ছে করল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পাপার মুখে হাসি ফুটে উঠতেই তার ভয়টা যেন ধুপকাঠির ধুঁয়োর মতো পরক্ষণেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
“রাতুল তোমাকে কে বলেছে জেলির বন্ধুরা পুকুরে থাকে?”
“কেউ বলেনি পাপা, সেদিন টিভিতে দেখাচ্ছিল জেলির মতো অনেক মাছ বড় জলে থাকে, সেখানে খেলে বেড়ায়। কিন্তু পাপা জেলি এখানে একদম একা ছিল। আর এই ছোট্ট জায়গায় ও ঠিক করে খেলা করতেও পারত না। তাই আমি ওকে পুকুরে ছেড়ে দিয়েছি”।
রাতুলের চোখ দুটো তখনও নিম্নগামী। কিন্তু তার পাপার চোখ এখনও রাতুলের উপরই বসে আছে। রাতুলের পাপা ভাবছিল ওর এই কথাগুলো কি ওর শরীরের বাড়ন্ত হিসেবে ঠিক বসে!
রাতুলের মুখে যে অভিব্যাক্তি ছিল তা একটু অচেনা ছিল। সে হয়তো বিশ্বাস করতে পারছিল না যে এখনও অবধি তার পাপা একবারও গলা চড়িয়ে তার সঙ্গে কথা বলেনি।
“রাতুল তুমি কি জানো জেলি সমুদ্রর মাছ”।
রাতুল উৎসাহের হাওয়ায় তার শরীরটা ঘুরিয়ে তার পাপার আরও কাছে চলে এসেছে।
“হ্যাঁ আমি জানি, সেদিন আমি টিভিতে দেখেছি, জেলির মতো অনেক মাছ ওশেন-এ সুইম করছিল। তাই তো আমি জেলিকে......”
রাতুলের শব্দগুলো মাঝ পথেই আটকা পড়ল।
“রাতুল জেলি পুকুরে থাকতে পারবে না। জেলি সমুদ্রের মাছ, সল্ট ওয়াটার, পুকুরের জল মিষ্টি হয়”।
“তাতে কি হয়েছে পাপাই? জেলি তো জলে থাকে”।
“রাতুল জেলির বডি, সী ওয়াটার-এর জন্য তৈরি, পুকুরের জলের জন্য না”।
“মানে?”
“মানে জেলি পুকুরে বাঁচতে পারবে না”।
রাতুলের চোখ থেকে পড়া জলের ফোঁটাটা চাদরের একটা ফুলের প্রায় অর্ধেকটা ভিজিয়ে দিল। রাতুলের বাবা তখনও কিছু বলে যাচ্ছে। কিন্তু সেই কথা গুলো রাতুলের কান অব্দি গিয়ে আবার ফিরে আসছে। রাতুল শুধু দেখতে পাচ্ছে জেলি প্লাস্টিকটা ছেড়ে পুকুরের জলে চলে যাচ্ছে। সে একবার চোখ তুলে খালি নীল রং-এর অ্যাকোয়ারিয়ামটা দেখে নিল।
“রাতুল এবার চলে এস, ঘুমনোর সময় হয়ে গেছে”।
রাতুল এখনও চোখ সরায়নি। নীল জলে ভরা বাক্সটা আজ অচল, স্থির। যেমন স্থির রাতুলের চোখ দুটো।

দীপশিখা তরফদার পেশায় লেখক ও সাংবাদিক, সহ-সম্পাদক হিসেবে কলকাতার একটি প্রকাশনা সংস্থায় কর্মরত। বইয়ের দুনিয়ায় বিচরণে সর্বদা আগ্রহী ও কল্পনার জগত সব সময় হাতছানি দেয় তাঁকে। ফাঁক পেলেই সাদা কাগজ লিখে ভরিয়ে দেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা