সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
কৃষ্ণকল

(১)

কৃষ্ণকলিকে প্রথমের দিকে দেখতেই পায় নি হিয়া।মানে দেখতে হয়তো পেয়েছিল কিন্তু একেবারেই খেয়াল করেনি কারণ আর পাঁচটা সাধারণ কাকের মতনই দেখতে তাকে। সেদিন স্কুল থেকে ফিরে খেয়েদেয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল হিয়া তখন দেখতে পেল একটা কাক ব্যালকনির রেলিঙয়ের ওপর বসে রয়েছে।অন্য সময় ওখানে পাখি বসে থাকলে তারা হিয়াকে দেখেই পালায় কিন্তু এই কাকটা ওকে দেখেও নড়ল না। যেখানে ছিল সেখানেই বসে বসে হিয়াকে আপাদমস্তক দেখতে লাগল। হিয়া অবশ্য সেই সব গ্রাহ্য না করে নিচে দেখছিল। রাস্তা দিয়ে কত লোকজন হেঁটে যাচ্ছে, রিক্সা যাচ্ছে প্যাঁক প্যাঁক করে।

হঠাৎ হিয়া শুনতে পেল কে যেন বলছে,"তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না হিয়া!"

হিয়া চমকে এদিক ওদিক তাকাল। কে কথা বলছে রে বাবা? মা বাবা দুজনেই তো অফিসে আর মিতামাসি ঘরে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে! চারিদিকে দেখার চেষ্টা করল হিয়া কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না।

"আরে বাবা আমি এই তো ব্যালকনির রেলিঙের ওপর বসে আছি, আমাকে দেখতে পাচ্ছ না?"

হিয়া মুখ হাঁ করে কাকটাকে দেখল। কোন কাক যে মানুষের মতন কথা বলতে পারে সেটা ওর জানা ছিল না! মানে সত্যি কথা বলতে গেলে কাকেদের তো কথা বলার কথা নয়, তারা তো শুধু কা কা করতে পারে!

"তুমি কথা বলতে পারো?"
"কী রকম বেয়াক্কেলে প্রশ্ন রে বাবা! এই যে তোমার সঙ্গে কথা বলছি সেটা কানে ঢুকছে না? আমি যদি কথা না বলতে পারি তাহলে এই কথাগুলো কোথা থেকে আসছে শুনি? রেডিও থেকে? আমি কথা বলতে পারি, গান গাইতে পারি অনেক কিছু করতে পারি!"
"তা তুমি আমার নাম জানলে কী করে?"
"নাম না জানাটাই বরং আশ্চর্যের হবে! সারাদিন ধরে তোমার মা, বাবা, মিতামাসি ‘হিয়া’ হিয়া’ করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কানের পোকা নাড়িয়ে ফেলে রোজ আর আমি তোমার নাম জানব না! আমি তো রোজই এখানে বসে থাকি। সব দেখি, সব শুনি।"
ওর কথা শুনে হিয়া অবাক হয়ে বলল,"আর তোমার নাম কী? তোমার নাম বুঝি কাক?"
"না, না, আমার নাম কাক হবে কেন? তোমার নাম যখন মানুষ নয় তখন আমার নামই বা কাক হতে যাবে কেন? আমার নাম কৃষ্ণকলি! ও হ্যাঁ, তুমি উল্টো পাল্টা কথা শুরু করার আগে যা বলছিলাম সেটা হল তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না!"
"কেন আমি কী করেছি?"
"আজকে ক্লাসে তুমি কার পাশে বসেছিলে?"
"স্নেহার পাশে, কেন?"
"স্নেহা আজকে পেন্সিল বক্সের মধ্যে খামে করে কী এনেছিল?"
"টাকা! কিন্তু সেটা তুমি জানলে কী করে?"
"আরে বাবা আমার কাছে কোন কিছু লুকিয়ে লাভ নেই, আমি সব জানি, ও যে টাকা নিয়ে এসেছিল সেটাও!"

হিয়া বলল,"স্নেহা টাকা এনেছিল তাতে আমার কী?" "আরে বাবা গত সপ্তাহে ওই দোকানটায় তুমি কী দেখেছিলে? যেটা নিয়ে মন খারাপ করে বাড়ি ফিরেছিলে?"
"ও, তুমি ওই পুতুলটার কথা বলছ? হ্যাঁ, দোকানের ওই পুতুলটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল কিন্তু মা বাবা কিছুতেই ওটা কিনে দিতে রাজি হলেন না। বললেন ওটার প্রচুর দাম! অত দামি পুতুল কেনার নাকি কোন মানেই হয় না! তাতেই আমার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল কারণ পুতুলটা সত্যিই আমার খুব ভাল লেগেছিল।"
"ওই দেখো! তাহলেই বোঝো! তুমি যদি টুক করে স্নেহার ওই টাকার খামটা নিয়ে নিতে তাহলে ওই রকম হয়তো পাঁচটা পুতুল তুমি কিনে নিতে পারতে মা বাবার সাহায্য ছাড়াই!"
ওর কথা শুনে আঁতকে উঠল হিয়া,"তোমার কী মাথা খারাপ? অন্যের জিনিস না বলে নেওয়াটাকে চুরি করা বলা হয় জান না? চুরি করা খুব খারাপ কাজ! নাই বা পেলাম ওই পুতুলটা, আমার অন্য পুতুল তো আছে! আর স্নেহা ওই টাকাটা স্কুলের ফিস দেওয়ার জন্যে এনেছিল!"
"তাতে কী আছে, একবার ফিসের টাকা হারিয়ে গেলে আবার নিয়ে আসত!"

হিয়া রেগে গিয়ে বলল, "তুমি দেখছি খুবই বাজে কাক! আমাকে ভুলভাল সব কাজ করার শিক্ষা দিচ্ছ! যাও আমি তোমার সঙ্গে আর কথা বলব না!" বলে হিয়া দুম দাম পা ফেলে ঘরের ভিতর চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর বাইরে উঁকি মেরে দেখল, নাহ, কৃষ্ণকলি আর নেই, চলে গেছে।

(২)

দুপুরবেলার এই সময়টা হিয়ার খুব একা লাগে, খুব বোর হয় তাই পরদিনও ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল সে। কৃষ্ণকলি আবার এসেছে! আগের দিন ভালো করে লক্ষ করেনি হিয়া কিন্তু আজ দেখল কৃষ্ণকলির লেজের কয়েকটা পালক সাদা।

হিয়াকে দেখে সে বলল,"কী হিয়া রানি, কেমন আছো?"
"আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?"
"এই রকম দিনকালে যতটা ভালো থাকা যায় সেরকমই আছি আর কী! তা আজ স্কুলে লাঞ্চের সময় তুমি রেশমিকে নিজের খাবার খেতে দিলে কেন?"
"ও নিজের লাঞ্চ বাক্স বাড়িতে ভুলে গিয়েছিল তাই দিলাম! নাহলে ওকে না খেয়ে থাকতে হত!"
"তুমি বড্ড বোকা মেয়ে! মনে নেই গতবার যখন তুমি খাবার নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলে তখন ও ভালো খাবার এনেছিল বলে তোমাকে মোটেই দেয়নি তাও তুমি আজ ওকে দিলে?"
"তাতে কী হয়েছে। সেবার ও দেয়নি কিন্তু মল্লিকা তো দিয়েছিল তাই আজকে আমি দিলাম। বেশ করেছি দিয়েছি! একশোবার দেবো! আমি ঘরে যাচ্ছি! তুমি দুষ্টু কাক! রোজ রোজ এসে বাজে কথা বলে আমার মুড খারাপ করে দাও!"

(৩)

একদিন পর আবার কৃষ্ণকলির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল হিয়ার। তখন সে জিজ্ঞেস করল,"আচ্ছা একটা কথা বলো, তুমি সব সময় বাজে বাজে কথা বলো কেন আমাকে? ভালো কথা বলতে বুঝি ভালো লাগে না?"
কৃষ্ণকলি যেন শুনতেই পায়নি এমন করে বলল,"আজ তো তুমি তোমার সেই মোটা বন্ধুটার বাড়িতে যাবে ওর জন্মদিনের পার্টিতে তাই না?"
"কী? কী বললে?"
"কেন যেটা ঠিক সেটাই তো বললাম, তোমার হাতির মতন মোটা বন্ধুটার জন্মদিন তো আজকে!"
হিয়া গর্জে উঠল,"খবরদার সুমিকে মোটা হাতি বলবে না! তুমি জান না – তোমার মা বাবা তোমাকে শেখায়নি যে ওই রকম করে কথা বলা খুব খারাপ?"
"ও তাই নাকি? আমি তো ভাবছিলাম ওটাই সত্যি কথা! মোটাকে মোটা হাতি বলব না তো কী রোগা শুঁটকেকে বলব?"
"না, ওই রকম বলতেই নেই! ওর যা নাম সেই নামেই ডাকবে ওকে! আমি যদি তোমাকে কৃষ্ণকলি না বলে কুচকুচে কালো কাক বলি তাহলে তোমার কী রকম লাগবে?আর জেনে রাখো যে সুমির শরীর খারাপ ছিল আর সেটার জন্যে ওষুধ খেয়ে ও ওই রকম হয়ে গেছে! ও মোটেই বেশি খায় না!"
কৃষ্ণকলি মাথাটা একদিকে করে ভাবতে লাগল। তখুনি ঘরের ফোনটা বেজে উঠল তাই হিয়াকে যেতে হল। মার সঙ্গে কথা বলে যখন সে ব্যালকনিতে ফিরে এল তখন দেখল কৃষ্ণকলি চলে গেছে।

(৪)

শনি রবিবার মা বাবা বাড়িতে ছিলেন বলেই বোধহয় কৃষ্ণকলি এল না।

সোমবার দিনও তাকে দেখতে পেল না হিয়া। সেদিন আবার ওদের স্কুলে পেরেন্ট টিচার মিটিং ছিল। বিকেলবেলা মা বাবা অফিস থেকে ফিরতে তাদের কাছে প্রচন্ড বকুনি খেলো হিয়া। ওর রেজাল্ট খারাপ হচ্ছে, ও নাকি পড়াশোনায় মন দিচ্ছে না এই সব অনেক কথা বলেছেন ওর টিচার। এমনকি এও বলেছেন যে ও অঙ্কের টেস্টে কুড়িতে সাত পেয়েছে এবং ওই রকম ভাবে চললে ওকে এই ক্লাসেই আরেক বছর থাকতে হবে! মা-বাবা তো সেটা শুনে খুব ঘাবড়ে গেছেন। ওঁদের মনে হয়েছে ওনারা সারাদিন অফিসে থাকেন বলে হিয়া টিভি দেখে আর এটা সেটা করে বেড়ায়, পড়াশনা করে না। বাবা বললেন ওনার অফিসের রঞ্জিতকাকুর মেয়ে নাকি হোস্টেলে থেকে দারুণ ভাল রেজাল্ট করছে তাই হিয়াকেও হোস্টেলে পাঠিয়ে দিলে ভালো হবে! মা যদিও সেটাতে রাজি হলেন না তাও সেটা শুনেই হিয়ার বুক ধুকপুক করতে শুরু করল। মা বাবা বকে চলেছেন আর হিয়া হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে। একটু পরে মা বাবা হিয়াকে বাড়িতে রেখে পাশের বাড়ির গুপ্ত দাদুকে দেখতে গেলেন। দাদুর শরীরটা একটু খারাপ হয়েছে তাই।

হিয়া একা একা বসে বসে কাঁদছিলএমন সময় দরজায় বেল পড়ল।

কৃষ্ণকল

মা বাবা ফিরে এলেন ভেবে দরজা খুলে ফেলল হিয়া। ওমা একটা সুন্দর দেখতে মেয়ে ঝলমলে জামা পরে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওদের দোর গোড়ায়। হাওয়াতে তার লম্বা কালো চুল অল্প অল্প উড়ছে।

হিয়া ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল,"কে তুমি? কী চাও? মা বাবা কেউ বাড়িতে নেই বটে কিন্তু আমি চেঁচালেই পাহারাদার কাকু ছুটে আসবে।"
"আমাকে চিনতে পারছ না? আমার নাম কৃষ্ণকলি। আমি কী ভিতরে আসতে পারি?"
হিয়া হাঁ করে মেয়েটাকে দেখছিল। এ আবার কে? কৃষ্ণকলি তো কাক!
চোখের জল মুছে হিয়া মেয়েটাকে বলল,"তুমি বলছ তুমি কৃষ্ণকলি? তা কী করে হয়! কৃষ্ণকলি তো কাক! সে তো রোজ এসে ব্যালকনির রেলিঙয়ের ওপর বসে আর আমাকে রাজ্যের আজেবাজে কথা বলে!"

মেয়েটা ওর কথা শুনে মিষ্টি হাসি হেসে বলল,"হ্যাঁ, আমিই তো সেই কাক! আমি সুন্দরী আর পড়াশনায় ভালো ছিলাম বলে আমার মনে খুব অহংকার হয়ে গিয়েছিল! সবার সঙ্গে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করতাম আমি। সবাইকে সব সময় কুমন্ত্রণা দিতাম। সবার অনিষ্ট করতাম তাই সবাই আমাকে অপছন্দ করত। ওই রকম আমার প্রতি বিরক্ত হওয়া একজন কী একটা মন্ত্র পড়ে আমাকে কাক করে দিয়েছিল! সেটা হওয়ার পর আমি খুব কেঁদে কেটে তার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলাম। কাকুতি মিনতি করেছিলাম আমাকে আসল রূপে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে। সে তখন বলেছিল কেউ যদি আমার তিনিটে কুমন্ত্রণা শুনেও বাজে কাজ না করে তাহলে আমি আবার আমার আসল রূপে ফিরে আসতে পারবো। সেই থেকে আমি কাক হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি! যাকেই কুমন্ত্রণা দিই সে মহানন্দে সেটা শুনে নেয় এবং সেই মতন কাজ করে! তাই তো তোমার কাছে বার বার ছুটে আসতে হচ্ছিল আমাকে। তুমি ভারি ভাল মেয়ে হিয়া! তুমি আমার একটাও বাজে কথায় কান দাওনি!"

হিয়া তাও হাঁ করে তাকিয়ে আছে দেখে কৃষ্ণকলি বলল,"তুমি কিচ্ছু ভেব না। আমি নিজে রোজ দুপুরে এসে তোমাকে পড়িয়ে দিয়ে যাবো। তুমি আমার এত বড় উপকারটা করেছ আমি তোমার জন্যে এতটুকু করতে পারব না? দেখবে পরের পরীক্ষাতেই তোমার রেজাল্ট আমি পাল্টে দেবো! তোমার মা বাবা তখন আর তোমাকে বকতে পারবেননা মোটেই আর হোস্টেলেও পাঠাবেন না।তাছাড়া পরীক্ষায় নম্বর কম পেয়েছো তো কী হয়েছে? তুমিএকদিন ঠিক মানুষের মত মানুষ হতে পারবে!"

হিয়ার চোখে জল। আহ্লাদে আটখানা হয়ে সে কৃষ্ণকলিকে জড়িয়ে ধরল!


ছবিঃমহাশ্বেতা রায়

অনন্যা দাশ কর্মসূত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। নেশা বই পড়া আর গল্প লেখা। শিশুদের জন্যে সামাজিক গল্প ও কিশোরদের জন্যে রহস্য গল্প লিখতে ভালবাসেন। বাংলাতে প্রকাশিত অধিকাংশ শিশু কিশোর পত্রিকাতেই লিখেছেন কোন না কোন সময়ে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা