সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

হারাধনবাবুর ভীষণ ভুলোমন। এই ভুলোমন হওয়ার কারণে তিনি আজ পর্যন্ত একশো আটচল্লিশটি ছাতা, দু'শো ছাপান্নটি কলম, বাষট্টিটি চাবি ইত্যাদি হারিয়েছেন। হারানোর তালিকায় হারাধন বাবুর আরো কত কী রয়েছে তা তার মনে নেই। কেননা তাঁর ভীষণ ভুলোমন!

বাইরে বেরোনোর আগে হারাধনবাবু তার 'দেওয়াল-কাম-মনে করানো বোর্ডে'র দিকে তাকান। দেওয়াল-কাম-মনে করানো বোর্ড জিনিসটা হল তাঁর সারাদিনের কাজকর্মের সঙ্গী। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কোথায় যেতে হবে, সঙ্গে কি নিয়ে যেতে হবে, কার সঙ্গে দেখা করতে হবে সবই তিনি ঐ দেওয়াল নামক বোর্ডে চক দিয়ে লিখে রাখেন। কিছু কিছু জিনিস চক দিয়ে না লিখে কালি দিয়েও লেখেন। অফিসে বেরোনো আগে তিনি বড় করে লেখা তিনটি 'চ' অক্ষর ভালো করে দেখে নেন। প্রথম চ-এর অর্থ হল 'চিরুনি'। হারাধন বাবু স্নান সেরে ধোপদুরস্ত জামা কাপড় পরে খাবার টেবিলে চলে আসেন। খেয়ে দেয়ে অফিস বেরিয়ে গেলে তার মনে পড়ে, আরে চুলে যে চিরুনি চালানো হয়নি। উস্কো-খুস্কো চুল নিয়ে কি অফিসে যাওয়া চলে। বাধ্য হয়ে তিনি ফুটপাথ থেকে একটা চিরুনি কিনে চুল আঁচড়ে তবে অফিসে ঢোকেন। দ্বিতীয় চ-হল 'চশমা'। চশমা ছাড়া অফিসে যাওয়া মানেই ঘোর বিপত্তি। আর তৃতীয় চ হল 'চাবি'। যেটা হারাধনবাবু প্রায়দিনই অফিসে নিয়ে যেতে ভুল করেন। চাবি জিনিসটা তাঁকে বেশ ভোগায়। সকাল থেকে অফিসে যাবার তোড়জোড় করে নাকে-মুখে ভাত গুঁজে গলদঘর্ম হয়ে অফিসে পৌঁছে পকেটে হাত দিতেই দেখেন, চাবি আনতে ভুলে গেছেন। হারাধনবাবু অবশ্য বর্তমানে অফিসের একটা চাবি মানিব্যগের মধ্যে সবসময় ভরে রাখেন।এই মানিব্যাগের প্রসঙ্গ যখন এসেই গেল তখন মানিব্যাগ সংক্রান্ত ঘটনাটাও এখানে বলি ফেলি।

বিয়ের কিছুদিন পরেই হারাধনবাবু গিন্নিকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছেন। নতুন জামাই শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে বলে পোষাকটাও জমকালো হওয়া চাই। সকাল থেকে অনেক ভাবনা চিন্তা করে তিনি তসরের পাঞ্জাবিটি পরেই শ্বশুরবাড়িতে যাবেন বলে ঠিক করলেন। কিন্তু গাড়ি যখন ছাড়ছে সে সময় হারাধনবাবুর মনে হল, না এতটা রাস্তা তসরের পাঞ্চাবি পরে গেল পাঞ্জাবিটা ঘামে ভিজে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তিনি ঘরে এসে একখানা মিহি সুতোর পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে গাড়িতে চেপে বসলেন। গাড়িও ছেড়ে দিল। শ্বশুর বাড়িতে পৌঁছে ড্রাইভারকে গাড়িভাড়া মেটাতে গিয়ে দেখলেন পকেটে মানিব্যাগ নেই। থাকবে কোথা থেকে? গাড়ি ছাড়বার আগেই তো মানিব্যাগসুদ্ধু পাঞ্জাবিটা ঘরে খুলে রেখে এসেছেন। তারপর মানিব্যাগ ছাড়া সেখানে কি কি ঘটনা ঘটল তা আর না বলাই ভাল। সেই থেকে হারাধনবাবু তার ঘরের দেওয়ালে বড় বড় করে লিখে রেখেছেন 'বাইরে বেরোনোর আগে মানিব্যাগ সঙ্গে থাকা চাই।'

তবে দেওয়াল লিখন লিখেও যে নিস্তার নেই এটা তিনি একবার বেশ বুঝতে পেরেছিলেন। অভ্যেসমতো হারাধনবাবু একদিন দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখলেন 'আঠারই মার্চ' লেখাটি লাল কালিতে লিখে তিনি সেটার উপর একটা বৃত্ত এঁকে রেখেছেন। লেখাটি তার নিজেরই কিন্তু ঠিক কি কারণে আঠারই মার্চ লিখলেন্ তা আর মনে করতে পারলেন না। কারো জন্মদিন? বিয়েবাড়ি? না তো। কিছুতেই মনে আসে না। শেষমেষ অভয়কে ফোন করলেন। অভয় তার অনেক দিনের বন্ধু। নিশ্চয়ই ঐদিন তার ছেলের উপনয়ন। কিন্তু ফোন করে জানতে পারলেন উপনয়নের এখন দেরি আছে। তাহলে? এদিকে পনেরই মার্চ এসে গেল। অথচ আঠারই মার্চ ঠিক কিসের অনুষ্ঠান তা হারাধনবাবুর কিছুতেই মনে পড়লনা। শেষে সতেরই মার্চ রাত সাড়ে এগারোটায় বিষ্ণুপুর থেকে তার বন্ধু ঋষির ফোন পেলেন। আর তখনই তিনি বুঝতে পারলেন ঘুম থেকে উঠেই তাঁকে ট্রেন ধরতে হবে। পুরী যাবার প্রোগ্রাম আঠারই মার্চ নিজেরাই ঠিক করছিলেন। বলাই বাহুল্য, হারাধনবাবু সেবার বন্ধুদের সঙ্গে পুরী বেড়াতে যেতে পারেননি।

নিজের ভুলোমনের জন্য তাঁকে অনেক রকম অসুবিধের মধ্যে পড়তে হলেও একবার কিন্তু ঠিক উল্টো ব্যাপার ঘটেছিল। অন্যের ভুলোমন তাঁর কিভাবে কাজে এসেছিল সেটাই বলি।

জামাইষষ্ঠীর আগের দিন হারাধনবাবু শ্বশুরবাড়িতে যাবেন বলে সকাল আটটা কুড়ির চক্রধরপুর-গেমো ট্রেনে চেপে বসেছেন। গাড়িতে খুব বেশি ভীড় ছিলেন। কিন্তু বাগালিয়া ষ্টেশনে গাড়ি ঢুকতেই পুরো একটা বড় সড় প্যাসেঞ্জার টিম হৈ-হৈ করে বগিতে চেপে পড়ল। হারাধনবাবুর মনটা অনেকক্ষণ ধরেই খচ্‌ খচ্‌ করছিল। তিনি কি কিছু ভুলেছেন। পকেটে হাত দিয়ে দেখলেন মানিব্যাগ আছে। ব্যাগের মধ্যে জলের বোতল, রুমাল সব ঠিকঠাক আছে। তাহলে? না তার কিছু ভুল হয়নি। অফিসে কাজের চাপে অনেকদিন ট্রেনে করে বাইরে যাওয়া হয়নি। হারাধনবাবু জানালার ধারে একখানা সিট পেয়েছেন। জৈষ্ঠ্যমাসের প্যাঁচপেচে গরমে জানালার ঠান্ডা বাতাস তার চোখে ঘুম এনে দিচ্ছে। তিনি মাঝে মাঝেই চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন, কিন্তু সহযাত্রীদের হৈ-হট্টগোল তার সে ঘুম উড়ে যাচ্ছে। তিনি তো আর ডেলিপ্যসেঞ্জার নন যে এভাবে হৈ-হট্টগোলের মধ্যে একখনা তোফা ঘুম দিয়ে দেবেন। বাইরে কড়া রোদের তেজ আজ অনেকটা কম আছে। মাঝে মাঝে আকাশ মেঘলাও হয়ে যাচ্ছে। জানালার বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে হারাধনবাবুর হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়ে যাচ্ছে 'তিনি কি কিছু ভুল গেছেন?"

মহুদা ষ্টেশন আসতেই কামরার সব প্যাসেঞ্জার লাইন দিয়ে ঝটপট করে নেমে গেল। কামরায় অনেকগুলো বাচ্চাও ছিল। সবই একসঙ্গে নেমে যেতেই বগিটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। ট্রেনও চলতে শুরু করল। পরের ষ্টেশনে তিনি নামবেন বলে তৈরি হাতে লাগলেন। হঠাৎ তাঁর চোখ চলে গেল বাঁ-দিকের বাঙ্কের উপর। দুটো মাটির হাঁড়ি কাঁচা শালপাতা দিয়ে ঢাকা। হারাধনবাবু হাঁড়ি দুটোর কাছে এসে শালপাতা আলতো করে খুলে দেখলেন ভেতরে বেশ বড় বড় রসগোল্লায় ঠাসা। বাগালিয়া ষ্টেশনে লোকগুলো যখন ট্রেনে উঠল তখন তিনি তাদের হাতে ঐ হাঁড়িদুটো দেখেছিলেন। এখন তিনি কি করবেন? লোকগুলো নিশ্চয়ই কোন অনুষ্ঠান বাড়িতে যোগ দিতে চলে গেল। তারা রসগোল্লার হাঁড়ি দুটো না পেয়ে বিপদে পড়বে। কিন্তু হারাধনবাবু তো আর তাদের উপকার করতে পারবেন না। বাধ্য হয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন ট্রেন থেকে নামার সময় হাঁড়ি দুটো তিনি সাথে নিয়েই নামাবেন। হাতের নাগালে দু' হাঁড়ি রসগোল্লা গোল্লায় যেতে দিতে পারেন না। তিনি হাঁড়িগুলো না নামালে অন্য কেউ নামিয়ে নেবে। অন্যের জিনিস সাথে নিয়ে যাওয়াটা ঠিক কি বেঠিক সে সব ভাববার আর তিনি সময় পেলেন না। গাড়ি ষ্টেশনে এসে থেমে গেল।

আকাশ মেঘে ঢেকে গেছে। এক পশলা বৃষ্টিও নেমে যেতে পারে। হারাধনবাবুর ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ননষ্টপ ঝুলে আছে। তিনি কাঁধে ব্যাগ রেখে দুটো হাঁড়ি দু'হাতে ঝুলিয়ে মাঠ ভেঙ্গে হেঁটে চলেছেন। এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস চোখে মুখে ঝাপটা মারতেই সহসা তাঁর মনে পড়ে গেল, আরে এতক্ষণ তিনি 'কি ভুলে গেছেন' ভাবতে ভাবতে আসছিলেন, কিন্তু তিনি মিষ্টি কিনতেই তো ভুলে গিয়েছিলেন। ঠিক করেছিলেন ট্রেনে ওঠার আগে গদাই-এর মিষ্টির দোকান থেকে এক হাঁড়ি রসগোল্লা কিনে নেবেন। অথচ মিষ্টি কেনার কথা তিনি বেমালুম ভুলে গেলেন।

যাইহোক, এখন তো আর কোন চিন্তা রইল না। পরের ধনে পোদ্দারি করে তিনি দু-দুটো রসগোল্লার হাঁড়ি নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে সসম্মানে ঢুকতে পারবেন। হারাধনবাবু ভুলোমনের অনেক খেসারত দিয়েছেন। আজ অন্যের ভুলোমনের হাওয়া নিজের পালে লাগিয়ে তার মেজাজটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেছে।

আনন্দে ডগমগ হয়ে হারাধনবাবু লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগলেন।


ছবিঃত্রিপর্ণা মাইতি

পুরুলিয়ার বাসিন্দা তরুণ কুমার সরখেল জেলার প্রশাসনিক বিভাগে কাজ করেন। পাশাপাশি ছোটদের জন্য নিয়মিত লেখালিখি করেন, এবং ছোটদের জন্য একটি মুদ্রিত পত্রিকা সম্পাদনা করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা