সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

এ দিকে আমি নিজের মনে মনে ভেবে আশ্চর্য হচ্ছিলাম, পায়রা ডিম দেয় ! ডিমে তা দেয়, আর সেই ডিম থেকে হয় বাচ্চা ! এ তো অবাক কথা ! আরও অনেক প্রশ্ন করব বলে যখন বাবার দিকে তাকালাম, দেখি বাবা ঘরে নেই--তিনি অফিসের দিকে বেরিয়ে গেছেন । একা আমি এখন কি করবো ? বাবা অফিসে মানে আমি আর মা ঘরে এখন কেবল দুটি প্রাণী । মনি মাসি কাজের লোক, সকালে বিকেলে দু বেলা কাজ করে যায়। ছুটির দিন হলে বেলা দশটা পর্যন্ত আমি মনি মাসিকে মনের প্রশ্ন করতে পারি । আর আমি দেখেছি, মাসিও অনেক কিছু জানে । কিন্তু এখন তো তাকেও পাওয়া যাবে না।

আমার মা- বাবার ওপর ভারি রাগ হল । মা- বাবা কি কিছু বোঝে না ? ওই পায়রাগুলি ঘর বানায়, ডিম দেয়, তারপর তা দিলে ডিম থেকে বাচ্চা হয় । পাখির বাচ্চা, আহা কি ভালো, কি সুন্দর ! ওই বড় পায়রার ছোট্ট ছোট্ট, কুট্টি কুট্টি বাচ্চা--কত ভালো, কত ভালো ! কিন্তু বাবা, মা যদি কিছু বুঝত ! পায়রাকে সব সময় উড়িয়ে দেয় !

ঘরে গিয়ে উঁকি মারলাম, না, মা, নেই--নিশ্চয় তবে পায়রাদের তাড়াতে গিয়েছেন !


ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলাম, ঠিক, মার হাতে লাঠি । আমার ভীষণ রাগ হল । আমি মার লাঠিটা দু হাতে ধরে ফেললাম, বললাম, "মা, তুমি পায়রাদের মারবে না--ওদের বাচ্চা হলে আমি বাচ্চার সঙ্গে খেলব ।" মা বলে উঠলেন, "না, না, তা হবে না, ওদের আমি এখানে ডিম পারতে দেব না ।"
আমার ভীষণ রাগ হচ্ছিল--আমি রেগে মেগে চীৎকার করে ভ্যাঁ ভ্যাঁ .করে কাঁদতে লাগলাম । সে কান্না যেন কিছুতেই থামতে চাইছিল না ।

শেষে মা আমাকে আদর করলেন, বোঝাতে চেষ্টা করলেন.কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না--আমি দিন ভর গুম হয়ে বসে থাকলাম । বাবা এলেন অফিস থেকে । তবু আমি চুপচাপ । বাবা আমার দিকে তাকিয়ে আমার রাগের কথা বুঝতে পেরে ছিলেন, আমায় ডেকে, জিগ্যেস করলেন,"কি হয়েছে, বাবা ?"

এবার আমার আরও কান্না পেতে লাগলো-সারা দিনের রাগ যেন একটু একটু করে বেরিয়ে আসতে থাকলো । আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম । মা, বাবার কাছে এসে আমার রাগের কারণ জানালেন । বাবা কিছু সময় চুপ করে থাকলেন । তারপর মার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, "আচ্ছা, এক বারের জন্যে ব্যালকনিতে পায়রাদের থাকতে দিলে কেমন হয় ?"

মা প্রথমটায় আপত্তির সুর টেনে ছিলেন কিন্তু বাবা মাকে আমার হয়ে বোঝালেন । অবশেষে মা এক বারের জন্যে ব্যালকনিতে পায়রাদের থাকতে দেবেন বলে মেনে নিলেন ।

আমার রাগ কোথায় যেন ভ্যানিশ হয়ে গেল ! চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো । আমি মাকে সমস্ত রাগ ভুলে জড়িয়ে ধরলাম, আদর করে চুমু খেলাম।
বাবা হেসে বলেছিলেন,"বাঃ, সব আদর মাকে--আমি বলে সব ঠিকঠাক করে দিলাম !"
আমি এবার বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম, বাবার মুখটা নিচু করিয়ে গালে হামি খেলাম ।

ব্যালকনিতে পায়রা দিনভর খড়কুটো এনে বাসা বাঁধতে লাগলো । স্কুল থেকে এসে আমি রোজ দেখি খড়কুটো এনে পায়রারা গোল গোল করে কেমন বাসা বানাল ! আমি দেখলাম, এই ভর গরমে কত পরিশ্রম করে পায়রারা ঘর বানাচ্ছে ! একদিন ইশকুল থেকে এসে আমি অবাক হয়ে দেখলাম, পায়রার বাসায় ছোট ছোট দুটো সাদা ডিম ! বাবা, মা, মাসি সবাইকে আমি ডেকে পায়রার ডিমগুলি দেখালাম।

পরদিন স্কুল থেকে এসে দেখলাম, ডিমের ওপরে পায়রা বসে আছে । বাবা বললেন, "তপু, পায়রার কাছে যেন যাস না--ডিমে ও তা দিচ্ছে। ভয়ে উড়ে গেলে—তা না দিতে পারলে কিন্তু ডিম থেকে বাচ্চা বের হবে না !"

না, পায়রা কে আমি তাড়াই না, দূর থেকে দেখি যে ডিমের ওপর পাখিটা কেমন পাখনা ছড়িয়ে বসে আছে ! পায়রাকে দেখেছি বিকেলের দিকে খুব অল্প সময়ের জন্যে ডিম ছেড়ে বেরিয়ে যায় । আমিও প্রায়ই তাকে তাকে থাকি পায়রা বেরোলে ডিমগুলি দেখব আশায় । দেখেছি,খুব ছোট ছোট ডিম । আমরা হাঁসের ডিম,মুর্গির ডিম খাই তার চেয়ে পায়রার ডিম অনেক ছোট । বাবার কথা মত আমি ইচ্ছে থাকলেও ডিমে হাত দিই না । বাচ্চা কবে হবে--এক এক করে একুশটা দিন যেন আমার আর ফুরাতে চাইছিল না ।

আজকাল মাকেও পায়রার ওপর নজর রাখতে দেখছি । মা বলেছিলেন, "সত্যি ডিম নিয়ে পায়রাটা কি কষ্টই না করে ! ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডিম নিয়ে বসে থাকে, সারা দিনে পেট ভরে খায় না"

তার মানে মাও পায়রার জন্যে ভাবেন ? আমি খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম সে দিন ।

একদিন ডিম ফুটে বাচ্চা বের হল--খুব ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চা--গায়ে লোম নেই । মনে হচ্ছিল, দুটো গোল মাংসের টুকরো বুঝি ! ওদের দেখে আমার গা শিরশির করে উঠেছিল । ছানাগুলোর চোখ বন্ধ--মা বললেন, ওদের চোখ নাকি কিছু দিন পরে ফোটে তখন ওরা চোখে দেখতে পায় ।

কিছুদিন পর থেকে দেখলাম শাবকদের গায়ে পাখনা গজাতে শুরু করেছে । লক্ষ্য করলাম, মা পাখি সারা দিন বাইরে ঘুরে ঘুরে ছানার জন্যে খাবার যোগাড় করে--আর বারে বারে ছানাগুলির ঠোঁটের সঙ্গে ঠোঁট লাগিয়ে কেমন ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে খাওয়ায় ! খাবার সময় বাচ্চাগুলি কেমন চিঁ চিঁ শব্দ করে ডাকে । মা এক দিন মা পায়রা আর তার বাচ্চাদের দেখিয়ে আমায় বললেন, "দেখ্ তপু, ওদের মা কত কষ্ট করছে বাচ্চার জন্যে--মা পাখি নিজে খাক না খাক বাচ্চাদের জন্যে কোথা কোথা থেকে খাবার যোগার করে,খাবারগুলিকে আবার মুখে রেখে চিবিয়ে নরম করে তবে বাচ্চার মুখে ঢুকিয়ে দিচ্ছে !" মা আমার পাল্লায় পড়ে পায়রাদের জায়গা দিয়েছিলেন ব্যালকনিতে। এখন পায়রা ও তার শাবকদের ওপর মা'র মায়া দেখছি বেশী ।

বাবা মাকে বলেছিলেন, "বাচ্চাগুলি বড় হয়ে গেলে ব্যালকনিতে আর পায়রা বসতে দেব না গো--তোমার রোজ রোজ পরিষ্কার করতে বড় কষ্ট হয় ।"
মা বলেছিলেন, "না, আর ওদের তাড়াবো না--না হয় কষ্ট আর একটু করবো ।" সে দিন বাবা মার দিকে তাকিয়ে হেসে ছিলেন ।

আজ সে হাসির তাৎপর্য বেশ বুঝতে পারি । মা'র মায়া হয়ে গিয়ে ছিল পায়রাদের ওপর । এখন বুঝতে পারি মা'র সে দিনের ভাবনাতে ছিল এমনি একটা ভাব--সত্যি পৃথিবীতে মা জাতির খুব কষ্ট--মা'র যেমন সন্তানের জন্যে অসীম স্নেহ ভালোবাসা--সন্তানকে বাঁচাবার জন্যে, বড় করে তোলার জন্যে কত না তার কষ্ট--কত না প্রাণপাত ! তিনি পরিপূর্ণ মাতৃত্বের ছবি মা পায়রার মধ্যেও দেখতে পেয়ে ছিলেন ।

বাচ্চারা যখন সামান্য বড় হল তখন মা পায়রা এ দিক ওদিক কোথাও গেলে আমি মাঝে মধ্যে বাচ্চাগুলিকে নিয়ে সারা ঘর ঘুরে বেড়াতাম ।

এমনি এক দিন আমাদের চোখের সামনেই বাচ্চা পায়রাগুলি উড়ে গেল আকাশে । আমি মাকে ডেকে কেঁদে উঠে ছিলাম,"মা, মা, ওরা উড়ে গেল, দেখো !"

মার চোখেও দেখছিলাম উদার উদাস একটা ভাব, তিনি ভারী গলায় বলে উঠে ছিলেন, "আবার আসবে বাবা ! ওরা আবার বাসা বানাবে--আবার ডিম দেবে--আবার বাচ্চা হবে--আবার তুই ওদের নিয়ে খেলবি, কেমন ?"

আমি আর কাঁদলাম না. আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম । সত্যি মাথার ওপরের আকাশটা খুব বড় মনে হল । মনে আশা জাগল, আবার মাপাখি আসবে, ঠোঁটে তার থাকবে খড়কুটো--বাবা,মা কেউ ওদের তাড়াবে না, বরং সবাই ওদের খুব ভালবাসবে !

তাপস কিরণ রায় অর্থশাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন। স্কুলে শিক্ষকতা করেন বেশ কিছু বছর। পরে আয়কর বিভাগে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি মধ্য প্রদেশের জবলপুর শহরে বাস করেন। তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত লেখালিখি করেন। ছোটদের এবং বড়দের জন্য লেখা তাঁর অনেকগুলি বই-ও প্রকাশিত হয়েছে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা