সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

নীলুদের পাড়ার দুর্গাপুজো এবার পঞ্চাশ বছরে পড়ল। বিরাট ধুম তাই। এক বছর ধরে যে কত মিটিং, কত আলাপ আলোচনা, কত তর্ক বিতর্ক হয়েছে তার ঠিক নেই। এখন তো আবার থিম পুজোর যুগ, কাজেই এ বলে এই থিম তো অন্য কেউ সেটা ততক্ষণাৎ নাকচ করে অন্য আরেকটা থিমের দাবী তোলে। এমনিতে নীলুদের পাড়ার পুজোয় গত ঊনপঞ্চাশ বছরই সাবেকি ডাকের সাজের প্রতিমা হয়েছে। তপ্ত কাঞ্চন বর্ণের প্রতিমা, টানা টানা কাজল কালো নয়ন। প্রতিবারই ষষ্ঠীর দিন ঠাকুর দেখে পিসিমণি বলেছেন, "আহা, এই হচ্ছেন মা দুর্গা। ছেলেমেয়ে নিয়ে কেমন প্যাণ্ডেল আলো করে বসে আছেন দেখো দেখি! "

পিসিমণি আসলে নীলু মানে নিলাদ্রিশেখরের পিসিমণি হলেও নীলুর বয়সীদের আর পাড়ার ছোটোদের সবারই পিসিমণি আর বাদবাকি সক্কলের বড়দি। পাড়ায় বড়দিকে সবাই খুব মানে, খুব সম্মান করে। করারই কথা। পিসিমণির কোনো কাজ বা কথাই যে ফেলনা নয়। কম বুদ্ধি পিসিমণির! গতবার বাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজোর সময়ে রুপোর দুটো বাটি চুরি হয়ে গেছিল। পিসিমণি নিজেই চোরকে ধরে পাড়াসুদ্ধ লোককে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। পাড়ায় পিসিমণির তাই আলাদা খাতির। যদিও এবার পুজোর ব্যাপারে পিসিমণি খুব একটা সন্তুষ্ট নন। কারণ? কারণ ওই থিম। ঊনপঞ্চাশ বছরের ঐতিহ্য ভেঙে এবার অন্যরকম পুজো হচ্ছে যে। পুজো কমিটির অল্প বয়সীরা চলতি হাওয়ায় ভাসতে চেয়েছে অর্থাৎ থিম পুজোর পক্ষপাতী, দেখা গেল সংখ্যা গরিষ্ঠেরই তাই মত, একটু নতুনত্ব হোক এবার। অনেক আলোচনা হল এ নিয়ে, তারপর ঠিক হল এবার মা আসবেন শতাব্দী প্রাচীণ ভগ্ন জমিদারবাড়িতে। প্রতিমাও সেরকমই মানানসই হবে।

"বছরে একবার ওই পাঁচটি দিনের জন্যে মা ছেলেপুলে নিয়ে আসেন। তাঁকে রাখবে পোড়োবাড়িতে! হায় রে আমার পোড়া কপাল! " পিসিমণি বলেছিলেন সব শুনে।

সবাই মিলে ওনাকে খুব বোঝানো হয়েছিল, "এখন এসবেরই চল, এরকমই লোকের পছন্দ। প্রতিবারই তো ডাকের সাজের ঠাকুর হয়, এবারও তাই হলে আর নতুনত্ব আর কি হল! পঞ্চাশ বছর বলে কথা। দেখো না, প্যাণ্ডেল কমপ্লিট হলে বুঝতেই পারবে না প্যাণ্ডেল না সত্যি সত্যিই পোড়োবাড়ি! দেওয়ালের গা দিয়ে অশ্বত্থের চারা থাকবে, ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ করা ঝুলে পড়া জানলার পাল্লা থাকবে, মাকড়সার জাল থাকবে, ভাঙা ইঁটের স্তুপ থাকবে, তার মাঝে সাপখোপও থাকবে। সব একদম ন্যাচারাল মনে হবে। লোকে দেখে চমকে যাবে। "

"বাপের বাড়ি এসে মার কী দুর্গতি বাছা! শেষ অবধি মাকড়সার জাল, ইঁটের পাঁজার মধ্যে থাকতে হবে! করো, মাথায় যখন ঢুকেছে তোমাদের করে তো ছাড়বেই, সে আমার ভালো লাগুক আর নাই লাগুক। প্যাণ্ডেলের তো এই হাল করছ, মার যে কী হাল করবে ভাবতেই তো আমার বুক কাঁপছে! " বলেছিলেন পিসিমণি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে।

"যা ঠাকুর হবে না পিসিমণি দেখো! যাকে বলে একেবারে ফাটাফাটি! পোড়োবাড়িতে পুজো, ঠাকুরও সেরকমই হবে। বহু পুরোনো পাথরের মূর্তি। অযত্নে, অনাদরে মলিন, " নীলুর ছোটোবেলার বন্ধু সম্বুদ্ধ বলেছিল হাতটাত নেড়ে বেশ নাটকীয় ভঙ্গীতে।

শুনে পিসিমণি আর কিছু বলেন নি, শুধু কটমট করে একবার সবাইকে দেখে চলে এসেছিলেন।

অবশেষে মাস তিনেকের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তিনের পল্লীর মণ্ডপ পূর্ব পরিকল্পনা মতো রূপ পেল। শহরের নানা জায়গায় তো অনেক আগে থেকেই পোস্টার পড়ে গেছে, তিনের পল্লীর পঞ্চদশতম সর্বজনীন দুর্গোৎসবের থিম – প্রাচীন ভগ্নপ্রায় প্রাসাদে মহিষাসুরমর্দিনী।

তা সত্যিই। প্যাণ্ডেল বলে বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এক আদ্যিকালের পুরোনো বাড়ি। বাইরেটাতো ভাঙাচোরা বটেই, ভেতরের অবস্থাও তথৈবচ। ছাদ থেকে বাদুড় ঝুলছে, ইঁটের পাঁজায় ফণা তোলা সাপ, সাপের হিসহিস আওয়াজ, চামচিকের ডানা ঝটপটানি, মৃদু আলোয় সে এক গা ছমছমে পরিবেশ! লাইট আর সাউণ্ডের লা জবাব কেরামতি। তার মধ্যেই লম্বা টানা ঠাকুর দালানে মহিষাসুরমর্দিনী। হ্যাঁ শুধু মা দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করছেন। লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ – কেউ নেই। মূর্তি তো মাটিরই কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে পাথরের, বহু পুরোনো। ওই সম্বুদ্ধ যেরকম বলেছিল, 'অযত্নে, অনাদরে মলিন,' এক্কেবারে সেইরকমই। কিন্তু ওই ঠাকুরের পুজো হবে না। পুরুতমশাই কী সব আপত্তি করেছেন, তাই ছোট্ট একটা এক আটচালার ঠাকুর এক পাশে রাখা আছে, সেটা ওই পিসিমণির ভাষায় ছেলেপুলে সমেত মা দুর্গা।

পঞ্চমীর দিন উদ্বোধন হয়ে গেল। সবাই ভেতরে ঢুকে দেখে একেবারে থ হয়ে গেল। বিশেষত ভাঙা বাড়ির দরজা থেকে ঠাকুরদালান অবধি রাস্তাটা একেবারে অসাধারণ। দু একটা ছোটো বাচ্ছা ভয় পেয়ে কেঁদেও ফেলল। পিসিমণি এমনিতে ষষ্ঠীর আগে ঠাকুর দর্শন করেন না। তিনি ওসব উদ্বোধন টুদ্বোধন বিশেষ মানেন না। তাঁর মতে বোধন হবে, তবে না মা আসবেন। এবার নীলু জোরজার করে পঞ্চমীর দিন সন্ধ্যেবেলা নিয়ে এল। নীলুও এবার ছুটি নিয়ে এসেছে, পঞ্চাশ বছরের পুজো বলে।

পিসিমণি ঢুকলেন মণ্ডপে, চতুর্দিক দেখতে দেখতে। একটু গিয়ে একটা ট্যারাবেঁকা পাথর পড়ে আছে রাস্তা জুড়ে, সেটাকে পাশ কাটিয়ে যেতে হচ্ছে।

দেখে পিসিমণি বললেন, "এটাকে সরাচ্ছিস না কেন বাবা? লোকে যে হোঁচট খাবে! "

"পিসিমণি, এটা পোড়োবাড়ি। এখানে তো এসব থাকবেই। লোককে দেখেশুনে যেতে হবে, " নীলু বলল।

"বলিহারি! " বলে পিসিমণি এগোলেন।

দেওয়ালের পাশে ভাঙা ইঁট পাটকেলের স্তুপ, তার মধ্যে ফণা তুলে লিকলিকে জিভ বার করে কেউটে সাপ। পিসিমণি দাঁড়িয়ে পড়লেন, "একেবারে কাল কেউটে! সব ঢুকিয়ে ছেড়েছ প্যাণ্ডেলে! "

ঠাকুরদালানে পৌঁছে পিসিমণির মুখ গম্ভীর হল। ভালোই বোঝা যাচ্ছে প্রতিমা পছন্দ হয় নি। নীলুর বন্ধুরা এগিয়ে এল বোঝাতে। এই থিম তো তাদেরই উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত।

"প্রতিমা দেখেছ পিসিমণি? কী রকম হয়েছে বলো? একদম পুরোন পাথরের মূর্তির মতো এফেক্ট এসেছে। আর্ট বুঝলে? "

"ওসব আর্ট ফার্ট বুঝি নে বাপু, " বললেন পিসিমণি, "এই কায়দার পাথরের ঠাকুরের বদলে বরাবরের মতো ডাকের সাজের প্রতিমা রাখলেই তো হত। ঠাকুরদালানে দিব্বি মানাত। "

"ওহ হো পিসিমণি, তোমাকে বুঝিয়ে পারা যাচ্ছে না! ভাঙা ঠাকুরদালানে ডাকের সাজের ঠাকুর এনে কে পুজো করবে? তাই এরকম ঠাকুর, বুঝলে? "

"বুঝলাম। তা বাছা, তোমাদের পোড়োবাড়িতে পুজো কী আদৌ হবে? মানে মানুষ পুরুত আসবে নাকি শুধুই অনাদরে অযত্নে মলিন পাথরের ঠাকুর, সাপখোপ আর ভূতপ্রেতের কারবার হবে? "

"কী যে বলো পিসিমণি, দেখছ না আরেকটা ঠাকুরও রয়েছে, " নীলু সামলাবার চেষ্টা করে।

পিসিমণির দৃষ্টি ততক্ষণে প্রতিমার দিক থেকে ঢাকের দিকে গেছে। ঢাকের পাশে দাঁড়িয়ে একটা ছোট্ট ছেলে চোখ বড়ো বড়ো করে অবাক হয়ে সব দেখছে। পিসিমণি সেইদিকে এগোলেন।

"এটি কে বিকাশ? "

বিকাশ মানে যিনি পুজোতে ঢাক বাজান তিনি বললেন, "বড়দি, এ আমার ছোটো ছেলে সন্তু। "

পিসিমণি গাল টিপে, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বললেন, "সুন্দর ছেলে। পড়াশোনা করিস তো? কোন ক্লাসে পড়িস বাবা? "

সন্তু নয়, সন্তুর বাবা বিকাশই উত্তর দিলেন, "কেলাস ওয়ান বড়দি, এই সাত বচ্ছরে পড়ল তো। "

"বেশ বেশ। তা বিকাশ তোমার বাবা কেমন আছে? এই পুজোতে তো সনাতনই বরাবর ঢাক বাজাত। "

বিকাশ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় পুরুতমশায়ের সঙ্গে পাড়ার কিছু মানুষ প্রবেশ করলেন, পুজোর কর্মকর্তারাও আছেন। কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে সবাই আলোচনা করছেন।

ব্যাপার আর কিছুই নয়, তিনের পল্লীরই বাসিন্দা এবং সরকার সুইটস-এর মালিক সরকারবাবু এবং তাঁর স্ত্রী মা দুর্গাকে একখানা সোনার হার দেবেন। সমস্যা হচ্ছে হারটা কোন প্রতিমার গলায় শোভা পাবে। পোড়াবাড়ির পাথরের ঠাকুর না যে প্রতিমার পুজো হবে।

নীলুর বন্ধুরা তো শুনেই একবাক্যে বলল, "পাথরের ঠাকুরের গলাতেই থাক। কালার কনট্রাস্টটা ভালো হবে। "

পিসিমণি কিন্তু বেঁকে বসলেন, ওদের অস্ত্রে ওদেরই ঘায়েল করলেন, "কেন বাছা, তোমাদের পোড়োবাড়ির ঠাকুর তো অযত্নে মলিন, তার গলায় সোনার হার আসবে কোত্থেকে? পোড়োবাড়িতে সোনার হার থাকলে তো চুরি হয়ে যাবে। সোনার হার তো আমার মা পরবেন, তা সে তাঁর প্রতিমা যত ছোটই হোক না কেন। "

পুরুতমশাই-এরও তাই মত, পুজো তো ওই ছোটো প্রতিমারই হবে। তাই সোনার হার ওই প্রতিমার গলাতেই থাক।

মিসেস সরকারের মনে হল সেটা মনঃপূত হল না। মুখটাকে ব্যাজার করে বললেন, "কিন্তু এই ঠাকুর তো কেউ ভালো করে দেখবেই না। সবাই তো পাথরের ঠাকুরই দেখবে। "

"হায় রে আমার পোড়া কপাল! একটু ভেবেচিন্তে কথা বলো ভাই, " পিসিমণি একেবারে ধমকে উঠলেন, "তুমি মাকে হার দিচ্ছ, মা দেখলেই হল, রাজ্যসুদ্ধ লোকের নজর ওদিকে যাওয়া কি ভালো? "

ব্যাস, এরপর সবাই একেবারে স্পিকটি নট! পিসিমণির কথার ওপর কথা! সে কেউ ভাবতেও পারে না।

দেখতে দেখতে পুজো জমে গেল। লোকের মুখে মুখে তিনের পল্লীর পুজোর প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ল। গোটা কয়েক পুরস্কার যে এবার ঝুলিতে আসছেই সে ব্যাপারে সবাই নিশ্চিত। ঢাকের বোলে বিকাশও একেবারে মাতিয়ে দিলেন। অতটুকু ছেলে সন্তু কী সুন্দর যে কাঁসর বাজায়!

"বংশের ধারা পেয়েছে। এ ছেলে তোমার খুব বড়ো হবে বিকাশ," পিসিমণি বললেন।

সত্যি কথা বলতে সন্তুটাও এই দুদিনে পিসিমণির খুব ন্যাওটা হয়ে গেছে। হওয়ারই কথা অবশ্য, রোজ দুবেলা পিসিমণির কাছ থেকে টিফিনভর্তি করে ভালোমন্দ খাবার আসছে শুধু ওর জন্যেই।

"ও হল আমাদের অতিথি, প্রথমবার কোনো বড়ো শহরে এসেছে। দেখছিস না কীরকম চোখ বড়ো বড়ো করে বাক্যিহারা হয়ে সব দেখে!" পিসিমণি বলেন।

অদিতি সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। কর্মসূত্রে আরব দুনিয়ায় বসবাসের অভিজ্ঞতাও আছে। বই পড়তে ভালোবাসেন। ভ্রমণ,ছবি তোলা,এম্ব্রয়ডারির পাশাপাশি লেখালিখিতেও সমান উৎসাহী। নানান ওয়েব ম্যাগাজিন ও পত্রপত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।
undefined

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা